ঢামেকে আগুন আতঙ্ক, রোগীর স্বজনদের ছুটাছুটি

আগের সংবাদ

কড়া নির্দেশনা কার্যকরে ঢিলেমি

পরের সংবাদ

কবি মুশাররাফ করিম তর্পণ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ষাটের অন্যতম কবি-কথাসাহিত্যিক মুশাররাফ করিমের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস ছিল গত ১১ জানুয়ারি; তার অগণন অনুসারী, আত্মীয়-পরিজন ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি দুই বছর আগে; তার বিদায়ে আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা সহজে পূরণ হবার নয়। তবুও বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই আমাদের বলতে হয়েছে, বিদায় হে স্বপ্ন সারথী, চির বিদায়। তুমি ‘সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে এসে তার ইচ্ছেতেই ফিরে গেছো তারই আশ্রয়ে।’ দুই বছর আগে সেদিন, রাত সাড়ে দশটা থেকেই কবির আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব-গুণগ্রাহী আর অনুগামীরা এসে এসে শেষ বারের মতো কবিকে দেখে ফিরে গেছেন। রাত বেড়েছে, শৈত্যপ্রবাহের প্রতাপ বেড়েছে; শব দেহের পাশ থেকে ভিড় কমে গেছে; রাত গভীর হলো। শীতে যখন সবাই প্রায় পলাতক; তখনো কবি একাকী শীত উপেক্ষা করে শবাধারে শুয়ে। প্রাণ-স্পন্দনহীন শরীরে শীতের প্রভাব নেই, তাই? কখনো কখনো কবি একা হয়ে যাচ্ছেন নিজের সাথে; তারপরও দু’চার জোড়া ঘুমে ঢুলু চোখ লক্ষ রাখছে কবির কফিনের দিকে; অবিবেচক কোনো ইতর প্রাণী যদি কবিকে স্পর্শ করে সে-ও এক ভয়। না, কোনো ইতর প্রাণী আসেনি কবির কফিনের কাছে; কেবল সারারাত জুড়ে শীত এসেছিল আর কুয়াশারা তাকে জাপটে ধরে ছিল। কবির একজন অনুসারী অতন্দ্র চোখে মাঝে মাঝে কবির মুখের উপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দেখে নিতে চাইছে, কবির আরো কিছু কথা বাকি রয়ে গেল কিনা? কবির চোখ সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, ঠোঁটে মৃদু হাসি যেনো বলছে, ‘কবিকে চেনা অতই সহজ! কোন বাটখারায় তুলে ওজন করতে চাও তোমরা কবিকে? তোমাদের বাটখারার শরীর সুস্থ আছে তো? দেখো, তোমার বাটখারা দুর্বল হলে কিন্তু ছিঁড়ে পড়বে। অতঃপর দোষী করবে কবিকেই। তোমরা তো কেবল কবির পঙ্ক্তি ব্যাবচ্ছেদ করতে চাও নিজের অসুস্থ চিন্তায়। একজন কবিকে কবির উচ্চতায় রেখে যদি বিবেচনার সাধ্য তোমার না থাকে, তবে কেন কবির মূল্যায়ন করতে আসা বাপু?’ কবির কথা শুনতে শুনতে তার অতন্দ্র চোখে হঠাৎ তন্দ্রা নেমে আসে। গা ঝাড়া দিয়ে এবার কবিকে নিয়ে ভাবে। কবির প্রয়াণ রাতের স্মৃতি এমনই ছিল। দুই বছর পর আজ আবার কবির স্মৃতিতর্পণ।
