চট্টগ্রামে রিকশা-বাসের সংঘর্ষে যাত্রী নিহত

আগের সংবাদ

ইসি গঠন বিল ‘তড়িঘড়ি’ পাস : বিএনপি ও জাপার তীব্র বিরোধিতা > সার্চ কমিটিতে থাকবেন একজন নারী সদস্য

পরের সংবাদ

খাদ্যপণ্যের নৈরাজ্য দূর করতে হবে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সম্প্রতি অবসরে। তিন বছর আগে প্রধান খাদ্য চাল কিনেছি ৪৫ টাকা কেজি দরে। গত বছরে কিনেছি ৫৪ টাকা কেজিতে। এ বছরে দোকান-বিশেষে ৬৮-৭০ টাকা কেজি দরে। মূল্যবৃদ্ধির এই ক্রমান্বয় ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বুঝতে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। সহজেই বোঝা যায়। একজন নিরক্ষর মানুষও বুঝতে পারবেন।
‘অথচ আমার বেতন কি এই হারে বেড়েছে? আর এখন তো অবসর-ভাতা নির্ভর দুস্থ অবস্থা। সবচেয়ে বড় কথা, শুধু চাল না, বাড়ছে প্রতিটি প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম। এ অবস্থায় আমি কীভাবে সংসার চালাব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আমাকে বলে দেবেন কি? গণপ্রজাতন্ত্রের একজন নাগরিক হিসেবে এ প্রশ্ন কি আমি করতে পারি না? এ তো যুক্তিহীন প্রশ্ন নয়। আর এর জবাবও কি চাইতে পারি না? কারণ আমি তো সংসারযাত্রা সুতোর দুই প্রান্ত কিছুতেই মেলাতে পারছি না। কার কাছে সদুত্তর পাওয়া যাবে।’
উল্লিখিত কথাগুলো প্রত্যক্ষভাবে আমার নয়, পরোক্ষ বিচারে আমারও। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘনিষ্ঠজন, একান্তজন একাধিক ব্যক্তির কাছে শোনা অভিযোগের মর্মার্থ নিয়ে উক্ত কথিকাচিত্রটি রচিত- এর একটি শব্দ বা তথ্য বানানো নয়। তাছাড়া আমার জীবনযাত্রার কেনাকাটার হিসাব নিতে গিয়ে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই, ক্রেতাকে ধমকাই। কিন্তু সে কী করবে, বাজার তো তার হাতের মুঠোয় বা নিয়ন্ত্রণে নয়।
জীবনযাপনের প্রধান খাদ্য-উপকরণ চাল-ডাল, ভোজ্যতেল-নুন, হলুদ, জিরা, আদা থেকে কাঁচামরিচসহ রান্নাঘরের প্রতিটি প্রধান উপকরণের যুক্তিহীন, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঁচাবাজারের কথা না হয় বাদই দিচ্ছি। সেখানে এক ভুক্তভোগীর ভাষায়- আগুন। শাকের দাম তো আকাশছোঁয়া। একটি ফুলকপির দাম শুনলে মাথা ঘুরে যায়। অগত্যা পরিত্রাতার ভূমিকায় বাঁধাকপি- কিন্তু তা কি সবার মুখে সমান রোচে? কিন্তু কী করা যাবে। যাদের সংসারে পোষ্য সংখ্যা বেশি, তারা মহাবিপদে। কে ভাবে তাদের কথা?

দুই.
এই যদি হয় সাধারণ মধ্যবিত্তদের অবস্থা, তাহলে ভাবুন তো কেমন আছে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবর্গীয় শ্রেণির মানুষ, কিংবা দিনমজুর যারা দিন আনে দিন খায় এবং করোনা যাদের সর্বনাশ ঘটিয়ে ছেড়েছে। তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ত্রাণ সাহায্যের ওপর- সরকারি ও বেসরকারি। কিন্তু তাতে কি পেট ভরে?
ভোরবেলা কাগজ হাতে নিয়ে আমি তাই প্রথম পাতার ‘লিড নিউজ’ হেডলাইনগুলো পড়ে বাজার মূল্যের খবরাখবর ও প্রতিবেদনগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পড়ি। আর অবাক হই দেখে যে এমন কোনো খাদ্যপণ্য নেই যার দাম বাড়ছে না। আর ঈদের মতো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উৎসব উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ নির্দিষ্ট আইটেমের মূল্যবৃদ্ধি পাগলের মতো, লাগামবিহীন। মানুষ দিশাহারা।
গত কয়েক বছরে পেঁয়াজ, কাঁচামরিচের মতো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি তো ইতিহাস রচনা করেছিল যুক্তিহীন মুনাফাবাজিতে। পরে খাতুনগঞ্জে পচা পেঁয়াজ বিক্রি- সে আরেক ইতিহাস। এই দুর্নীতিবাজ-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের অমানবিক মুনাফাবাজি বাজার নিয়ন্ত্রণে এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে বছরের পর বছর। এরা এতই শক্তিমান যে এদের কাছে সরকারি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিব্রত, অসহায়। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
চাল নিয়েও কয়েক বছর ধরে যে ‘চালবাজি’ চলছে অটোরাইস মিলের মালিকগোষ্ঠীর প্রবল প্রতাপশালী সিন্ডিকেটের তা মজুতদারি-কালোবাজারি প্রভৃতি একদা কুখ্যাত শব্দগুলোকে লজ্জা দিচ্ছে। বাংলাদেশের একদা খ্যাত রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক শক্তি বাজার নিয়ে সিন্ডিকেটের খেলায় কোনো শক্তিমান প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ ঘটাচ্ছে না। তারা তাদের আনুষ্ঠানিকতা নিয়েও, পারফর্মেন্স নিয়েই সন্তুষ্ট।

