অধ্যাপক সাইদা হত্যা : গ্রেপ্তার আনারুলের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর

আগের সংবাদ

রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সংলাপ : নির্বাচন কমিশন গঠনে ৪ প্রস্তাব

পরের সংবাদ

ওমিক্রন এবং ব্রিটেনের প্রশ্নবোধক স্বাস্থ্যসেবা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত দুই বছর থেকে সারা পৃথিবীর পিছু ছাড়ছে না মহামারি। মহামারি করোনায় এ পৃথিবীর প্রায় সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে থেকেছেন শঙ্কায়, ছিলেন আতঙ্কগ্রস্ত। অধিকাংশ মানুষই কেউ না কেউ হারিয়েছেন নিজস্ব কাছের মানুষ কিংবা স্বজন। কষ্টের পাথর ফেলে তবুও হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্বজনরা ফিরে আসছেন আবারো জীবনের পথচলায়, স্বাভাবিকত্বে। আমি-আমরা অনেকেই দেখেছি, বড় কাছাকাছি জীবনের এই সংকট সময়।
হাসপাতালে বসে আমিও আমার এক স্বজনের শেষ সময়ের প্রহর গুনেছি। নার্স এসে যখন বললেন, প্রচণ্ড যুদ্ধ করেছেন তিনি, তার সব শক্তি দিয়ে, কিন্তু একে একে শরীরের প্রতিটি অর্গানে করোনার কাঁটা বিদ্ধ করেছে তাকে জোরে, বড় জোরে। যে কোনো সময় তিনি হারিয়ে যাবেন চিরতরে। একজন মানুষের চলে যাওয়ার শেষ ক্ষণটুকু গুনছিলাম, আমরা তার স্বজনরা। কেউ কারো দিকে তাকাইনি। চোখ থেকে বেরুচ্ছিল সবার বেদনার বাষ্প নীরব নিদারুণ হাহাকারে। তার স্ত্রী বসেছিলেন পাশে, কোভিড আক্রান্ত রোগীদের কক্ষে, মেয়ে দুজন দুটি চেয়ারে পাশাপাশি, সবাই ছিলেন কোনো আশা ছাড়াই, বসেছিলেন শুধু শেষ নিশ্বাসটুকু দেখার জন্য। কারণ নার্স-ডাক্তার তাদেরও সেই একই কথাই বলেছিলেন। তারপর যখন আমরা তাদের বেরিয়ে আসা দেখলাম, বুঝলাম এক সময়ের ঝরঝরে প্রচণ্ড আড্ডাবাজ আশির দশকের প্রথম দিকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রাণখোলা তরুণ, আমার অগ্রজ আলমগীর চৌধুরীকে আমরা আর ফিরে পাব না। বুকফাটা আর্তনাদে তখন হাসপাতালের ভেতরের ওয়েটিং রুমে এক নিকষ কালো সময়, অন্তত তাদের জীবনের। কারণ যাদের হারায়, শুধু তারাই জানে কী হারিয়েছে তারা। তবুও এই তো জীবন, এই তো জীবনের ছুটে চলা অনন্তের দিকে।
অথচ এ মানুষটা একজন প্রচণ্ড সচেতন মানুষ ছিলেন। আমাকে সবসময় ফোন করে কী করতে হবে, তার একটা ফিরিস্তি দিতেন সময়ে সময়ে। আমাকে বলেছিলেন তুমি তো বুস্টার নিয়েছ, আমিও নিচ্ছি আগামী সপ্তাহেই। ব্রিটেনে লকডাউন শেষে এক বছরেরও অধিক সময় পর শুরু করেছিলেন তার অফিস যাত্রা, ম্যানচেস্টারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মহামারি ডেল্টার কাছে তিনিও হারিয়ে গেলেন।
তিনি বলতেন, কী আবার আরেকটা এলো, ওমিক্রন- সতর্ক থেকো। ওমিক্রন তাকে কিছুই করেনি। হয়তো ওমিক্রন খুব একটা কিছু করছেও না। তবুও ব্রিটেনে এখন ওমিক্রন-ঝড় চলছে। এই ঝড়ে লাখো মানুষ প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে। গত সপ্তাহে এই আক্রান্তের সংখ্যা একদিনে দুই লাখ ছাড়িয়েছিল। এখন কিছুটা কমলেও লাখের উপরেই আছে। কিন্তু তারপরও সরকারি পর্যায়ে ওমিক্রনকে মহামারি হিসেবে নেয়া হচ্ছে না, গেল বছরের মতো। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে বন্ধ করা হয়েছে গণহারে পিসিআর টেস্ট। শরীরে কোভিডের বড় রকমের কোনো কিছু অনুভূত না দেখলে হাসপাতাল কিংবা কোভিড টেস্ট সেন্টারে ভিড় এড়াতে এ উদ্যোগ নিল সরকার।
