তথ্যমন্ত্রী : টিআইয়ের রিপোর্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে

আগের সংবাদ

নীরব মহামারি অসংক্রামক রোগ

পরের সংবাদ

ছমদেল ডাকুয়া

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একূল ভাঙে ওকূল গড়ে
এই তো নদীর খেলা- আ-আ
হঠাৎ থেমে
হিস হিস হেইট হেইট বলে হাতের পেন্টিটা উঁচিয়ে দলছুট গরুটাকে দলে ভেড়ায়ে ফিরে আসে গাব গাছটার নিচে। বৈশাখের তপ্ত খড় রোদ। প্রায় শুকিয়ে যাওয়া পাগলা তিস্তার কোল পড়েছে কিনার ধরে। সেই খাল ডিঙ্গিয়ে গরু খেদায়ে ফিরে এসে গাছটার শিকড়ে বসে মনের রঙের সঙ্গে রঙ মিশিয়ে বাঁশি বাজায়। সে সুর বাতাসে ভেসে ভেসে চলে যায় অজানা মনের ভেতর! কখনো বা ঝিমুনি আসে দুচোখজুড়ে গাবের শীতল ছায়ায়। গরুগুলো আপন মনে খেয়ে খেয়ে বেড়ায় বালুকাময় চরের ঘাস। বেশ তরতাজা সেগুলো। বিহানো গাভীর বাছুরেরা আনন্দ চঞ্চলতায় ছুটে যায় এদিক ওদিক। যদি সঙ্গে সঙ্গে ফিরে না আসে মা গরুটাও যায় হাম্বা হাম্বা করতে করতে। এই যে মায়ার খেলা- বড্ড অদ্ভুত লাগে ছমদেল ডাকুয়ার।
তরতাজা কেবল কিশোরকাল পেরোনো এক যুবক। বাবার ষষ্ঠ পুত্র। মাংশল পেশিতে তাজাতুম্বা দেহের গড়ন। গায়ের রঙ কতকটা শ্যামবরণ হলেও চরের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই। চুলগুলো কোঁকড়া কোঁকড়া। আর গোঁফ! কাঁচির কারুকাজে একটা স্টাইল ফুটিয়ে তোলা!
বেশ শখ আছে ছমদেল ডাকুয়ার। বারুণীর মেলা থেকে নেয়া ছোট্ট চিরুনীটা প্যাঁচের মধ্যে রাখে সর্বদা। সঙ্গে ছোট্ট একটা আয়নাও। মন চাইলে আয়নাটায় দেখে দেখে চুল গুছিয়ে নেয় সে। ঘাড়ের গাছমাটা দিয়ে মুখ মুছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আয়নায়- কেমন লাগছে! পরখ করে বাতাসে উড়ে আসা চরের ধুলো চামড়ায় বসেছে কিনা! তবে কোনো নির্দিষ্ট মেয়ের মুখ মনের চোখে ভেসে ওঠে না কিন্তু!
অল্প দূরেই কয়টি বাড়ি নিয়ে একটি পাড়া। খুব একটা যাওয়া হয় না সেখানে। কিন্তু বাঁশির সুরটা যায়। আর সেই সুরটাই কাছে নিয়ে এসেছে ওপাড়াকে!
