চট্টগ্রামে রিকশা-বাসের সংঘর্ষে যাত্রী নিহত

আগের সংবাদ

ইসি গঠন বিল ‘তড়িঘড়ি’ পাস : বিএনপি ও জাপার তীব্র বিরোধিতা > সার্চ কমিটিতে থাকবেন একজন নারী সদস্য

পরের সংবাদ

নির্বাচন কমিশন আইন : মন্দের ভালো না ভালোর মন্দ?

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগদানের জন্য ব্যক্তিদের মনোনয়ন ও যাচাই-বাছাই করা হয়। এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেন। তারা সংবিধান অনুযায়ী শপথ নেন এবং দায়িত্ব পালন করেন। তাদের প্রতি চাকরিপ্রার্থীসহ মানুষের আস্থা থাকে বলেই তারা দায়িত্ব পালন করেন। সংবিধানে ১৩৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান এ সদস্যদের নিয়োগ দেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ হন সংবিধানের আলোকে। সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাদের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ প্রদান করেন। সংবিধান অনুসারে তারা শপথ নেন। বিচারের আসনে বসে তারা নিরপেক্ষভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করেন। মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেই তারা দায়িত্ব পালন করেন।
মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক পদটিও সংবিধান অনুযায়ী নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ১২৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ পদে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। শপথ গ্রহণ করে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সব হিসাব, নথি, দলিল, নগদ অর্থ, স্ট্যাম্পসহ সরকারি সম্পত্তি পরীক্ষার অধিকারী হন তিনি। রাষ্ট্রের এত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যিনি পালন করেন তাকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ও নির্মোহ হতে হয়।
উপরোক্ত চারটি পদ অর্থাৎ পিএসসির চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক আর মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদ হওয়ায় প্রজাতন্ত্রে এর চেয়ে নিরপেক্ষ ও আস্থাশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আর কোনটি কী হতে পারে?
এই চার সাংবিধানিক পদধারীদের নিয়ে যদি প্রজাতন্ত্রের কোনো নিরপেক্ষ ও যোগ্য লোক বাছাই করার দায়িত্ব দেয়া হয় সেটা অস্বাভাবিক বা বিতর্কিত হবে কেন? এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন?
প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন যদি সংবিধান হয় আর এই সাংবিধানিক পদে যারা অধিষ্ঠিত হন তাদের নিরপেক্ষ বলা যাবে না কেন?
বলছিলাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য আইনের যে খসড়া সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে তা নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার বিষয় নিয়ে। বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর বিরোধিতা তো করছেই, এনজিও করেন এমন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও সরকারের প্রস্তাবিত এই আইনের বিরোধিতা করা হচ্ছে।
সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। সংবিধানে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
স্বাধীনতার পর ৫০ বছর ধরে সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়ে আসছেন। সংবিধানে বলা আছে রাষ্ট্রপতি একটি আইনের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। কিন্তু কোনো আইন প্রণয়ন না করেই এই নিয়োগ হচ্ছে। আর ৫০ বছর পর এবারই প্রথম আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
অবশ্য এর আগের দুবার রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে, সার্চ কমিটি গঠন করে তাদের সুপারিশে প্রধার নির্বাচন কমিশনার ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেয়া হয়। ২০১২ সালে যখন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয় তাতে প্রথমবারের মতো উপরোল্লিখিত চারজন সাংবিধানিক পদধারীকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি একটি সার্চ কমিটি গঠন করেন। