তথ্যমন্ত্রী : টিআইয়ের রিপোর্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে

আগের সংবাদ

নীরব মহামারি অসংক্রামক রোগ

পরের সংবাদ

বাঙালির সাংস্কৃতিক অর্জনের সঙ্গে ওয়াহিদুল হকের নাম যুক্ত হয়ে থাকবে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সম্পূর্ণ বাঙালি হবার আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি, বহুমাত্রিক প্রতিভাধর ওয়াহিদুল হক। সংস্কৃতির জমিনে দাঁড়িয়ে তিনি সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে একই সঙ্গে কলম ও সংগঠন নিয়ে যুদ্ধ করেছেন। বিশ্ব মানব হতে হলে যে প্রথমেই সম্পূর্ণ বাঙালি হতে হবে এই বার্তা তিনি পৌঁছে দিতেন তার গানে, আবৃত্তিতে, সাংবাদিকতায় ও সুশিক্ষায়। বিশেষ করে আগামী দিনের নাগরিকদের সুশিক্ষা ও সুরুচি নির্মাণে তিনি ছিলেন খুবই তৎপর। এই পরশমণির সংস্পর্শে যারাই এসেছেন তারাই খাঁটি বাঙালি হবার অনুপ্রেরণা পেতেন।
কত স্মৃতি ভিড় করছে। আমি তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। সত্তরের দশকের শুরুর দিকের কথা বলছি। একটি কাজের খুব প্রয়োজন ছিল আমার। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকায় লিখছিলাম। কিন্তু এভাবে আর কত টাকাই মেলে? তাই খুব চেষ্টা-তদবির করে ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে একটি খণ্ডকালীন চাকরি জোগাড় করেছিলাম। কী সৌভাগ্য আমার। কাজে যোগ দিয়ে দেখি আমাকে ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে কাজ করতে হবে। আমি তাকে আগে তেমন করে চিনতাম না। তিনি যেহেতু পেছন থেকে কাজ করা পছন্দ করেন তাই অনেকেই তাকে সেইভাবে জানতেনও না। কিছুদিন একসঙ্গে কাজ করতে করতেই তার সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হলো। তার বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় পেতে থাকলাম। অবাক বিস্ময়ে তার সেই প্রতিভার ধরন দেখতে লাগলাম। আমার বিস্ময়ের পালা যেন শেষ হতেই চায় না। দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে তার স্নেহ, সান্নিধ্য পেয়েছি। খুব কাছে থেকে তাকে দেখেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, পরিবাগের ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে দেখি এক গাদা স্থাপত্যবিষয়ক বই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই বই কি আপনি মনের আনন্দেই পড়ছেন? হেসে বললেন, না। পড়াতে হলে এগুলো পড়তে হয়। তখনই জানলাম তিনি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক। একজন স্বশিক্ষিত মানুষ কতটা অধ্যবসায়ী হলে স্থাপত্যকলার মতো বিষয়ে শিক্ষকতা করতে পারেন। পরে শুনেছি তিনি খুবই সফল শিক্ষক ছিলেন। তা হবারই কথা। তিনি যেমন করে গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন তাতে তার পক্ষে খুব জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়াটাই স্বাভাবিক। ১৯৭৩ সালের কথা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাহিত্য সম্পাদক। টিএসসিতে আমরা একটি বিতর্ক সভার আয়োজন করেছি। প্রধান অতিথি হিসেবে ওয়াহিদুল হককে নিয়ে গেলাম। অনেকেই ভ্রæ কুঁচকালেন। তাকে অন্য দশজন বুদ্ধিজীবীর মতো সচরাচর দেখা যায় না বলেই হয়তো এমন প্রতিক্রিয়া। বিতর্ক শেষ হলো। এরপর তিনি বলতে শুরু