এক খণ্ড সুপাড়ি, একটা পান, একটু চুন ভরিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলে, নাতি চাবাও! সুপারি খাওয়ার কালসিটে পড়া দাঁত বের করে আধা ফোকলা হয়ে ওঠা দাদির হাসিটা দারুণ লাগে ওর। মনে হয় কত পাকালের চেনা! তারপর গল্প কথা- কত! কত! গরুগুলো লেজ নেড়ে আপন মনে খেয়ে বেড়ায়। কোনোটাতে রোদ লাগলে কোল ডিঙ্গিয়ে গাবের ছায়ায় বসে জাবর কাটে খানিক। মন চাইলে কোনোটার গায়ে মাথায় হাত বুলায় ছমদেল। দাদি বলে ওঠে- নাতি, তুই বড্ড মায়াবী! তোর মনের মইদ্যে কত্ত মায়া! কিছু খুঁজতে মুখমণ্ডল পরখ করে বলে, নাতি, তোরে যদি কাছের নাতি কইরে নিতে পারতাম! মাঝে মধ্যে সঙ্গে আসা বড় নাতনি আগ্রহ ভরে শোনে কখনো, কখনো বা না। যখন বিয়ে বিয়ে কথাটা শুনল আর বুঝতে পারল তখন ওর আসাটা একেবারে নেই হলো। সঙ্গে আসা শুরু হলো ছোটটার। তবে মাঝে মধ্যেই উচ্চারিত দাদির কথাটাকে আমলে না নিলেও সেটাই হয়ে ওঠে একদিন সত্যি! কে জানে, দাদির ছোট নাতনিটাকে ডাগর করে নিতে হবে বিয়ের অনেক দিন পর্যন্ত! প্রথম নাতনির সঙ্গেই তো হতো! সব ঠিকঠাক। কিন্তু রুদ্রমূর্তির পাগলা তিস্তা জমি- ঘর-বাড়ি খেতে খেতে প্রথম নাতনিটারেও খেয়ে ফেলল!
সেইদিন সকাল কেমন যেন থমথমা। তবে সারারাত পাগলা নদীর যে সর্বগ্রাসী গোঙানি তা অবশ্য অনেক কম। তবে খাবার পর যে ঢেকুর ছাড়ে তা আছে। কে জানে, নাতনিরে খেয়ে পেট ভারী হইছিল!
ছমদেলের সঙ্গে বিয়া পাকাপোক্ত। আসবে শুক্রবারে রাইতে জোড়া মিলান্তি। এই তো আর দুটা দিন। বাপের প্রথম বেটির বিয়া, তা কি নিরলে হইবে! যদিও তিস্তা ভাঙতে ভাঙতে চলে আসছে নিকটে। হোক দেখি কী হয়! যদি সমস্যাই হয় বেটিটারে পার কইরা দিয়াই ঘর সরানো হবে। নাতনির মুখে হাসির ফুল ফুটেছে। চঞ্চলতায় পেয়েছে। তাইতো একখানে থির থাকতে পারে না এক রত্তিও। রাতে দাদির সঙ্গে শোয়। ঘুম কি ধরে! মনের ধন্দে দাদিটাকে কখনো ছমদেল ডাকুয়া ঠেকে! বুকে জড়িয়ে আদর করতে করতে আনমনে বিরবিরিয়ে কয়, এবারে সোন্দর একখান কাপড়া চাই! হইবে, হইবে। ছোট বকনটা বেচিয়্যা তোরে নাল টুকটুকা একখান কাপড়া আনি দেমো! আলতা কুমকুন কে আনবো! আরো চিপে ধরে বলে, ঐট্যা কওয়া নাগে!- মনে হয় কইলজার মদ্যে ঢুইকা থাহি! মানুষ কি এত সোন্দর কইরা আদর করে!
ওই বৈতালী, তোর লাজ শরম ধুয়া খাচিস! মুই কি তোর ছমদেল! সর, সর-
ছটপট কইরা সকালেই নাতনি দরজা খুলে বেরোয়। দাদি ইয়ার্কির সুরে বলে, ওই বৈতালী ধাঙরটা আইচে নাকি রে তোরে নিবার! নাতনি হ বলে হাটন ধরে। রাতারাতিই যে এত কাছে নদী চলে আসবে, কে ঠাওর করতে পেরেছে! ওদের সুন্দরী গাইটার সদ্য জন্মানো বাছুরটা বেড়ার ফাঁক দিয়া বাইর হইয়া ছোটাছুটি করছে। ছুটুক। তাই বইলা নদী মুখে দে দৌড়! আরে আরে নদীতে বুঝি বাছুরটা পইড়ে যায়! পিছন পিছন নাতনিও দৌড়! বাছুর ভাবছে ও বুঝি ওরে ধরতে চায়। সে আরো ছুট-! তিস্তার পাগলা জলের বুঝি ক্ষুধা মেটে নাই! টেনে নেয়! বাছুরটা নদীতে পড়ল! এত বড় ক্ষতি! নাতনিও দে ঝাপ! পাকের মধ্যে পড়ে চিরতরে বাছুরের সঙ্গে হারিয়ে গেল নাতনি।
দাদি খানিক বাদেই উঠল। গাইটা হামলায়। দাদির অতটা গায়ে লাগে না। সে বাইরে যায়। নদী ভাঙতে ভাঙতে এত কাছে! নাতনিরে ডাকে। সাড়া নেই। আবারো ডাকে। সাড়া নেই। ভাবে, সত্যি সত্যি ছমদেল ডাকুয়া আইছিল নাকি! ডাকুয়া ফের ডাকাতি কইরা নিয়া গেল নাতো! দুডা দিনও ধৈর্য মানে না! মন হেসে ওঠে বলে, যায় যাউক! কত কি কইরা মত করাতি হইছে। অমন জুয়ান মরদরে হাতছাড়া করা যায়!