যেহেতু এ ভাইরাস আগের মতো নেই, অর্থাৎ মৃত্যু ততটা নেই, সেহেতু ব্রিটেনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় চাপ কমাতেই এ উদ্যোগ। অন্যদিকে আতঙ্ক থেকে দেশটির জনগণকে দূরে রাখতে এ-ও একটা পদ্ধতি বটে। যুক্তরাজ্যের জনগণ ক্রমেই ওমিক্রণের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। প্রতি বছরের স্বাভাবিক কাশি-সর্দির ভাইরাসের মতোই মেনে নিতে শিখছে ব্রিটিশ জনগণ। মানুষ যাতে হাসপাতাল কিংবা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে (এনএইচএস) চাপের মুখে না রাখে সেজন্য এসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ তথা সরকারের পক্ষ থেকে আতঙ্কিত না হতে প্রচার-প্রচারণা থাকলেও এ প্রচারণা দেশটির জনগণের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
কিন্তু এখানেও কথা আছে। এমনিতেই এনএইচএস নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে দেশটিতে। দেশটির গর্ব হিসেবে পরিচিত এ খাত। কিন্তু বিভিন্ন সার্ভিস নিয়ে প্রচুর সমালোচনার মুখে থাকে এ খাত। অনেক দিন রোগীদের অপেক্ষায় থাকতে হয় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। ‘দুর্ঘটনা এবং জরুরি’ (এ এন্ড ই) বিভাগে থাকে দীর্ঘ লাইন। একটা উন্নত দেশের মানুষ তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনামুখর থাকে। তবুও প্যান্ডামিক অর্থাৎ মহামারি আসার পর মানুষ এই সমালোচনা থেকে বেরিয়ে আসে। বরং স্বাস্থ্যসেবায় যারা কাজ করছেন, তাদের একটা আলাদা মর্যাদা দিয়েছে।
কিন্তু এবার সেই নরম অর্থাৎ সহানুভূতিপূর্ণ মনোবৃত্তিটুকু মানুষের নেই। কারণ মহামারির কথা বলে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারটা আগের মতোই আছে। নিজস্ব ডাক্তারদের কাছেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে অনলাইনে কিংবা টেলিফোনে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিতে হয়। ডাক্তার-নার্স মিলে হাজার হাজার কর্মচারী ওমিক্রনের নামে ছুটিতে। আর সরকার শুধু ‘চাপ কমাও এনএইচএস বাঁচাও’ জাতীয় সেøাগান নিয়ে আসছে।
অথচ দেখা যাচ্ছে দেশটির বর্তমান যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অর্থাৎ দেশটিতে প্যান্ডামিক ছাড়াই যে পরিস্থিতি ছিল ইতোপূর্বে, তার চেয়ে বর্তমান খুব একটা মারাত্মক কিছু নয়। এখন মৃত্যু ১৫০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে ওঠানামা করছে। এবং দেখা যাচ্ছে ষাটোর্ধ্ব মানুষগুলোর শঙ্কা বাড়াচ্ছে ওমিক্রনে। এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালের শেষদিকে এবং ২০১৮ সালের প্রথম দিকে শীতকালীন সময়ে স্বাভাবিক ভাইরাসে দিনের মৃত্যু এ রকম এসেছে। বিবিসির এক কলাম লেখক তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, সে সময়ও মৃত্যু এর বেশি ছিল না। আর সেজন্য এমনকি সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত বিবিসি প্রশ্ন রাখছে, যদি ২০১৭-১৮ এবং ২০২১-২২-এর যুক্তরাজ্যে নাগরিকদের ওপর প্রকৃতির এই চাপ প্রায় সমান থাকে, তাহলে কেন শুধু শুধু সরকার দায়ভার সরাতে নাগরিকদের তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত রাখছে। শীতকালীন সময়ে এ রকম চাপ অস্বাভাবিক নয়।