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান প্রথম এই সার্চ কমিটি গঠন করেন এবং তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যাতে বলা হয়েছিল ১০ কার্যদিবসের মধ্যে সার্চ কমিটি প্রতিটি শূন্যপদের বিপরীতে দুজন ব্যক্তির নাম সুপারিশ করবে। কমিটি তাই করেছিল এবং এর মধ্যে থেকে কাজী রকিব উদ্দিনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চারজন কমিশনার নিয়োগ করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কাজী রকিব উদ্দীন কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২০১৭ সালের ২৪ জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় সার্চ কমিটি গঠন করেন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ। তবে কমিটির পরিধি বাড়িয়ে দুজন বিশিষ্ট নাগরিক সংযুক্ত করে কমিটি করা হয় ৬ জনের। সেবারও রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেন। পরবর্তীতে সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাসহ অপরাপর কমিশনারদের নিয়োগ দেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রপতি ও সাংবিধানিক পদধারী ব্যক্তিগণের চেয়ে নিরপেক্ষ আর কাউকে বলা যাবে না। সেই নিরপেক্ষ ব্যক্তিরা যদি নির্বাচন কমিশন গঠন করেন এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আমার বোধগম্য নয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল আগামী নির্বাচন কমিশন সার্চ কমিটির মাধ্যমেই রাষ্ট্রপতি গঠন করবেন। আইন করা হবে না। বিশেষ করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিভিন্ন সময় বলে এসেছেন সময় স্বল্পতার কারণে সংসদে আইন পাস করা সম্ভব নয়। এ কারণে রাষ্ট্রপতি তার সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে অতীতের দুই মেয়াদের মতো নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। এজন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করেন। যদিও বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে অংশ নেয়নি। তবে যেসব দল সংলাপে অংশ নিয়েছে তারাও নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার পরামর্শ দেয়। ধারণা করা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ ও তাদের পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসে এবং আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অবস্থায় গত ১৭ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। যে বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আকস্মিকভাবে সরকার তার অবস্থান থেকে সরে এসে দ্রুততার সঙ্গে আইন করার উদ্যোগ নিয়ে নানা প্রশ্ন, সন্দেহ, সমালোচনা হতেই পারে। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও সরকার যে শেষ পর্যন্ত আইন করতে যাচ্ছে তার জন্য তো বাহবা পেতেই পারে।
কিন্তু তা না দিয়ে সরকারের এই অবস্থানের যে বিরোধিতা ও সমালোচনা করা হচ্ছে তাও বিভিন্ন এনজিওর কর্তাব্যক্তিরা করাছেন তা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত?
৫০ বছর ধরে যে আইন করা হয়নি সেই আইন যখন করা হচ্ছে সেটাকে সমালোচনা না করে বরং স্বাগত জানানো উচিত। কারণ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালোর মতো আপাতত আইনটি হোক। শুরু হোক। ভুলত্রæটি থাকলে ভবিষ্যতে সংশোধন করার সুযোগতো থাকছেই। প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানেইতো এ পর্যন্ত ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে। তা হলে সাধারণ আইন সংশোধন করার কোনো বাধা থাকবে বলে মনে করি না।
এটা তো সত্যি যে কোনো আইনই ‘পারফেক্ট’ নয়। ভুলত্রæটি থাকতেই পারে। প্রয়োগের ক্ষেত্রে ত্রæটি ধরা পড়লে সেটা সংশোধন হতেই পারে। যতবার দরকার পড়বে ততবার সংশোধন করা যাবে।
এ দেশে সংবিধান লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা হয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে সামরিক শাসন জারি করে রাষ্ট্র চালানো হয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটিয়ে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করাও সংবিধানে ছিল না। সংবিধান সংশোধন করে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তাও বাতিল করা হয়েছে। কাজেই সবকিছুই যে সংবিধান মতো হয়েছে বা হচ্ছে তা বলা যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হয়েছিল আবার সময়ের প্রয়োজনে হয়তো সেটা অসাংবিধানকও হয়েছে। কাজেই সংবিধানের আলোকে ৫০ বছর পর নির্বাচন কমিশন আইন যদি হয় তা যেমন জাতির জন্য অগ্রগতি তেমনি সময়ের প্রয়োজনে সেটা সংশোধনও হতে পারে, বাতিলও হতে পারে।
কাজেই আমি মনে করি, প্রস্তাবিত আইনটি করতে দেয়া উচিত। ভবিষ্যতেই দেখা যাবে এটা মন্দের ভালো না ভালোর মন্দ হবে।

শংকর মৈত্র : লেখক ও সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়