মুশাররাফ করিমের জন্ম ১৯৪৬-এর ৯ জানুয়ারি ময়মনসিংহে; কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কিছু কিশোর উপন্যাস, গল্প এবং উপন্যাস। কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘পাথরের সাথে কথা’, ‘অন্য এক আদিবাসে’, ‘সে নয় সুন্দরী শিরিণ’, ‘কোথায় সেই দীর্ঘ দেবদারু’, ‘নিবেদনের গন্ধঢালা’, ‘অন্তরের ব্যাকুল ব্যাধি’, ‘কে আছে, কেউ কি আছে’, ‘বিরিশিরি গীতিকা’, ‘যদি একবর্ণও মিথ্যে বলি’, ‘বর্তমানে আছি একাকী, বান্ধবহীন’, ‘কোন গাছ নেই নিকট সন্নিধানে’, ‘সকল বাড়ি তোমার জন্যে আকুল’, ‘বিরিশিরি, তোমার লাবণ্যে’, ‘রমনীর সৌন্দর্যের থেকেও আরও দুর্নিবার’, ‘সুদূর সুন্দরে’, ‘অরণ্যের সেরেনাদ’, ‘তপতী সিরিজ’, ‘কী কবে কহ’, ‘উলঙ্গ তামাশা’ ইত্যাদি। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তার ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ এবং ‘কবিতা সমগ্র’। ময়মনসিংহের কাব্যাঙ্গনে মুশাররাফ করিম সয়ম্ভু এবং সর্বব্যাপী হলেও বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে প্রায় নিঃশব্দ; যে কারণে মুশাররাফ করিম প্রথমত এবং প্রধানত কবি হলেও বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান তিনি শিশুসাহিত্যে। বেশ কিছু কিশোর উপন্যাস লিখলেও কবিতায় বিস্তৃতি তার বহুদূর; বিশেষত একই বছর তার সাথে যিনি কবিতার জন্য পুরস্কার প্রাপ্ত হন তার তুলনায় তো বটেই। মুশাররাফ করিমের কবিতায় সমাজ সচেতনতা এবং রাজনীতিমনস্কতা প্রধান উপজীব্য। মুশাররাফ করিমের কবিতায় যেমন গ্রামীণ জীবনের কাদামাখা শব্দের সফল ব্যবহার দেখি, তেমনি তার কবিতায় বিষয় হয়ে উঠে আসে যে কোনো সাধারণ অনুষঙ্গ। ‘নিকারী মারে খেছ’ \ ‘হাঙ্গামা-হুজ্জুতের চেয়ে শান্তি মিছিল’ \ ‘দেখবে মুহূর্তে সব লণ্ডভণ্ড, মিসমার’ \ ‘হিজড়ের সাথে নিতম্ব দুলিয়ে করে উলুম্বুস নৃত্য’ \ ‘অনিচ্ছা সত্ত্বেও দিল দুধভরা তার মা’র দুটি বুনি’ \ ‘হাতে হউলের পোনা ঝুলিয়ে যখন ফেরে সে ঘরে’ \ ‘দস্তার কড়াই ভরে সিদ্ধ হোক রূপশালী ধান;/ ঢেঁকির পাড় থেমে গেলে ভাতে উঠুক বলক/ বাতাস ভরে যাক সালুনের গন্ধে।’\ ‘গণ্ডগ্রামের আলাভোলা কিশোর/ সে বেঁধেছিলো কোমরে কার্তুজ;/ মালকোচা দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো প্রকাশ্যে’ \ লোকশব্দের এমন যুৎসই প্রয়োগ যে কোনো পাঠককে চমকিত করে।
মুশাররাফ করিমের কবিতার কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যায় তার সমাজ সচেতনতার কথা, মনে মনে আওড়ে নেয় কবির কবিতা-
ঢোল-পিঁপড়ের ডিমে কুকিস বিস্কুট ভেঙ্গে
ফেলে মনোলোভা টোপ,
বিশুদ্ধ বাতাস ভারী হয় সুগন্ধি চারাতে,
আহ্লাদে নাচতে নাচতে ছুটে আসে ঝাঁকেঝাঁকে
রূপালী শরীর।
ফাৎনায় পড়ে টান- নিপুণ নিকারী মারে খেছ
কানকোর পাশে বাঁকানো বড়শি গিঁথে
ধরা পড়ে নির্দোষ রোহিত।

