নির্বাচনী আইন প্রণয়নসহ ৫ দফা প্রস্তাব এনপিপির

আগের সংবাদ

বদলে গেছে ‘প্রাচ্যের ড্যান্ডি’

পরের সংবাদ

বহুমাত্রিক গবেষণার নিরন্তর সাধক

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১৪, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আবুল আহসান চৌধুরী (১৯৫৩) মূলত গবেষক ও প্রাবন্ধিক, এইটুকু পরিচয়ের সরল বিন্যাসে তার কর্মকাণ্ডকে স্থিতি দিলে, অনেকটা অবিচার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার পর গবেষণা ও লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি থেমে যাননি। সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছেন, তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমিসহ ও অন্যান্য পুরস্কার পাওয়ার পরও নিজের সচল ও ধারাবাহিক অবস্থান থেকে দূরবর্তী হননি! তিনি এই সময়ের এমন একজন গবেষক, যার গবেষণার পরিমণ্ডল এখনো প্রসারিত হচ্ছে- দিগন্তে দিগন্তে, থিতু হওয়ার লক্ষণ নেই। যার ফলে তার গবেষণা-আবিষ্কারের ফলাফলের জন্য আমরা এখনো এক ধরনের চঞ্চলতা নিয়ে অপেক্ষা করি। তিনি গবেষক হিসেবে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, গবেষণার ক্ষেত্রে সচল থাকার মধ্য দিয়ে ইতোমধ্যে বৈদগ্ধতা দেখিয়েছেন, এখনো তা বজায় রাখছেন। একাই এত বিচিত্র বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন, তার পরিচয় নিলে আমরা আশ্চর্য হই- এত উদ্যম, এত শ্রম, এত একনিষ্ঠতা ও আবিষ্কারের প্রণোদনা কোথা থেকে তিনি পেলেন! তার এই অন্তর্গত শক্তি অসামান্য বলেই মনে হয়। অকপটে বলি, গবেষণার অনেক ক্ষেত্রে তিনি তুলনারহিত।
আবুল আহসান চৌধুরীর প্রতিকৃতি ভেসে উঠলে, প্রথমত- একজন অসামান্য লালন গবেষকের পথিকৃতের প্রতিকৃতি ভেসে ওঠে। তিনি তার পর্যবেক্ষণ, আবিষ্কারমূলক ধ্যান ও ধীশক্তি দিয়ে লালনকে বিস্ময়করভাবে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন পরিধিতে, এর ফলে লালনের বাস্তববিম্ব ও সৃজনশীলতার গভীরতা স্পর্শমান হয়। তিনি সংবেদন দিয়ে বিভিন্ন দলিল-দস্তাবেজ, ঘটনা ও সামাজিক অভিঘাত শুধু বিশ্লেষণ করেননি, অবলোকনের মধ্য দিয়ে লালন সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা দূর করেছেন, অন্যদিকে লালনকে তার স্বমহিমায় উন্মোচিত করেছেন। লালন নিয়ে তার লেখা এখনো চলছে। লালন নিয়ে তার কিছু গ্রন্থ উল্লেখ করছি- কুষ্টিয়ার বাউলসাধক (১৯৭৪), লালন শাহ (১৯৯০), মনের মানুষের সন্ধানে (১৯৯৫), কালান্তরের পথিক, লালন সাঁই ও উত্তরসূরি, রবীন্দ্রনাথ : বাউলসংস্কৃতি ও অন্যান্য, রবীন্দ্রনাথ ও লালন, লালন সাঁইয়ের সন্ধানে, তিন পাগলের মেলা : লালন-কাঙাল-মশাররফ ও অন্যান্য। লালন নিয়ে তার উল্লেখযোগ্য সম্পাদিত গ্রন্থ- লালন স্মারকগ্রন্থ (১৯৭৪) ও লালনসমগ্র (২০০৮)।
প্রখ্যাত লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন : যাই হোক, এই সব কিছুর মূলে ছিল আবুল আহসান চৌধুরীর ‘লালন স্মারকগ্রন্থ’। বিশেষ করে তার দ্বারা সংগৃহীত ‘হিতকারী’ পত্রিকার প্রকাশিত ‘মহাত্মা লালন ফকীর’। আমরা এজন্য আবুল আহসান চৌধুরীর কাছে ঋণী। বিশেষ করে আমি। লালন সম্পর্কে আমার ছোট একখানি রচনা আছে। ওটি আমি লিখতে না পারতুম না যদি না আবুল আহসান চৌধুরীর গ্রন্থখানি আমার কাছে না থাকত।’ (সুবর্ণরেখার আলপনা, ২০০৩, পৃষ্ঠা ৩৭)।