কিন্তু গাইয়ের হাম্বা ডাক তো বন্ধ হয় না। দাদি ফিরতে ফিরতে বলে, না দেহি গইলটায়, গাইটার কি হলো! বাঁশের চেবারির দরজাটা খুলে গাইটারে দেখে। সে দাদিরে দেখে আরো ছটফটানি করে হো-হো করে। দাদি ওকে জিগায় কি হচ্ছে রে! অত চিল্লাশ ক্যা! বাছুর কই! বলে সাতটা গরুর ভিতর খুঁজতে থাকে বাছুরকে। কি রে, কই গেলি মারে ছাইরা! আয় বেইরে আয় বলে তন্ন তন্ন করে গোটা গোয়ালটায় খোঁজে। কিন্তু বাছুরকে তো পেল না! এবারে জোরে কথা বের হয়। আউ বাছুরটা কেনা নাই! ছমদেলের হবু শাশুড়িকে শুনিয়ে বলে, কে গো বৌ, বাছুরটা কেনা নাই! তবে, নাতনির কথাটা চাপিয়েই থাকে। সবাই খুঁজে খুঁজে না পাওয়ার কৌতূহলে ত্রস্ত থাকে। বেলা হতেই ছমদেলের বাঁশির সুর ভেসে আসে। দাদির বুকে সে সুর ঢেউ তোলে! ভাবে নাতনিরে পাইয়া বাঁশি য্যান কতা কইতাছে! বলে, নাতি বেশিক্ষণ ওরে ধইরা থাকো না!
দাদি চলে আসে ছমদেলের কাছে। ছমদেল বাঁশি বাজা বন্ধ করে। হয়ে ওঠা দাদি থেকে আত্মীয় দাদি হবে, তাই সঙ্কোচে পেয়েছে। মাথা নিচু করে। দাদি হেসে বলে, কি নাতি জামাই, দেরি আর সয়ে না! বিয়া নাই হইতে ঘর গেরস্থালি! ছমদেল দাদির কাছে পান সুপারি চায়। দাদি বলে, ক্যা ওই দেয় নাই সাজাইয়ে! তবুও বুঝতে পারে না ছমদেল। বলে, কার কতা কও দাদি!
দাদি থুতনিটা ধরে ওপরে উঠায়ে বলে, ক্যান বিয়ানা যে গেল!
ছমদেল আশ্চর্য হয়! বলে, বিয়ানা গেল মানে!
দাদি হাসতে হাসতে বলে, আলকিটানি, না! সারারাত ছটফটানি কত! মন আর মাইন্ লোই না! আইত পোয়াইতে না পোয়াইতেই দৌড়! মুই তো ভাবছম নাতি জামাইর।
দাদি বলে থেমে দেয় ছমদেল। এবার বুঝতে পারে কার কথা! জিজ্ঞাসু চোখে বলে, কি হইচে খুইলা কও তো দাদি!
