তথ্যমন্ত্রী : টিআইয়ের রিপোর্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে

আগের সংবাদ

নীরব মহামারি অসংক্রামক রোগ

পরের সংবাদ

বাংলা সাহিত্যে অন্য উচ্চতায় কবি কামাল চৌধুরী

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

‘বাঙালি এখন অজস্র শব্দ বলে। কিন্তু শব্দ নিয়ে ভাবে না।’ কথাটা বলেছিলেন কবি কামাল চৌধুরী। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে একটি কবিতা আসরে। তিনি বলছিলেন শব্দব্রহ্ম এবং দুই বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক লেনদেনের অভাবের মতো গুরুতর বিষয়ে। সত্তর দশকের কবি কামাল চৌধুরী। সত্তর দশক। এক ধরনের অস্তিরতা, অস্থিতিশীল সময়। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি রাষ্ট্র; সব কিছুতেই বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা। স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল; পরবর্তীতে তারাই শুরু করলো নতুন যুদ্ধ। ফলে সত্তর দশকের কবিতাগুলো হয়ে উঠলো আর্তনাত, চিৎকার ও আহাজারির কবিতা। যা ক্রমেই মানুষের দাবি আদায়ের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে পরিণত হয়েছিল। তখন কবিতার নান্দনিক চেতনা, ছন্দ, মাত্রা, সৌন্দর্যবোধ সবকিছুই বিফলে যাচ্ছিল সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাধারণ মানুষের আহাজারির কাছে। এমন উত্তাল ও ঝড়ো সময়ের মধ্যে দিয়েও সত্তর দশকের যেসব কবি বাংলা কবিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন কবি কামাল চৌধুরী তাদের অন্যতম।
তার কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম ও দ্রোহ। শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয় ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, মার্চের রক্তঝরা স্বাধীনতা আন্দোলন, ’৭৫-এর জাতীয় সংকটের মুহূর্তসহ সব শোকময় অধ্যায়, অগ্নিঝরা মুহূর্ত কিংবা প্রতিবাদী চিত্র এ প্রজন্মের কাছে কবি তুলে ধরেছেন তার বলিষ্ঠ লেখনীতে। তিনি ‘টুঙ্গিপাড়া গ্রাম থেকে’ শিরোনামের কবিতার মাধ্যমে স্মরণ করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এবং অঙ্গীকার করেন প্রতিশোধের।
তীব্র প্রতিশোধ আমি ছুড়ে দেই খুনিদের মুখে/ দ্যাখো, আগুন জ্বলছে আজ শুদ্ধ সব বাঙালির বুকে/ এখন স্বদেশে চাই, শুধু চাই/ তোমার সৈনিক কিছু সবল গোলাপ।/ যেখানে ঘুমিয়ে আছ, শুয়ে থাক/ বাঙালির মহান জনক/ তোমার সৌরভ দাও, দাও শুধু প্রিয়কণ্ঠ।
তিনি শব্দ নিয়ে ভেবেছেন এবং ভাবিয়েছেন। তার কবিতা বোঝার চটজলদি কোনো দাওয়াই নেই। পাঠককে তার কবিতার কাছে আসতে হবে। সময় করে ধৈর্য ধরে বুঝে নিতে হবে অক্ষরবিন্যাস। তার স্পষ্ট উচ্চারণ ও স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে সময়জ্ঞান তুলে ধরেন তার কাব্যিক ভাষ্যের মধ্য দিয়ে। তিনি সচেতন যে, তিনি একটি সমবেত স্মৃতির উত্তরাধিকারী। তাই পুরাণ, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের মিলিত স্রোত এসে তার নিজস্ব ভাষামুদ্রা তৈরি করে দিয়েছে। তার কাব্যকীর্তি অশেষ। তার মাত্র তিনটি বইয়ের আলোচনায় তাকে কিছুটা ধরার চেষ্টা করা যাক।