করলেন। সে কী কথা। মনে হলো আমাদের বিভাগের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকরা অমৃত গিলছেন। বহুদিন আমরা তার ওই বক্তৃতার কথা মনে রেখেছিলাম। শিক্ষকরা তার মতো একজনকে প্রধান অতিথি হিসেবে বেছে নেয়ার জন্য আমার প্রশংসাই করলেন। ‘দি পিপল’ পত্রিকায় তিনি সম্পাদকীয় লিখতেন। তার লেখার বিষয় কত যে বৈচিত্র্যময় হতে পারে তা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। সুযোগ পেলেই তিনি বাঙালির সংস্কৃতি নিয়ে লিখতেন। আর লিখতেন মানুষ নিয়ে। এ দুটি ছিল তার প্রিয় বিষয়। এরপর দেখি একদিন তিনি তার গাড়িটা বিক্রি করে দিলেন। ব্যাপার কী? জিজ্ঞেস করতেই বললেন, নির্বাচন করবেন। ঢাকার অদূরেই তার নির্বাচনী এলাকা। খুব খেটেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে পার হতে পারলেন না। কেন এমনটি করলেন? বললেন, কিছু ভালো মানুষকে পার্লামেন্টে না পাঠালে রাজনীতির মান ভালো হবে কি করে? আরেক দিন দেখি তিনি একটি চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখছেন। সেই ছবির চলচ্চিত্রায়ন হলো সুন্দর ছবি। কিন্তু ব্যবসাসফল নয়। তাছাড়া ছায়ানটে গান শেখান। সেই সুবাদে আমার স্ত্রী-কন্যাদেরও তিনি ছিলেন ওয়াহিদ ভাই, না হয় দাদু। আমাদের পরিবারের অতি আপনজন। আমাদের পরিবারের এক আপনজন চলে যাবার ফলে কী এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। বিশেষ করে আমার স্ত্রী পাপড়ি ও কন্যা অর্ণর কষ্ট যে কী গভীর তা শুধুই অনুভব করতে পারি, অন্যকে বোঝাতে পারি না। কত বিচিত্র ছিল তার কাজ তা বলে শেষ করা যাবে না। দেশে জন্মালেই যে দেশ আপন হয় না- তাকে কাছে থেকে না দেখলে কথাটির মর্ম বুঝতে পারতাম না।
ছেলেমেয়েদের শুদ্ধ উচ্চারণ শেখানো, আবৃত্তি শেখানো, গান শেখানো, নাচের চর্চা এমনতরো কত সাংস্কৃতিক আয়োজনের যে তিনি প্রাণপুরুষ ছিলেন তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে তার প্রিয় এক কাজ ছিল রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদকে সুদৃঢ় করা। সারাদেশে রবীন্দ্রনাথের গানের শিক্ষা প্রসারে তিনি কী পরিশ্রমই না করতেন তা বলে শেষ করা যাবে না। ভঙ্গুর শরীর। হার্টের অসুখ। খাওয়া-দাওয়া সীমিত। কিন্তু দিনের পর দিন তার পথ চলাতেই আনন্দ। এই চলার যেন শেষ নেই। চাঁদপুরে গিয়ে, টাঙ্গাইল গিয়ে আমরা লক্ষ করেছি রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে তিনি কী বিশাল এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই ছিলেন তার সঙ্গে। সবাই জানেন তিনি আদর্শের সঙ্গে আফস করতেন না। সত্যি কথা ঘুরিয়ে বলতেন না। মনে যা আসে তাই লিখে ফেলতেন। তবুও তিনি ছিলেন সবার ওয়াহিদ ভাই। অনেকের দাদু। অবশ্যি, সন্জীদা আপা, পার্থ, মফিদুল ভাই, মিতাসহ অনেকেই বিপুলভাবে সহযোগিতা করতেন বলেই এই বিশাল আয়োজন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। সব সময় তিনি থাকতেন পেছনে। সামনে অনেকেই।
