সিদ্ধান্ত পরিবর্তন : শতভাগ যাত্রী নিয়ে চলবে গণপরিবহন

আগের সংবাদ

উৎসব-উৎকণ্ঠার ভোট আজ : সবার দৃষ্টি নারায়ণগঞ্জে > আইভী-তৈমূরের লড়াইয়ে বাড়তি মাত্রা শামীম ওসমান

পরের সংবাদ

হাত বাড়ালেই মিলছে আইস

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইমরান রহমান : বেশ কয়েক বছর দেশের মাদকের বাজার ইয়াবার দখলে থাকলেও সম্প্রতি নতুন যোগ হয়েছে আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। কক্সবাজারের টেকনাফের ইয়াবার রুট দিয়েই মিয়ানমার থেকে দেশে ঢুকছে আইসের বড় বড় চালান। শুরুর দিকে অভিজাত শ্রেণির মাদক হিসেবে আখ্যা দেয়া হলেও আইস ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আইসের নেশায় ডুব দিচ্ছে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে আর্থিকভাবে সচ্ছল নানা পেশার মানুষ। আইসের বাজার চাঙা করতে রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী ও উত্তরায় গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি চক্র। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ নজরদারি অব্যাহত থাকলেও অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, বর্তমানে হাত বাড়ালেই আইস কিনতে পারছেন সেবনকারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই লাগাম টানা না গেলে অচিরেই সাধারণ ক্রেতাদের মধ্যেও ছড়িয়ে যাবে ইয়াবার চেয়ে ২০ গুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী ভয়ংকর মাদক আইস।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে দেশে আইস শনাক্ত হওয়ার পর থেকে এরই মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ নগরকেন্দ্রিক আইস সেবনকারী একটা শ্রেণি তৈরি হয়েছে। শুধু রাজধানীতেই আইস ছড়িয়ে দিতে গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ২০টি চক্র। যারা উচ্চশ্রেণির মানুষদের টার্গেট করে আইস সেবন করতে উৎসাহ দিচ্ছে। এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার অনেকেই জামিনে বের হয়ে আবারো আইসের ব্যবসা করছেন। কিন্তু একটি শ্রেণির মানুষের মধ্যে খুবই গোপনীয়ভাবে আইসের কেনাবেচা চলায় চক্রগুলোকে গ্রেপ্তারে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, আইসের বহুবিধ সেবন কৌশল নতুন সেবনকারীদের বেশি আকৃষ্ট করছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ী ঝুঁকে পড়েছেন আইস ব্যবসায়। তারাই পুরনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইয়াবার নিয়মে মিয়ানমার থেকে আইস আনছেন। দেশের ভেতরে ইয়াবা তৈরির জন্যও আইসের বড় চালানগুলো আনা হতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
এছাড়া অন্যান্য মাদকের সঙ্গে মিশিয়ে সেবন করার সুযোগ থাকায় আইসের চাহিদা বাড়তে পারে। এক তরুণ ২০১৯ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ল্যাব স্থাপন করে আইস দিয়ে পরীক্ষামূলক নতুন ধরনের মাদক তৈরির চেষ্টাও করেছিলেন। হাসিব বিন মোয়াম্মার