ভ্রমণ কাহিনি (২০১৫) জীবনবোধের কবিতা
দেশ-বিদেশে ভ্রমণের মাঝে যে নৈঃসঙ্গ ও কোলাহল, জীবনের ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, মহৎ অনুসঙ্গ যা ধরা দিয়েছে কবির চেতনা তন্ত্রীতে সেই কবিতাগুলো নিয়ে তিনি লিখেছেন এই ‘ভ্রমণ কাহিনি’ সিরিজ। মাত্র ২৪টি কবিতার।
এই সিরিজের নান্দীমুখ বড় রূপকল্পময়। তিনি শুরু করেছেন- স্বাগতম রাত্রি, বাতাস নবীন বন্ধু, দোলা দাও/ চৈতন্যে প্রসূনে ঢালো, বীজমন্ত্র ঢালো অবিরল/ বলো তাকে, সে আমাকে ডানা দিক উড়ন্ত আয়ুধ/ অন্ধকারে উড়ে যাব দু’চোখের দিগন্ত সীমায়/বলো তাকে আলো দিক রাতভর জাগর প্রশাখা…
ইতিহাস থেকে বর্তমানে অনায়াসে যাতায়াত-করা এই কবি আবেগকে প্রজ্ঞা দিয়ে শাসনে বিশ্বাসী, তারল্যে নয়। তাই তিনি বলেন, ‘কেবল ধূলির চিহ্ন রেখে দিয়ে পায়ের তালুতে/ শতাব্দীর ক্ষতচিহ্ন ঢেকে দিয়ে শুকনো পাতায়/ শোনিত সবুজ ঘাস উন্মাদনা বিস্ময়ের পথে/ কবির অঞ্জলি পেতে লিখে রাখি ভ্রমণ কাহিনি/ কবির অঞ্জলি পেতে লিখে যাব ভ্রমণ কাহিনি’
যে বইয়ের মুখরা এত ছন্দময় তার বাকি কবিতাগুলো কেমন হবে তার একটা আন্দাজ প্রথমেই দিয়ে রেখেছেন কবি। কবি কামাল চৌধুরীর কথায়, ‘কবির কাজ তো সবকিছুকে নাড়িয়ে দেয়া- সমাজ ও সভ্যতাকে, প্রথা ও প্রাতিষ্ঠানিকতাকে। এমনকি, নিজেকেও।’
তিনি যে প্রথাসিদ্ধ কবিতামার্গের ভেতরে যাননি, তার স্বাক্ষর তার প্রথম কবিতাতেই। ‘শূন্য থেকে উঠে যাবে হৃদপিণ্ড, মহিমার বীজ/ নিজের প্রশ্রয়ে তারা পুনর্বার জন্ম নেবে শীতে’। কী আশ্চর্য রূপকল্পে ভেতরে ভেতরে খুলে যায় হিরণ্যগর্ভ, বাক ও সৃষ্টির মৌন গহ্বর থেকে নিঃসৃত হয় ব্যঞ্জনাময় কাব্যভাষা।
কবিতা লিখে খ্যাতি পাওয়া যায়, গুচ্ছের পুরস্কার পাওয়া যায়, কিন্তু কিংবদন্তি হওয়া অত সহজ নয়। আনুকূল্য একজন কবিকে কিছু সময়ের জন্য হয়তো একটা পরিচিতি এনে দেবে কিন্তু প্রকৃত পাঠক শেষ অবধি প্রকৃত কবিকেই বেছে নেবে। জীবনানন্দ দাশ অনেকক্ষেত্রে আনুকূল্য তো পাওয়া দূর তেমন কোনো পুরস্কারই পাননি। পৃথিবীতে অনেক কবিই আছেন যারা অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু সময় তাদেরকে মনে রাখেননি। অথচ জীবনানন্দকে আমরা এখনো স্মরণ করি। কবিতার বৈচিত্র্য তো সবসময়ই থাকে। কেউ দেখা যায় এক সময় লিখছে, অথচ সমকালে তাকে কেউ আবিষ্কার করতেই পারছে না। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো তাকে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করছে। কবি কামাল চৌধুরীর কবিতা কলকাতায় বসে পড়তে পড়তে আমার প্রায়শই মনে হয় তিনি সমকালীন পাঠকদের কাছে কতটা আবিস্কৃত!