তবুও তিনিই ছিলেন এর মধ্যমণি। তিনি রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের প্রতিটি সভাতেই একটি বিষয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। তা হলো বাঙালি সংস্কৃতির ধারাকে আরো শক্তিশালী না করতে পারলে এ দেশে রাজনৈতিক সুস্থিতি আসবে না, সন্ত্রাস বন্ধ হবে না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুদৃঢ় হবে না। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষায় সাংস্কৃতিক কর্মকে যুক্ত করার পক্ষে ছিলেন। প্রায়ই আফসোস করে বলতেন, স্কুলে স্কুলে যদি গানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যেত তাহলে হয়তোবা সংস্কৃতির পালে হাওয়া লাগত। শেষ বয়সে নালন্দা নামের স্কুলটি গড়তে আদাজল খেয়ে নেমেছিলেন। সঙ্গে অবশ্যি সন্?জীদা আপাও ছিলেন।
তিনি বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে অগ্রণী ছিলেন। ১৯৬৪ সালের সংখ্যালঘু আক্রমণের সময় সাভারে বন্ধুদের নিয়ে যেমন তিনি ছুটে গেছেন, ২০০১ সালেও তেমনি সিরাজগঞ্জে ছুটে গেছেন পূর্ণিমাদের বাঁচাতে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সুস্থিতির জন্য তিনি ছুটেছেন, লিখেছেন, বলেছেন নিরন্তর। ষাটের দশকের শুরুতে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের মধ্য দিয়ে তিনি যে সাংগঠনিক দক্ষতা দেখিয়েছিলেন তারই ফসল ছায়ানট। অবশ্যি, আরো অনেকের অবদান অনস্বীকার্য। তবে তিনিই কলকাঠি নাড়তেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় বিক্ষুব্ধ শিল্পীদের নিয়ে রণাঙ্গনে, মুক্ত এলাকায় গানের আসর বসানোর মতো কাজ কিছুদিন আগ পর্যন্তও তিনি করে গেছেন। মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। পথের ধার থেকে গুণীদের খুঁজে বের করা ছিল তার এক ধরনের নেশা। কত গুণীজনকে যে তিনি এভাবে সংস্কৃতির আলোয় ঝলমলিয়ে তুলেছেন তার কোনো হিসাব নেই। পাশাপাশি সঞ্জয়, দীপাদেরও তিনি ছিলেন প্রধান ভরসাস্থল। ধীরে ধীরে তাদেরও তিনি সংস্কৃতির ঝরনাধারায় নিয়ে এসেছেন। তাঁর বন্ধুরাও সংস্কৃতি জগতের একেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। ওয়াহিদুলকে নিয়ে তারা ছিলেন গর্বিত। দেশ নিয়ে তিনি কী রকম উদ্বিগ্ন ছিলেন বা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির ওপর তিনি কতটা ক্ষিপ্ত ছিলেন- তা তার লেখা কলামগুলো পড়লেই বোঝা যায়। কখনো কখনো তার লেখায় গালমন্দও এসে যেত। খুব সম্ভবত স্বাধীন বাংলাদেশের চূর্ণবিচূর্ণ চেহারা দেখেই অনেক সময় তিনি এমনভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে যেতেন। তিনি একজন খনি শ্রমিকের মতো খেটে লিখেছেন। শুধু যে বেঁচে থাকার জন্য তিনি এ পরিশ্রম করেছেন এ কথা বললে পুরোটা বলা হবে না। আমাদের সবাইকে বাঁচানোর জন্যই তিনি এমন পরিশ্রম করেছেন বলাটাই সঙ্গত হবে।
তার কাছে আমরা নানাভাবে ঋণী। বাঙালির যা কিছু সাংস্কৃতিক অর্জন পহেলা বৈশাখ, বসন্ত উৎসব, বর্ষা উৎসব, রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনসহ আরো কত কিছুর সঙ্গে ওয়াহিদুল হকের নাম চিরদিনের জন্য যুক্ত হয়ে আছে। তার জীবনের সার্বিক কর্মকাণ্ড বুঝতে পারলেই বাংলাদেশকে তথা বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতিকে অনেকটাই বোঝা সম্ভব হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবেও তার কাছে বহুভাবে ঋণী। সংস্কৃতির চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আমি তার কাছ থেকেই পেয়েছি। তিনি যে চোখ আমাদের দিয়ে গেছেন তাকে যদি তার চেতনা প্রসারে কাজে লাগাই তবেই তাঁর আত্মত্যাগ সার্থক হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়