তিন.
একমাত্র প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ গণমাধ্যম, সংবাদ-মাধ্যমগুলোতে। তারা তাদের সীমাবদ্ধবৃত্তে প্রতিবাদ বা বিচার-বিশ্লেষণ করে দায়িত্ব পালন করে চলেছে। একটি দৈনিক পত্রিকার চমকপ্রদ সংবাদ শিরোনাম : ‘অসহনীয় হয়ে উঠছে বাজার/সবকিছু নাগালের বাইরে’ (১৪.১.২০২২, সমকাল)।
স্বভাবতই ভুক্তভোগীমাত্রের প্রশ্ন : সবকিছু অসহনীয় ও নাগালের বাইরে হলে মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করবে কীভাবে? এ ঘটনা কিন্তু সাময়িক নয়, নিত্যকার। নিত্যদিন অস্বাভাবিক মূল্যের বিনিময়ে মানুষের জীবনযাত্রা কতদিন স্বাভাবিক পথ ধরে চলবে- এই অস্বাভাবিক সত্যটা কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখতে পাচ্ছেন না? ভাবছেন না অস্বাভাবিক সামাজিক পরিণামের কথা। সচেতন সংসদ সদস্যদেরও কি নজরে আসছে না এ নগ্ন সত্যের দিকগুলো?
সাংসদের তো বলা হয়ে থাকে জনস্বার্থের সেবক। তাদের কি চোখে পড়ে না বাজারের অস্বাভাবিক আচরণ এবং কারা এই আচরণের নেপথ্যে? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বাজার স্থিতিশীল করা, নিয়ন্ত্রণে রাখা কি তাদের দায়িত্ব তথা জনসেবার অন্তর্ভুক্ত নয়। সংবাদপত্রের ভয়ংকর খবরগুলো কি তাদের অগোচরে থেকে যায়।
ছোট অক্ষরে খবর- কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য কী ভয়ংকর পরিণামবাহী? যেমন পূর্বোক্ত প্রতিবেদনের ছোট শিরোনাম : ‘ভরা মৌসুমেও চাল ও সবজির বাজার চড়া।/ ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর চেষ্টা।’ আমরা ভুলে যাইনি ইতোমধ্যে ভোজ্যতেলের দাম কয়েক দফা বাড়ানো হয়েছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা নেই।
সূচনালগ্নে সয়াবিন তেলের সুলভ মূল্যের কারণে মানুষ পাগলের মতো সয়াবিনের দিকে ঝুঁকে এবং তা দীর্ঘদিন ধরে। ফলে সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীরা সয়াবিনের দাম যুক্তিহীনভাবে বাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে সয়াবিনের কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার খবর অনলাইন থেকে নানা মাধ্যমে প্রকাশ পাওয়ায় আমার জানাশোনা কয়েকটি পরিবার শর্ষের তেলের ব্যবহার শুরু করেছে সামান্য দাম বেশি সত্ত্বেও। আমিও ওই পথে।
আমি বরাবরই শর্ষের তেলের ভক্ত একাধিক কারণে। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের শর্ষের তেলে মবিল মেশানোর কারণে শর্ষেকে ত্যাগ করি দীর্ঘকাল ধরে, এখন আবার ঘরে ফেরা। মনে হয় সমাজের এ ঝোঁকটা বাড়বে। উল্লেখ্য, একটি দৈনিকের খবর-শিরোনাম : ‘বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার আতঙ্ক’ (কালের কণ্ঠ, ৮.১.২২)। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর : ‘সব চালের দাম বেড়েছে’। সাধারণ বাজার প্রবণতা, মোটা চালের দাম সর্বদা না বাড়া। এবার সরু, মোটা সবার দিকেই মিল মালিকদের লোভের থাবা।

চার.
চাল বাঙালির প্রধান ভোগ্য খাদ্যপণ্য- ঘটনা প্রবাদসম। হয়তো তাই মিল মালিকদের লোভের দৃষ্টি চালের দিকে দীর্ঘদিন থেকে। ফলে দুর্দশা বাড়ছে সবশ্রেণির মানুষের। এরপরও কি সরকার সঠিক নীতি গ্রহণ করে জনস্বার্থে মিল মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতার মোকাবিলা করবে না। আর আমাদের পড়তে হবে সংবাদ : ‘চাল দিয়ে লাভবান মিলাররা।’ কারণটা খুব স্পষ্ট।
ওই একই সংবাদে প্রকাশ : সরকারের ‘ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার ১০ শতাংশ’। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে, ব্যবহার করেছে মিল মালিকরা। চালের বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি চলে গেছে মিল মালিকদের হাতে, লাভের অঙ্কটাও একই পথে। যত কষ্ট ভাতখেকো সাধারণ শ্রেণির বাঙালির।
আমার মনে পড়ছে বহু বছর আগেকার একটি ঘটনা। সরকার যথাযথ মূল্যে গম না কেনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ফরাসি কৃষকদের বিপুল লাগাতার আন্দোলনের মুখে সরকারের নতি স্বীকার। বিশ্বের সর্বত্র মাঝে মধ্যে এ ধরনের ঘটনা দেখা যায়। সম্প্রতি ভারতে সংঘটিত কৃষক আন্দোলনের মুখে মোদি সরকারের পরাজয়। কৃষকস্বার্থ ও জনস্বার্থ পূরণে সঠিক নীতি গ্রহণ আমাদের সরকারের জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়