ঢামেকে আগুন আতঙ্ক, রোগীর স্বজনদের ছুটাছুটি

আগের সংবাদ

কড়া নির্দেশনা কার্যকরে ঢিলেমি

পরের সংবাদ

কী নির্দেশনা পেলেন ডিসিরা : জনগণের সেবক হতে হবে > খাদ্য নিরাপত্তা-বাজার স্থিতিশীল রাখা > সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : জনকল্যাণমুখী, দক্ষ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিভিন্ন নির্দেশনা নিয়ে কর্মস্থলে ফিরলেন জেলা প্রসাশকরা। রাজধানীর ওসামানী স্মৃতি মিলনায়তনে গতকাল বৃহস্পতিবার শেষ হয় জেলা প্রশাসকদের তিন দিনব্যাপী সম্মেলন। এই সম্মেলন থেকে জনগণের ‘সেবক’ হওয়ার মানসিকতাকে আরেকবার শানিত করে নিতে পেরেছেন তারা। পেয়েছেন ভয়-ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও করোনা মোকাবিলার উদ্দীপনা। মাঠপর্যায়ের নানা অসঙ্গতি, প্রতিবন্ধকতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে পেয়েছেন সমাধানের পথ নির্দেশ।
গণভবন থেকে গত মঙ্গলবার সকালে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে জেলা প্রশাসকদের ২৪টি নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিজেদের ‘জনগণের খাদেম’ ভাবার পরামর্শ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনাদের জনগণের সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। এখন থেকে অতীতের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তন করে নিজেদের জনগণের খাদেম বলে বিবেচনা করতে হবে।’
জেলা প্রশাসকদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ ২৪টি নির্দেশনা দেন সরকারপ্রধান। এসবের মধ্যে ছিল, করোনা মোকাবিলায় সরকারি নির্দেশনাগুলো মাঠপর্যায়ে যেন সঠিকভাবে প্রতিপালন হয়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও মুজিববর্ষের কর্মসূচির যথাযথ বাস্তবায়ন ও ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা, খাদ্য নিরাপত্তা, বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখা প্রভৃতি।
তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার নির্দেশনাও দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব প্রভৃতি রোধ, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রাখা, উগ্রবাদ ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলেন।
অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ মাঠ প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন।