তার এই কবিতা সংকলন মননে দৃঢ়, বৈদগ্ধ্যে বহুচারী, ভাষায় ঋজু ও সংযত বাংলা সাহিত্যে বাস্তবিক অর্থে ব্যতিক্রমী এক সংযোজন। মুদ্রণযোগ্য ও গ্রন্থনযোগ্য কবিতার মধ্যে তফাত রয়েছে। তাই অভিজ্ঞতার বিস্তারকে যোগ্য ভাষা দিয়ে ধরার জন্য অপেক্ষা করেছেন। ‘পাথরে মৃতের শয্যা, নশ্বরের বাঁচার আকুতি/ আজ মুগ্ধ প্রতœকলা, জাতিস্মর প্রতিটি সকাল-/ সময় অতীত কাল, বর্তমান ঋতুচক্রে হাসে/ সৃষ্টি তীরে প্রতিধ্বনি অবিরাম ঝড়ে ঝাপটায়’।
বাঙালি আর বাংলাদেশি সংস্কৃতির কোনো বিভাজনরেখা নেই। বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস থেকে আলাওল সবেরই উত্তরাধিকার বহন করে বাংলা ভাষা। কবিতার কোনো ব্যাখ্যা হয় না। ভাষাই মানুষ। আর সেই ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহার কবিতায়। কিন্তু যে প্রসঙ্গটা বারেবারে আসে কবি কামাল চৌধুরীর কাব্যকৃতী নিয়ে আলোচ্য নিবন্ধে। তিনি একজন উচ্চপদাধিকারী রাজপুরুষ। কাজেই কবিতাকে শৌখিনতা হিসেবে নিতেই পারেন। পশ্চিমবঙ্গের একজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াকভস্কির কবিতা অনুবাদ করতেন। জনশ্রæতি, বর্তমান পদাধিকারীও নাকি কবিতা লেখেন। বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এরশাদও যে কবিকৃতির সাধক ছিলেন! দুই দেশের বাংলাভাষী এত মানুষ কবিতা লিখেও কবি হয়ে উঠতে পারেন না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর আছে কবি কামাল চৌধুরীর একটি পুরনো বক্তব্যে- যন্ত্রণাসম্ভব আত্মানুসন্ধান থেকেই কবিতার জন্ম।
এই কথা ঠিক যে প্রাচীন ঋষিদের বিস্ময় ঋকবেদের স্তোত্রে স্তোত্রে যে ভাবে ঘনিয়ে উঠছে কবিতায়, তা নেই শ্রীমদ্ভাগবতের সংশয়মোচনে। তাই যারা এই কবিসুলভ সংশয় ও বিপন্ন বিস্ময়ে ভোগেন না তাদের কাছে কবিতা শেষ অবধি অধরাই থেকে যায়।
কবি কামাল চৌধুরী কবিতাকে ব্যক্তির প্রেম-প্যাশন-পাপ-পুণ্য-বিস্ময়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখেন না। তার কাছে কবি এক অক্ষরপুরুষ। ‘এবার এখানে থামো, কিছু তৃষ্ণা মৃত্যু ডেকে আনে/ থামানো যাবে না তাকে, যে হৃদয় পুড়েছে আগুনে/ এ জন্মের পথ ভয়, জন্মে জন্মে কবি সিসিফাস/ পাথর সরিয়ে তাকে পেতে হবে ভোরের আকাশ’। এখানে তিনি নিজেই একাধারে ব্রহ্ম ও তথাগত। অক্ষরপুরুষ সকলেই হন না, কেউ কেউ হন। দুই বাংলাতেই তাই বহুসংখ্যক কবিতার কলমচি আড়ালে থাকেন। ভিড়ের মানুষ নন তিনি। ভিড়েও যেমন তিনি নেই, তার কবিতায় শব্দের ভিড়ও তেমন নেই।