নাতনি নাই- আর ঢাকা থাকল না, ছড়ালো এদিক সেদিক। বাছুরও তো বেরোলো না! তিনদিন পরে সংবাদ এলো নদীতে একটা মেয়ে ভেসে যেতে দেখেছে! শুনে নদীর ভাঙা ভাঙা কিনার ধরে হবু বউয়ের খোঁজে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়েছিল ছমদেল। পেল না তার খোঁজ। শোকে বাবা মা দাদি অনেকটা পাথর হয়ে রইল। যদি মৃত্যুই হয়ে থাকে, অন্তত কেন কবরটা দিতে পারল না! গাইটাও এক সময় বুকে পাথর চেপে মুখ বন্ধ করে ফেলে।
ছমদেলের বাঁশিতে করুণ সুর। কানে পড়তেই হাহাকার করে ওঠে দাদির বুকের ভেতর। তিস্তার পাগলা ঢেউ তোলে সেথায়- য্যান দুমড়ে মুচড়ে ভেঙেচুরে নিয়ে যাবে! যাউক নিয়ে! দাদি কখনো সখনো বুক চাপড়িয়ে বলে, ভেঙেচুরে চর ফেলিয়ে দে, দে-
বেশ কিছুদিন দাদি আর পান সুপারি নিয়ে যান না ছমদেলের কাছে। বুকটা হাহাকার করে ওঠে! কিছুদিন গেলেই নতুন স্বপ্ন উঁকি দেয়- ছোটডারে দিয়া আত্মীয়তা জিইয়ে রাখা যায় কিনা! মায় বাপেরও মত আছে। কিন্তু বয়সের ফারাক যে বিস্তর!
ছমদেল এক সময় রাজি হয়। কিন্তু বাবা কোনোমতেই রাজি হয় না। তার কথা, ওই কুসাতি বাড়িতে হইব না। ওটা সুখ খাওয়া বাড়ি! মা দুর্বল হলেও বাবা কোনো মতেই রাজি হয় না।
ছমদেল বিয়ে করে ছোটটারে। বাপের বাড়ির ভাত উঠে যায় সত্যি সত্যি। বাপে মেনে নেয় না। এক পর্যায়ে লিখিতভাবে ত্যাজ্য করে ছমদেলরে।
সেই থেকে সংগ্রাম করে করে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে সে। কত কত ধরনের কাজে গতর খেটেছে! এখন খড়ি চেরাই করাটাকে বেশি পছন্দের। কেননা, দুটা পয়সা বেশি আসে এটাতে। গাছের ডুমে কুড়ালের চোট বসাতে বসাতে বলে, ওরে বিয়া কইরে ভালোই তো আছি। ডাগর হতে ছয় বছর গেছে। বাপ মায়ের ছইল বাপ মায়ের কাছেই আছিল। কোমড়ে প্যাঁচানো গামছাটা খুলে মুখ মুছতে মুছতে নখে গুনতে গুনতে বলে- প্যান, জামা, তেল হাবিজাবি যা যাবতীয় যা নাগে সউগ দিচি এই কামাই করিয়ায়! দ্যাশ বিদ্যাশ খাটছি। অবশ্যি শ্বশুর শৌড়ি বাইরত আর খাবার দেয় নাই যখন দেশত আইচনো। তারপর ফুল ফুটলে আল্লায় দিলে জাগা কিনি বাড়ি করনো, আবাদি ভুই একনা করনো, গরু আছে, দুই বেটিক বিয়া দিচি, বেটাক পড়বার নাকছি। তৃপ্তির সঙ্গে হো: শব্দ করে আরেকবার কুড়াল মেড়ে বলে, মাওকো চুপিচাপে টেকা, পান গুয়া দিয়া আচচিনো।
এবার খড়িতে কুড়াল মারা বন্ধ রেখে দূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। বলে, কপালের নেখা যায় না খান্দা! সেই শ্বশুর বাড়ি, গাবের গাছ, বাপের বাড়ি সউগ তিস্তার পেটট। দাদির নাতনির মতো অবস্থা! ভাি ঙ যেমন ফির জাগি চর হয় তার পত্তম নাতনি যায়া দ্বিতীয় নাতনি তেমন হামার ঘরত! হায়রে জেবন, কত কি দেকনো এ বয়সে!
আবারো হো: করে খড়িতে কুড়াল মারে। থেমে বলে, বাপে মরার আগে মাতা শোত্তেয়া যে দোওয়া দিচে তাতে মুই ত্যাজ্য করার থাকি অনেক কিছু পাইচম!

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়