সম্মেলনের প্রথম দিন সন্ধ্যায় তিনি বঙ্গভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যোগ দেন। আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিটি স্তরে দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করা হয় উল্লেখ করে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, দায়িত্ব সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ অত্যাবশ্যক, কিন্তু ক্ষমতার যাতে অপপ্রয়োগ না হয় তা নিশ্চিত করা আরো বেশি জরুরি। কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব ও ক্ষমতার পার্থক্য সচেতনভাবে বজায় রাখারও তাগিদ দেন রাষ্ট্রপতি।
নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রপতি ডিসিদের আবাসন, শিক্ষা, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, চিকিৎসাসেবা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে আধুনিক শহর-উপশহর গড়ে তোলার নির্দেশনা দেন। রাষ্ট্রপতি ভূমি ব্যবস্থাপনা, প্রকৃতি সংরক্ষণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব দেন। মাদকের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আবদুল হামিদ বলেন, মাদকদ্রব্য যাতে দেশের প্রাণশক্তি যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে না দেয়- সেদিকেও ডিসিদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ৮টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিন প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি সরকারি সেবা তৃণমূলে পৌঁছে দিতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন। স্পিকার বলেন, দেশে যে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চলছে তা বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকরা সরাসরি কাজ করছেন। এর সফলতা বহুলাংশেই তাদের ওপর নির্ভরশীল। তাই জেলা প্রশাসকদের এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
অন্যদিকে, কৃষিপণ্য বহনে পথে পথে চাঁদাবাজি বন্ধে ডিসিদের সহযোগিতা চান কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, সারা পৃথিবীতেই মধ্যস্বত্বভোগী আছে। কিন্তু এখন যেটা হচ্ছে তা অপ্রত্যাশিত। ঈশ্বরদী কিংবা সাতক্ষীরায় চাষিরা ফসল বিক্রি করে ১৫ টাকায়। ঢাকায় এসে সেটা কেন ৪০ থেকে ৪৫ টাকা হবে? এগুলো দেখতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন তিনি।
রমজানে দ্রব্যমূল্য ঠিক রাখতে কঠোরভাবে তদারকির জন্য ডিসিদের নির্দেশনা দেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, ডিসিদের বলেছি সামনে রমজান মাস আসছে, কিছু কিছু জিনিসের দাম আমরা ঠিক করে দেই। সেগুলো কঠোরভাবে তদারকি করতে। সে সময় যেন তারা খুব শক্ত ভূমিকায় থাকেন, আইনগত ব্যবস্থা যেন নেন। কুরবানির সময় চামড়া কেনাবেচার বিষয়টি যেন তদারকি করেন। কেউ যাতে দাম থেকে বঞ্চিত না হন।
সার চোরাচালান ঠেকাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তিনি বলেন, সার চোরাচালান যাতে না হয় এবং ডিলারদের কাছ থেকে অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে নিতে না পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। মজুত ঠিক আছে কিনা এবং সঠিকভাবে তা বিতরণ করছে কিনা ডিসিরা তা দেখবেন। যেসব ডিলার ভুয়া কাজ করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।
অন্যদিকে, পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে জেলা প্রশাসকদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার নির্দেশ দেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। তিনি বলেন, পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে গেছে। ডিসিদের বলেছি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার জন্য। উপজেলায় প্রতি মাসে দুটি করে এবং বিভাগীয় ও জেলা শহরে মাসে অন্তত একটি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন। যাতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হয়। এছাড়া ১৯টি পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। বিষয়টি ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা সে বিষয়েও ভ্রাম্যমাণ আদালত চালাতে ডিসিদের অনুরোধ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ও থেকেও বিষয়টি নজরদারি করা হচ্ছে।
সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঠিকভাবে সম্মান দেয়ার নির্দেশনা দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অনেক সময় সেই ধরনের সম্মান দেয়া হয় না। যেহেতু তারা নির্বাচিত হয়েছেন, কিছু অঙ্গীকার করেছেন, সেগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতে ডিসিদের আরো সংবেদনশীল হতে বলা হয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ হয় না।
প্রবাসীদের প্রতিও সংবেদনশীল হতে ডিসিদের আহ্বান জানান তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রবাসীরা অভিযোগ করেন, তারা ঠিকমতো পাসপোর্ট পান না, পুলিশের ছাড়পত্র হয় না। সময়মতো বিবাহসনদ, জন্মসনদ দেয়া হয় না। অনেক সময় দেশে আসলে হয়রানি করা হয়। তাদের ভূমি অনেকে বেদখল করে ফেলে। এসব বিষয়ে সতর্ক থাকতে ডিসিদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহার বন্ধে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে তা তদন্তের জন্য নির্ধারিত সেলে পাঠাতে হবে। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। মন্ত্রী আরো বলেন, আইনটি করা হয়েছে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য, বাকস্বাধীনতা হরণের জন্য নয়। জেলা প্রশাসক সম্মেলনের তৃতীয় দিনের দ্বিতীয় অধিবেশনে এসব কথা বলেন তিনি।
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে এককালীন অর্থ বরাদ্দ চেয়ে করা জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রস্তাবে সায় দেয়নি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বলেন, আলোচনার সময় জেলা প্রশাসকরা প্রস্তাব রেখেছেন, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য আমরা এককালীন অর্থ বরাদ্দ দিতে পারি কিনা। আমরা সেখানে দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি দুই বা তিন কিস্তিতে দিলে কাজের গতি ঠিক থাকে। কাজের মনিটরিং ভালো হয়, কাজের ফলাফল ভালো হয়।
অন্যদিকে, নদীর নাব্য রক্ষা, অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ, দূষণ ও দখল রোধে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) তৎপর হতে বলেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি জানান, নদী রক্ষা জেলা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক। তারা অনেক ভূমিকা রাখছেন এবং এগুলো আরো জোরদার করতে বলা হয়েছে। এছাড়া বন্দরগুলোতে অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকদের আরো নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে, গতকাল শেষ দিনে সেনা প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে। অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের প্রচলিত যে দায়িত্বগুলো পালন করে, সেগুলো পালনের ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি নিজেই এখানে এসেছি এটা ইনডিকেট করে, আমি এটাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা সোনার বাংলা গড়ার যে অভিষ্ঠ লক্ষ্যে এগোচ্ছি, সেখানে সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে বেসামরিক প্রশাসন যদি একসঙ্গে কাজ না করে, তবে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহও শেষ দিনে বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক সম্মেলনে। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেলা পর্যায়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে ডিসিদের প্রতি আহ্বান জানান। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ডিসিরা জানেন তাদের অফিসের কোথায় দুর্নীতি হয় বা হওয়ার সুযোগ আছে। মাঠপর্যায়ে তাদের জানাশোনা থাকে। আমরা তাদের অনুরোধ করেছি দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে চলতে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়