রশিদ নামের ওই তরুণকে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গ্রেপ্তার করে। এরপর জানা যায়, এই কাজে নাইজেরিয়ার এক নাগরিক তাকে সহায়তা করছিলেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সব সংস্থা (ডিএনসি, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্ট গার্ড) মিলে ৩১ কেজি ২২৪ গ্রাম আইস উদ্ধার করেছে। এ সময়ে শুধু ডিএনসি প্রায় ৫ কেজি আইস উদ্ধার করে। এর মধ্যে ডিএনসি ঢাকা উত্তরের অভিযানেই ওই ১১ মাসে আইস-সংক্রান্ত ২৪টি মামলা দায়ের করা হয়। এতে আসামি করা হয়েছে ২৮ জনকে। উদ্ধার করা হয় ১ কেজি ৮৫৩ গ্রাম আইস। তবে সর্বশেষ ৩ মাসের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে গেছে ওই ১১ মাসের পরিসংখ্যানকে। সর্বশেষ ৩ মাসে (গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) আইস-সংক্রান্ত ২৮টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৮ জনকে। উদ্ধার করা হয়েছে ২ কেজির বেশি আইস।
ডিএনসির ঢাকা মেট্রো উত্তরের ২০২১ সালের ১১ মাসের মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বনানী থানায়। খিলগাঁও থানায় ৪টি মামলা দায়ের হলেও বেশির ভাগ মামলা উত্তরা ও গুলশান এলাকা ও এর আশপাশের এলাকায় দায়ের করা হয়েছে। অর্থাৎ ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের টার্গেট করেই রাজধানীতে গড়ে উঠেছে আইসের চক্র। এমনকি যারা আগে ইয়াবা সেবন কিংবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল, তারাও এখন আইসের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে তারা রাজধানীতে নিয়ে আসছে বড় বড় চালান।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানাধীন মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন দরগারছড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের আড়াই কেজি আইস জব্দ করে কোস্ট গার্ড। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে টেকনাফের নোয়াখালীপাড়া এলাকায় মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন ঝাউবন থেকে ১০ কোটি ৩২ লাখ টাকা মূল্যের ২ কেজি ৬৪ গ্রাম আইস জব্দ করে। গত ৪ জানুয়ারি টেকনাফের সাবরাং লবণের মাঠ এলাকা থেকে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ১ কেজি আইস জব্দ করা হয়। গত ২৬ ডিসেম্বর রাতে টেকনাফের জেলেপাড়া স্লুইসগেট এলাকা থেকে ৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা মূল্যের ১ কেজি ৩৬ গ্রাম আইস উদ্ধার করে। ১৬ ডিসেম্বর টেকনাফের দমদমিয়া এলাকা থেকে বাংলাদেশি এক চোরাকারবারি ও মিয়ানমারের এক নাগরিককে ৫ কোটি ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের অস্ত্র, আইস ও ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়। গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ৫ কেজি আইসসহ ২ কারবারিকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।
গত ২০ আগস্ট আইস সেবন ও বিক্রির অভিযোগে রাজধানীর বনানী, উত্তরা, বনশ্রী ও খিলগাঁও থেকে ১০ জনকে ৫০০ গ্রাম আইসসহ গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। তাদের সবাই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। গত ১৭ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ী থেকে আধা কেজি আইস, ৬৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। আর এসব চালানের আইস মিয়ানমার থেকে দেশে এসেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
ডিএনসির সহকারী পরিচালক (ঢাকা মেট্রো উত্তর) মেহেদী হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, আইসের যে চালানগুলো আমরা জব্দ করেছি, সেগুলো সবই উচ্চবিত্ত শ্রেণির সন্তানদের কাছে পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে কেউ আগে ইয়াবা সেবন করত, পরে আইস সেবন শুরু করেছে। আবার কেউ রাতারাতি অধিক টাকা আয় করার জন্য আইসের ব্যবসা শুরু করেছিল। তবে আমরা গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। যারাই এ মাদক কারবারে জড়াবে, তথ্য পাওয়া মাত্রই তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ইয়াবাতে অ্যামফিটামিন থাকে ৮-১০ শতাংশ। আইসে থাকে ৭৫-৮০ শতাংশ। অর্থাৎ আইস ইয়াবারই বিশুদ্ধ রূপ। আগে মধ্য এশিয়া থেকে বিমানের মাধ্যমে এটির চালান এলেও এখন ইয়াবার রুটে আসা শুরু হয়েছে। এটি অব্যাহত থাকলে ইয়াবা নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেমন ব্যর্থ হয়েছে, আইসের ক্ষেত্রেও তাই ঘটবে। তবে এটি এখনো সাধারণ পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ধানমন্ডি, গুলশান ও উত্তরা এলাকায় ধনাঢ্য শ্রেণিতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। যদি এখনই চালান বন্ধ করা না যায়, তাহলে চালান বাড়বে, দাম কমে যাবে। তখন সাধারণ মানুষের মধ্যেও এটি সয়লাব হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
তিনি বলেন, যদি সীমান্ত দিয়ে চালান ঢুকতে থাকে, তাহলে রাজধানী বা এর আশপাশের এলাকায় আমরা যতই ধরপাকড় করি, কোনো লাভ হবে না। যতটুকু জানি, মিয়ানমার রাষ্ট্রীয়ভাবে আইস উৎপাদন করছে। এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক চাপ দিয়ে উৎপাদন বন্ধ করাতে হবে। পাশাপাশি বিজিবি ও কোস্ট গার্ডকে সীমান্তেই চালান নির্মূলের ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়াও আইস নিবৃত করার জন্য অভিভাবকদের সচেতনতা অতীব জরুরি। না হলে আইস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।
র‌্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন ভোরের কাগজকে বলেন, ইয়াবার পরিবর্তে এখন আইসের চালান বাড়ছে। যার ফলে গত বছর র‌্যাব বিভিন্ন অভিযানে ১৫ কেজি আইস জব্দ করেছে। জব্দকৃত আইসগুলো মিয়ানমার থেকেই এসেছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আইস যাতে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য র‌্যাবের বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি রয়েছে। যখনই কোনো চালানের কিংবা চক্রের তথ্য আসে, তখনই অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাশাপাশি এরই মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য যাচাইবাছাই করে তদন্ত চলমান রয়েছে। আশা করি, আরো বেশ কয়েকটি চক্রকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুটি কারণে আইসের চালান বাড়ছে। প্রথমত, পরিবহনে সুবিধা। আরেকটি হচ্ছে অল্পতে বেশি আসক্তি। যেহেতু মাদকটি কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে আসছে, সেখানকার র‌্যাব-১৫ এ বিষয়ে ব্যাপক কাজ করছে। এরই মধ্যে বেশ বড় বড় চালানও ধরেছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়