এস এম মিজান : অপেক্ষার পালা শেষ। নানা কারণে জাতীয়ভাবে আলোচিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে ভোট আজ। বহু প্রতীক্ষিত এই নির্বাচনের দিকে শুধু নারায়ণগঞ্জবাসী নয়, দৃষ্টি রয়েছে সারাদেশের মানুষের। নির্বাচন ঘিরে কয়েক দিন ধরেই নগরজুড়ে চলছে উৎসবের আমেজ। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণার পুরো সময়টাতেই সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকার পাশাপাশি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ নিয়ে সব মহলে স্বস্তি রয়েছে। নির্বাচন কমিশনও বলছে, সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। ভোটকেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। প্রার্থীরাও সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। তবু শঙ্কা কাটছে না ভোটারদের। বিশেষ করে কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন তারা। মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার অবশ্য আঙুল তুলেছেন প্রশাসনের দিকে। এছাড়া করোনা সংক্রমণ বাড়তির দিকে থাকায় বিধিনিষেধ সত্ত্বেও স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা রয়েই গেছে। গতকাল শনিবার রাত পর্যন্ত নগরের বিভিন্ন এলাকায় সরজমিন নির্বাচন পরিস্থিতি দেখতে গেলে সাধারণ মানুষ নানা বিষয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা তুলে ধরেন এ প্রতিবেদকের কাছে।
নাসিকে ভোটার সংখ্যা প্রায় সোয়া পাঁচ লাখ। ভোট নেয়া শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। ২০১১ সালে পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত হওয়ার পর তৃতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই সিটির নির্বাচন। এই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করছে ৫টি রাজনৈতিক দল মনোনীত ও দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ সাতজন। সংরক্ষিত ৯টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ৩২ জন এবং ২৭টি সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে লড়ছেন ১৪৮ প্রার্থী। নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৫ লাখ ১৭ হাজার ৩৫৭। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৪ ও মহিলা ভোটার ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫১৯ জন। মোট ভোটকেন্দ্র ১৯২টি ও ভোটকক্ষ ১ হাজার ৩৩৩টি। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সব কেন্দ্রকেই গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আজ সেলিনা হায়াৎ আইভী ভোট দেবেন নগরের ১৬নং ওয়ার্ডের দেওভোগের
শিশুবাগ কেন্দ্রে। তৈমূর আলম খন্দকার ভোট দেবেন ১৩নং ওয়ার্ডের মাসদাইরের নারায়ণগঞ্জ ইসলামিয়া কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে সাত প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতায় থাকলেও মূল লড়াই হবে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও হাতি প্রতীকে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে। সবার দৃষ্টিও এই দুজনের দিকে। এ লড়াইয়ে বাড়তি মাত্রা পেয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও মেয়র প্রার্থী আইভীর মধ্যকার ‘শীতল বিরোধ’। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে সেই বিরোধে প্রকাশ্যে নমনীয়তা দেখা গেলেও অন্তর্দ্ব›দ্ব কতটুকু কমেছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকে। বিরোধের বীজ থেকে গেলে নৌকার পালে খানিকটা ধাক্কা লাগারও শঙ্কা রয়েছে। এ ভোটকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কাও কম নয়। কারণ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনের মৃত্যুর তালিকা এই আশঙ্কাকে কিছুটা জোরালো করেছে। এর পাশাপাশি নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে একই দলের একাধিক প্রার্থী থাকায় সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থার ঘাটতিতে থাকা নির্বাচন কমিশনের মেয়াদও শেষ পর্যায়ে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নাসিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করে ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সুযোগ আছে কমিশনের সামনে।