এই দেশ মৎস্য ভোগীর, এখানে সারা বছর মাছ ধরা চলে,
যদি বিনোদ বিহারী চলে যায় কাতলের লাশ হাতে
শের মামুদ সেখানে এসে ছিপ ফেলে বসে।

সাগর দীঘির মাছেরা এমন কাণ্ডই দেখে আসছে চিরকাল।
(সাগর দীঘির মাছেরা \ অন্য এক আদিবাসে)
শরীর শিউড়ে ওঠে শীতে; জানুয়ারির এই শৈত্যপ্রবাহে মনে পড়ে যায় কবির শীতে কী ভয় ছিল! অথচ খোলা আকাশের নিচে পড়ে ছিলেন কবি সারারাত; কবির শীতের কথা ভেবে সেদিনই নির্ঘুম রাতে অন্য এক কবি লিখছেন কবির উদ্দেশে শীত কাতরতার পঙ্ক্তিমালা-
শীতে ভয় ছিলো, আর শীতল জলেও খুব।
ভয় নিয়ে তামাশা করার প্রবণতা ছিলো, শীতে যেনো জলাতঙ্ক,
পরিযায়ী পাখি উড়ে এসে ঝিলে দিতো ডুব।
আর তুমি পাশে বসে পানকৌড়ির ডুব সাঁতার ভেবে হয়ে যেতে চুপ!
আমাদেরও কিছুটা শীতকাতরতা আছে, তাই
নানা অজুহাতে-ছল-চাতুরিতে আত্মরক্ষা করে পলকে পালাই,
বুকে রাখি স্বদেশী সঙ্গীত;
এই শৈত্যপ্রবাহের রাতে খোলা আকশের নিচে
তোমায় একাকী রেখে চলে আসা কি উচিত?
ভেবে হয়েছি অবাক, বুক ভেঙে যায়,
শীতে তোমার কতটা ভীতি জানি, জেনেছি শীতার্ত গীত;
তবুও না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছো উপেক্ষা করে শীত।
অতঃপর সারারাত কুয়াশার সাথে তোমার কী কথা হবে
জানবে না পৃথিবীর কেউ; এবং এসব অপ্রকাশিত কথামালায়
কারো কোন দিন হবে না কবিতা লেখা;
যেমন কুয়াশা ঝরারও থাকে কিছু অব্যক্ত নিরীহ রেখা।
যখন নগরী শীতের তীব্রতা ভেবে ভীত, আর তুমি
ভয়ের খোলশ ভেঙে শীত গায়ে মেখে পড়ে রইলে
আঙিনায় খোলা আকাশের নিচে;
তোমার এ স্পর্ধা কে শুনেছে কবে নিজের বিপক্ষে কখনো কখনো
মানুষের সটান দাঁড়াতে হবে, সমুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়ালে যেমন জাগে
প্রত্যয় সী-বীচে।
তুমি আমাদের কাব্য-পথিকৃৎ, তোমার কাছে শিখেছি কবিতার পথে হাঁটা,
এবার কি শীত ভেঙে হাঁটাও শেখালে নিজের কৌশলে?
অতঃপর জানা হবে একই পথের পথিক হবার অপেক্ষায়
কে কোথায় আছে মৃত্যুর সত্যকে ভুলে থাকিবার খেলাচ্ছলে।
(শীতকাতর কবির জন্য এলিজি \ ১১ জানুয়ারি ২০২০)
মানুষ সবাইকে নিয়ে তর্পণে বসে না; বসে নিজেদের প্রয়োজনে; যিনি চলে গেছেন তিনি তো সমস্ত প্রয়োজন পেছনে ফেলেই চলে গেছেন; তাকে আর কেন স্মৃতি তর্পণের নামে ডেকে আনা? সেই প্রশ্নের মীমাংসা করতেই বলি, তার স্বপ্নগুলো পৃথিবীর বাতাসে আজো ঘুরে বেড়াচ্ছে; আজো তার স্বপ্ন ধার নিয়ে আমাদের সংকীর্ণতা দূর করার অবকাশ আছে; কীভাবে মানুষের মাঝে ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়া যায়, সে কথা তার জীবন পাঠে জেনে নেয়ার আবশ্যিকতা আছে। যারা নতুন প্রজন্মের কবি, তাদের কবিতা নির্মাণ কৌশল শিখতে মুশাররাফ করিমে দ্বারস্থ হবার প্রয়োজন আছে; সামান্য প্রসঙ্গকে কী করে অসামান্য কবিতার অনুষঙ্গ করে তোলা যায়, তা শিখে নিতেও তাকে পাঠের আবশ্যিকতা আছে; পাথরেও কী করে ফুল ফোটানো যায়, সে কলা জেনে নিতেও তার কাছে পৌঁছা প্রয়োজন। এসব কথা উচ্চারণের জন্যই স্বতন্ত্র, পরম্পরা ও বাতর সাহিত্যপত্রের আয়োজনে কবি শামসুল ফয়েজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কবির স্মৃতি তর্পণে সমবেত হয়েছিলেন বিভিন্ন প্রজন্মের কবিরা; কবিপতœী সখিনা আখতার এবং কবিকন্যা নাফিছা মাহজাবিনও অংশ নেন স্মৃতি তর্পণে; অতিথি হয়ে কবির স্মৃতি তর্পণ করেন কবির দীর্ঘ কর্মজীবনের সহযোদ্ধা কবি-নাট্যকার ফরিদ আহমদ দুলাল। নিবেদিত কবিতা পাঠে অংশ নেন- জেবুন নেছা রীনা, সরকার আজিজ, নাজমা মমতাজ, শাহীদা হোসে রীনা, সালমা বেগ, সাজ্জাদুল কবীর, রহমান হাবীব, রুবীনা আজাদসহ প্রায় অর্ধশত কবি। কবির বাসভবনের ছাদে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি শামীম আশরাফের সার্বিক পরিচালনায় বাক্সময় হয়ে ওঠে স্মৃতিতর্পণের বেদনায়; কবিকে বারবার স্মরণের আবশ্যিক ব্যঞ্জনায়। কবিকে স্মরণ করে আমাদের দুর্যোগকালীন শীত-কাতরতা দূর হয়ে যাক। আমরা শুদ্ধ কবিতায় অবগাহনের পাশাপাশি সবাই সদাচারী হয়ে উঠি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়