গবেষক ও লেখক সুরজিৎ দাশগুপ্ত লালন গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী সম্পর্কে যথার্থ বলেছেন : ‘লালনের জীবনী রচনা আরো অনেক পরিশ্রমের কাজ ছিল, কারণ তার জন্য মুদ্রিত উপকরণের বিশেষ অভাব। এ ছাড়া লালনও নিজের জীবনের বৃত্তান্ত প্রকাশের ব্যাপারে শুধু নীরবই ছিলেন না, ওইসব বিবরণের অসারতার কথাই বলে গেছেন। অধ্যাপক চৌধুরীর আগে যারা লালনের বিষয়ে লিখেছেন তারাও লালনের শিষ্যবর্গের মধ্যে প্রচলিত গান ও কাহিনী অবলম্বনেই লিখেছেন। বিস্তর বিস্র্রস্ত উপাদান ঝেরে বেছে সাজিয়ে লেখা এই জীবনীই বোধহয় লালনের পর সবচেয়ে প্রামাণ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থ লেখকের গভীর গবেষণা ও পরিশ্রমের ফসল।’ (সুবর্ণরেখার আলপনা, ২০০৩, পৃষ্ঠা ৪৩)।
আবুল আহসান চৌধুরীর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৭৫ ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। তিনি সমাজমনস্ক ও ঐতিহ্যসন্ধানী গবেষক। তিনি বুদ্ধিমত্তা ও ইন্দ্রিয়জ্ঞান নিয়ে আমাদের চৈতন্যের বিভিন্ন বন্ধ দরজা খুলে দেন, পাঠককে করে তোলেন বেশ জোরালোভাবে সংবেদী। গবেষণার বিভিন্ন কূলকিনারা নিয়ে তিনি সুলুকসন্ধান করেন, এর ফলে এসব গবেষণা গ্রন্থের বিভিন্ন ব্যঞ্জনা, অনুরণন ও বোধের মুখোমুখি হয়ে পাঠক হিসেবে আমরা স্বকীয় ও বহুমাত্রিক গবেষকের দেখা পেয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে চমকে যাই ও সংবেদী হই। তার লালন সাঁই, কাঙাল হরিনাথ ও মীর মশাররফ হোসেন বিষয়ক গবেষণা দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, জলধর সেন, পাগলা কানাই, আব্দুল হামিদ খান ইউসুফজয়ী, জগদীশ গুপ্ত প্রমুখকে আবিষ্কার করে বাঙালির সমাজ ও মননচর্চার বিভিন্ন দিগন্ত তিনি উন্মোচন করেন।
‘সুফিয়া কামাল : অন্তরঙ্গ আত্মভাষ্য’ ও ‘আলাপচারী আহমদ শরীফ’- এই দুটি বই সাক্ষাৎকারমূলক হলেও তা উল্লেখযোগ্য। এই দুটি গ্রন্থের মধ্যে দুজন বিশিষ্টজনের জীবন শুধু উঠে আসেনি, তাদের জীবনকাল, দৃষ্টিভঙ্গি, সংগ্রাম, সমাজ ইত্যাদি উঠে এসেছে। এমন কাজ তার আরো রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে শুধু পাঠকের কৌতূহল মিটবে না, বিভিন্ন ইশারা ও সময়ের সিলমোহরও পাঠক পেয়ে যান। অগোচরে থাকা অনেক বিষয়ের মুখোমুখি হয়ে ইতিহাসের কণ্ঠলগ্ন হয়ে অনেক সত্যের অনুকূলতা আমরা পেয়ে যাব।
আব্বাস উদ্দিন আহমদ (১৯০১-১৯৬৯) গানের কান্তি ছড়িয়ে তার সময়কালে অতুলনীয় একজন শিল্পী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন, উত্তর পুরুষেও তিনি অগণনীয় শিল্পীদের মধ্যে অলোকসামান্য। জন্মের একশ বছর পরও গানের মাধ্যমে জনচিত্ত জয় করে শুধু নয়, এই ভূখণ্ডের মানুষের সঙ্গীত-সাধনার গন্তব্যস্থল সংহত করার ক্ষেত্রেও তার অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। আব্বাস উদ্দিনের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জানুয়ারি ২০০২-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত হয়েছে আবুল আহসান চৌধুরীর ‘আব্বাস উদ্দিন’ নামক সুবিন্যস্ত গ্রন্থটি। গ্রন্থটি আব্বাসচর্চার আকর-গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। শুধু ব্যাপ্তি ও আয়তনের কারণে নয়, গবেষকের উদ্ভাবনীশক্তি, যুক্তি, পরিকল্পিত বিন্যাস, সন্দেহমোচনে জিজ্ঞাসা, স্বচ্ছদৃষ্টি ও রচনাশৈলীর জন্য গ্রন্থটি হয়ে ওঠেনি নিছক গবেষণার পাণ্ডুলিপি। এ দিক থেকে ড. চৌধুরীর গ্রন্থটি গুরুত্বপূর্ণ ও