এদিকে প্রচার-প্রচারণার শুরুর দিকে পাল্টাপাল্টি বাগযুদ্ধ চললেও শেষ দিনে দুই মেয়রপ্রার্থী আইভী ও তৈমূর ভোটের দিন সহিংসতার আশঙ্কা করেছেন। সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, ভোটকেন্দ্রে সহিংসতা না হলে আমার বিজয় সুনিশ্চিত। নির্বাচনে আমি লাখো ভোটে জিতব। প্রচার-প্রচারণার শেষ দিন শুক্রবার সকালে নগরের দেওভোগে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। অন্যদিকে গতকাল নিজ বাসভবনে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ করে তৈমূর আলম খন্দকার বলেছেন, আমার নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। টেলিফোনে হুমকি দিচ্ছে, এভাবে আমার লোকদের গ্রেপ্তার করা হলে নির্বাচন কমিশন যে বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, এটাই কী সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া? প্রশাসনকে বলেছি, ভোট সুষ্ঠু করা আপনাদের দায়িত্ব। বহুবার রিকোয়েস্ট করেছি, এখন বিবেকের কাছে ছেড়ে দিলাম। ভোট যাই হোক, আমরা মাঠে থাকব। গ্রেপ্তার হলে হবো, কিন্তু নির্বাচন চালিয়ে যাব। মরে গেলেও মাঠ ছাড়ব না। মানুষের ওপর যত অত্যাচার হয়, ভোটাররা তত ঐক্যবদ্ধ হয়। জনগণ আমার সঙ্গে আছে, আমি লক্ষাধিক ভোটে জয়ী হবো।
তবে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে শঙ্কার কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব দুশ্চিন্তা উড়িয়ে দিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোটের প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, নির্বাচনের দিন পুরো সিটি করপোরেশনজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত পাঁচ হাজার সদস্য মোতায়েন থাকবে। ভোটের দুদিন আগে থেকে ভোটগ্রহণের পরদিন পর্যন্ত প্রতি সাধারণ ওয়ার্ডে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং তিনজন পুলিশ ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১৫-২০ জন সদস্য নিয়োজিত থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুলিশ ও আনসারসহ ২০-২৫ জন দায়িত্ব পালন করবে। প্রতিটি সাধারণ ওয়ার্ডে একটি মোবাইল ফোর্স, সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ১টি করে স্ট্রাইকিং ফোর্স থাকছে। প্রতি থানায় রিজার্ভ ফোর্স রাখার পাশাপাশি ২০ প্লাটুন বিজিবি দায়িত্ব পালন করবে। নগরে শুক্রবার রাত থেকে বিজিবি সদস্যদের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক টহলে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী ও ভ্রাম্যমাণ আদালত। এছাড়া প্রতি কেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি চেকপোস্টে পাহারায় থাকবে র্যাব সদস্যরা।
নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল শনিবার রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার বলেন, আমরা ভোটের সব সরঞ্জাম পৌঁছে দিয়েছি। নাসিক নির্বাচনে ১৯২টি কেন্দ্রকেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আমলে নিয়েছি। ভোটকেন্দ্রে ও কেন্দ্রের বাইরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচ হাজারের বেশি সদস্য নিয়োজিত থাকবে। প্রতি কেন্দ্রে থাকবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২৬ জন সদস্য। এ ভোটে কোনো ধরনের অনিয়ম সহ্য করা হবে না। ভোটাররা যেন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিতে পারেন, সেজন্য যা যা করার নির্বাচন কমিশন ব্যবস্থা নিয়েছে।
গতকাল জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে নির্বাচন উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, নাসিক নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হবে। আমরা সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। ভোটের দিন আমাদের মোট ৩০ জন ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করবেন। পুলিশের ৭৫টি ও র্যাবের ৬৫টি টিম মাঠে থাকবে। বিজিবিও আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। নির্বাচনের জন্য যারা থ্রেট হতে পারেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আশা করি সুষ্ঠু পরিবেশে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছ থেকে লিখিত, ফোনে বা অন্যকোনো মাধ্যমে কোনো অভিযোগ পাইনি। আমাদের ইলেকশনের রুটিন ওয়ার্ক করছি। দাগি আসামিদের বিরুদ্ধেই অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের ভোটের দিন কোনো বহিরাগতকে শহরে প্রবেশ করতে দিব না। ভোটের দিন নারায়ণগঞ্জ মহানগরে আমরা জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে সবাইকে চলাচল করতে দেব। যারা কাল শহরে বের হবেন, আপনারা পরিচয়পত্র নিয়ে বের হবেন। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনায় আমরা ছাড় দেব না। নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এসপি বলেন, কেউ যদি নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট অথবা বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে। আমরা কঠোর অবস্থানে আছি, কঠোর অবস্থানেই থাকব। মা-বোনরাসহ যারা আছেন, আপনারা সবাই ভোটকেন্দ্রে আসবেন। কেউ বাধা দিলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।