তিনি তার আলোচনায় আরো উল্লেখ করেছেন, গত এক দশক থেকেই এনএইচএস স্বাস্থ্যসেবায় সমালোচিত হচ্ছে। কোনো সময়েই সরকার এর কোনো উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। কোভিড শুরু হওয়ার পর থেকে সত্যিকার অর্থেও স্বাস্থ্য কর্মীরা যে ত্যাগটুকু করেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি রিলাক্স মুডে আছেন তারা এখন, বিশেষত জিপি সার্ভিস অর্থাৎ নাগরিকদের নিজস্ব ডাক্তার সেবা। অন্যদিকে যারা স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে, যারা মানুষকে আশ্বস্ত করছে, তাদের একটা বড় অংশই বিশ্বাস করছে না ভ্যাকসিনের প্রতি। কিংস কলেজ হসপিটালের প্রধান ড. ক্লভ কেই বিবিসিকে বলেছেন, তার প্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশ ডাক্তার কিংবা নার্স কিংবা স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থাৎ প্রায় ১৪ হাজার কর্মকর্তা এখনো ভ্যাকসিন নেননি। এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকেই আমরা রিপোর্ট পাচ্ছি, আক্রান্তদের একটা বড় অংশ হলো টিকা না নেয়া মানুষ এবং ওমিক্রনে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর অধিকাংশই টিকাবিহীন বয়সি মানুষ।
দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ এক হাসপাতাল পরিদর্শনে গেলে সে হাসপাতালের এক কনসালট্যান্ট স্টিভ জেইমস রীতিমতো ভ্যাকসিন না নেয়ার পক্ষে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে প্রচার চালিয়েছেন। তিনি সাজিদ জাভেদকে বলেছেন, মানুষের ভ্যাকসিন না নেয়ার আইনগত অধিকার থাকা প্রয়োজন। অথচ বৈজ্ঞানিক ভিত্তি হলো কোভিড থেকে নিজেকে বাঁচানোর এবং অন্যকে রক্ষা করার আপাতত অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো নিজেকে ভ্যাকসিনেইটেড করা। সরকারও নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, সরকার থেকে বিশেষত এনএইচএসের স্টাফদের ভ্যাকসিন নিতে চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। যারা ভ্যাকসিন সেবা দিচ্ছেন, যারা উপদেশ দিচ্ছেন, তাদের একটা বড় অংশ যদি এতে আস্থা না রাখেন, তাহলে এটা কোন ধরনের সেবা। তাই এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এনএইচএসের স্টাফদের নিজস্ব পছন্দের কারণে কেন সরকার সমালোচিত হবে এবং জনগণের ট্যাক্সের অর্থে পরিচালিত স্বাস্থ্য খাত থেকে নাগরিক তার মৌলিক অধিকার থেকে কেনই বা বঞ্চিত হবে। আর এ কারণে এখন এনএইচএস স্টাফদের প্রতি নাগরিকদের সেই ‘নায়কসুলভ’ প্রশংসা এখন সমালোচনার দিকেই আগাচ্ছে।

ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়