আব্বাসচর্চায় অনেকাংশে পূর্ণতা এনে দিয়েছে। প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে সম্পর্কিত হয়েছে ১৬টি অধ্যায়। তার লিখিত ‘মীর মশাররফ হোসেন : সাহিত্য কর্ম ও সমাজচিন্তা’, ‘সমাজ, সমকাল ও লালন সাঁই’, ‘লোক সংস্কৃতি-বিবেচনা ও অন্যান্য’ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করলে আলোচ্য ‘আব্বাসউদ্দিন’ নামক গ্রন্থটি কম উজ্জ্বল নয়। এই গ্রন্থটির মধ্য দিয়ে গবেষক-লেখক আবুল আহসান চৌধুরী তার অন্যান্য গ্রন্থের মতোই অগ্রজ্ঞান, প্রামাণ্য দলিলের সমীক্ষণ, উদ্ভাবনী শক্তি, নিজস্ব উপলব্ধি ও রচনা কৌশল নতুন মাত্রায় দ্যোতনাদান করেছেন।
আবুল আহসান চৌধুরীর ‘বাঙালির কলের গান’ তার আর একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। দুষ্প্রাপ্য দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করে শুধু নয়, বইটিতে গভীর সুচিন্তা ও ধীশক্তি নিয়ে গানের ধারাক্রম টেনে এনে বাঙালির সংস্কৃতিচর্চার এক ভূগোল রচনা করেছেন লেখক। যে জগৎ বহু বর্ণিল ও বিভিন্ন স্পন্দন নিয়ে বিস্তৃত, একজন পাঠক বিভিন্ন দিগন্ত স্পর্শ করে অনেকটা উৎপিপাসু হয়ে উঠবেন বলা চলে। সঙ্গীতশিল্পী যূথিকা রায়ের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার রয়েছে এ গ্রন্থে। ৭২ পৃষ্ঠার এ সাক্ষাৎকারে যূথিকা রায়ের বেড়ে ওঠা, সঙ্গীতশিক্ষা, সঙ্গীতশিল্পী হয়ে ওঠা, কমল দাশগুপ্ত, ফিরোজা বেগম, সমকালীন সঙ্গীতচর্চা ও সঙ্গীতশিল্পী প্রভৃতি বিষয় ফুটে উঠেছে। বইটির শেষে রয়েছে কলের গানের সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র। বাংলা গানের জগৎ কত স্বকীয়, বহুমাত্রিক ও বিস্তৃত, তা এই গ্রন্থ পাঠ করে বিস্ময়াভিভূত হতে হয়।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান যথার্থ বলেছেন- ‘আবুল হাসান চৌধুরীর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, অনেক পরিশ্রম করে তিনি বহু মূল্যবান দলিল ও উপকরণ সংগ্রহ করেন, তারপর লেখেন তার ভিত্তিতে। পূর্বগামীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেও তাদের প্রদত্ত তথ্য ও বর্ণিত মত যাচাই করে দেখেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। প্রকৃত গবেষকদের কাজের প্রণালি এমনই হয়ে থাকে। আবার অনেক গবেষক যেমন প্রাপ্ত উপকরণ যক্ষের মতো আগলে রাখেন, তিনি তা করেন না। বহুজনকে তিনি অনেক উপাদান দিয়ে সাহায্য করেছেন, বিনিময়ে স্বীকৃতি ছাড়া কিছু দাবি করেননি। আবুল আহসান চৌধুরীর রচনা স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল, তার তথ্য প্রদানের ধরন সুসংবদ্ধ, তার বক্তব্য যুক্তিপূর্ণ, তার বিশ্লেষণ সুশৃঙ্খল। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে দেখেছি একজন নিবেদিত ও পরিশ্রমী গবেষক হিসেবে এবং একজন মিষ্টভাষী ও বিনয়ী মানুষ হিসেবে।’ (সুবর্ণরেখার আলপনা, ২০০৩, পৃষ্ঠা ৭০)।
এই সংক্ষিপ্ত লেখার পরিধিতে আবুল আহসান চৌধুরী যতটুকু এসেছেন, তা তার অলোকসামান্য গবেষণা ও কর্মকাণ্ডের এক খণ্ডিত ভূভাগ মাত্র, তবুও বলব- এই ভূভাগে বিচরণ করে আমি তার প্রতি পাঠক হিসেবে আমার শ্রদ্ধা জানানোর কিছুটা সুযোগ গ্রহণ করলাম। শেষে দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি- তার লেখার অন্তরস্থিত অভিব্যঞ্জনা নিয়ে আমিও অনেক পাঠকের মতো পরিব্যাপ্ত হয়েছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়