‘ধ্বংস জমিদার বাড়ি, স্মৃতিচিহ্নে চড়ুই বসেছে/ তক্ষকেরা সুখী আজ, হিম শব্দে ডাকে অবিরত/ ইটগুলো খোয়া ওঠা, পরগাছা সমাধি ফলকে/ কার নাম লেখা আছে? এই প্রশ্নে বাউল বাতাস।’ এখানে কবি ছুঁয়ে যান শব্দ ও নৈঃশব্দের, অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের বিপ্রতীপতার বহির্ভূত আদিম এক অনুভূতিমালা। একদিকে যূথচারী হিংস্র সমাজ শাসন, অন্যদিকে সেই সমাজে থেকেও ভাষা এবং ছন্দ নিয়ে কবির বিবিক্ত, একক সাধনা। এই নীরবতা দেবতাদেরও আশঙ্কার হেতু। কারণ কবিই ভেদ করতে পারেন শব্দ আর নৈঃশব্দের মধ্যে সন্ধির রহস্য।
শুধু বাংলা কেন, পৃথিবীর সব ভাষার কবিই এই রহস্য হাতড়ে বেড়ান। ফরাসি পণ্ডিত রোলাঁ বার্তও তাই পরিষ্কার জানান, ‘আধুনিক কবিরা কবিতাকে স্বপ্নলব্ধ ভাষার ঐশ্বর্য ও নবীনতার আস্বাদনের কারণে ব্যবহার করেন।’ কবি কামাল চৌধুরী কী অসামান্য মুন্সিয়ানায় বিবৃত করেছেন- ‘চোখের সম্পাতে নীল; ফেনা ওঠা, প্রতিশব্দময়/ সাঁতরে এসেছে তীরে। ব্যক্তিগত কথোপকথনে/রাত্রিরূপ মর্ম-ঘ্রাণে ঢেউয়ে ঢেউয়ে পাথরে পাথরে/ ব্রতচারিনীর চুমু দিয়ে গেছে নাবিক পুরুষে’।
কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় বর্ণময়তা প্রচুর। শুধু বাংলা ভাষায় তার কাব্যসুবাস বন্দি থাকবে সেটাও কাম্য নয়। খলিল জিবরান থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ সবাই কিন্তু যার যার ভাষায় কবিতা লিখেই বিখ্যাত হয়েছেন। তবে এখন গণ্ডি থেকে বেরোতে প্রয়োজন কবিতার যোগ্য অনুবাদ। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে ভালো অনুবাদক নেই। দু-চারজন যারা আছেন তাদের সম্মান জানিয়েই বলছি কবিতার যে বিষয়গুলো আছে- রিদম, অন্ত্যমিল, উপমা সবকিছু কবি কামাল চৌধুরীর কবিতায় গতানুগতিকতার এতটাই বাইরে যে তাকে অনুবাদ করতে গেলে হয়তো কবিতাটা হারিয়ে যাবে, অনুবাদটা কেবল থেকে যাবে।
কবি কামাল চৌধুরী নৃতত্ত্বের ছাত্র। পিএইচডি করেছেন গারো উপজাতিদের ওপরে গবেষণা করে। তাই তারা ফিরে এসেছে তার কবিতায়। ‘গারোদের গ্রাম পাশে, গেরস্তালি ছোট বড় পাড়া/ হাল চষে, তাঁত বোনে, মশলা খায়- ভুলে গেছে জুম।/ব্যাপটিস্ট না ক্যাথলিক এই প্রশ্নে পাড়া ভাগ আছে/ তবুও মাটির ঘরে শোভা পায় মাধুরী সালমান’। স্বচ্ছন্দে তার কবিতার কাকচক্ষু জলে অবগাহন করা যায়। চারপাশে ঘটছে, ঘর আর বাইরের টানাপড়েন, ভালোবাসার দ্ব›দ্ব, জীবন আর মৃত্যু কবিতায় সবই আছে। সেই সঙ্গে আছে বেদনাবিধুর সেই মন যার হাতে ধুলোমুঠো ধরলে সোনামুঠো হয়।
চওড়া ফরম্যাটে এই বইটি প্রকাশ করেছেন পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়