কাগজ প্রতিবেদক : মাঠ প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। দুর্নীতির কারণে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই মাঠ প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলনে বঙ্গভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতিটি স্তরে দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। দায়িত্ব সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য ক্ষমতা প্রয়োগ অত্যাবশ্যক। কিন্তু ক্ষমতার যাতে অপপ্রয়োগ না হয়, তা নিশ্চিত করা আরো বেশি জরুরি। এ সময় কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব ও ক্ষমতার পার্থক্য সচেতনভাবে বজায় রাখারও তাগিদ দেন তিনি।
জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ে প্রশাসনে বিরাজমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং নাগরিক সেবাদানে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কে আলোচনার জন্য জেলা প্রশাসক সম্মেলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। আপনারা মাঠপর্যায়ে সরকারের বিভিন্নমুখী কার্যক্রমের সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যা সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমরা ও আপনারা জনগণের সেবক। তাই জনগণের সেবক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করবেন। জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেবেন। জনগণকে সেবাদান কোনো দয়াদাক্ষিণ্য বা বদান্যতার বিষয় নয়। মনে রাখতে হবে, জনগণের টাকায়ই আমাদের সংসার চলে। তাই সেবা পাওয়াটা জনগণের অধিকার।
আব্দুল হামিদ বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি একটি কার্যকর মাধ্যম। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের দরিদ্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, সামাজিক সুরক্ষা এবং জনগণের, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ডিসিদেরকে কার্যকর নেতৃত্ব দিতে হবে। প্রকৃত দরিদ্ররা যেন এই কর্মসূচির সুফল ভোগ করতে পারেন, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকদেরকে সচেষ্ট হতে হবে।
তিনি বলেন, পরিবেশবান্ধব গ্রাম উন্নয়নের দিকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। যা বিগত বছরগুলো থেকে আলাদা। শহরের মতো গ্রামগুলোয়ও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। মফস্বল এলাকায় নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে ডিসিদের আবাসন, শিক্ষা, কৃষিনির্ভর শিল্পের প্রসার, চিকিৎসাসেবা, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানীয় জল ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে উপজেলা সদর ও বর্ধিষ্ণু শিল্পকেন্দ্রগুলোকে আধুনিক শহর-উপশহর হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগী হতে হবে।
ভূমি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা খুব বেশি ও সরাসরি, যা গ্রামীণ বিরোধ ও মামলা-মোকদ্দমার অধিকাংশ জমিজমা-সংক্রান্ত উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, সরকার দক্ষ, আধুনিক, জনকল্যাণমুখী ও টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং ভূমিসংক্রান্ত জনবান্ধব সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে জনগণকে ভূমিবিষয়ক সেবাদানের জন্য ডিজিটালি কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু ভূমি রেকর্ডের সময় একশ্রেণির অসাধু কর্মচারী স্থানীয় প্রভাবশালী দালাল চক্রের সহযোগিতায় অনেক অনিয়ম করছে এবং অবৈধ সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে জনভোগান্তি বেড়েছে। এসব ব্যাপারে ডিসিদের কঠোর হতে হবে। যে কোনো অনিয়ম বন্ধ করতে আপনারা শক্ত পদক্ষেপ নেবেন। এ কাজে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সরকার তথ্য অধিকার আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে, সরকারি তথ্য ও সেবা নাগরিকের জন্য সহজলভ্য করার লক্ষ্যে জেলা ই-সার্ভিস সেন্টার, পৌর ডিজিটাল সেন্টার ও ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করেছে। এ সেবা কেন্দ্রগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে ডিসিদের জোরালো ভূমিকা রাখার পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি সেবাকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সামাজিক বনায়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন, জলাভূমির উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের চলমান কর্মসূচি বাস্তবায়নে ডিসিদের আরো সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, দেশের উন্নয়ন সুষম ও জনমুখী করতে জেলা ও উপজেলা সদরে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে বন, নদী ও পাহাড় রক্ষা করতে কঠোর হতে হবে।
মাদকের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, মাদকদ্রব্য যাতে দেশের প্রাণশক্তি যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে না দেয়, সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে একটি সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আমার বিশ্বাস, আপনাদের মেধা ও দক্ষতা জনকল্যাণের লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে যথাযথ অবদান রাখবে। আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে দেশাত্মবোধ ও একাগ্রতার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে যাবেন। নবতর উদ্ভাবনী চর্চা ও সেবামূলক কর্মপ্রয়াসের দ্বারা আপনারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাবেন, এটাই সবার প্রত্যাশা।
রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন লালিত স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত একটি প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, আধুনিক ও অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এর মধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ২০৩০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ এসডিজির সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সক্ষম হবে এবং ২০৪১ সালে উন্নত অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে।