জরায়ুমুখের ক্যান্সার সচেতনতা দিবস আজ

আগের সংবাদ

উৎসবমুখর নারায়ণগঞ্জ : প্রচারণায় এগিয়ে আইভী

পরের সংবাদ

বিতর্কিতদের হাতে নৌকা দলের ভেতরে তোলপাড়! তৃণমূলের সুপারিশ ছাড়াই পাচ্ছে মনোনয়ন > নেপথ্যের কারিগরদের সন্ধানে হাইকমান্ড

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৯, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক : বাবা মুমিনুল হক চৌধুরী জামায়াত নেতা ও রাজাকার। ইমামতি করেছেন ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত গায়েবানা জানাজায়। তার পুত্র রুহুল্লাহ চৌধুরী নিজেও ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামি। জেলা-উপজেলা স্বাক্ষরিত তৃণমূলের সুপারিশে তার নামও আসেনি কেন্দ্রে। অথচ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার চরতী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পেলেন এই রাজাকারপুত্র। তৃণমূল থেকে এই ইউনিয়নে নাম পাঠানো হয়েছিল সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও উপজেলা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি এডভোকেট প্রদীপ কুমার চৌধুরীর। কিন্তু তিনি মনোনয়ন পাননি। একই ঘটনা ঘটেছে নলুয়া ইউনিয়নেও। সেখানে বাদ দেয়া হয়েছে পরপর দুইবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান তছলিমা আকতারকে। তছলিমা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবলীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। তার স্বামী নুরুল আবচার জামায়াত-শিবিরের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। নুরুল ছিলেন সাতকানিয়া উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। এই ইউনিয়নের তছলিমাকে বাদ দিয়ে নৌকার মনোনয়ন দেয়া হয়েছে এলাকায় জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক ও মদতদাতা লেয়াকত আলীকে। লেয়াকতের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে চাকরির সময় র‌্যাবে থাকাকালে মাদক চোরাচালানের দুর্নীতির কারণে চাকরি থেকে বহিষ্কারেরও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এলাকায় তিনি বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত।
এই দুই ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী বদলের অভিযোগ করেছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কুতুব উদ্দিন চৌধুরী। এ নিয়ে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন তিনি। এই অভিযোগ একই উপজেলার আমিলাইশ ইউনিয়নে চেয়ারম্যান প্রার্থী নিয়েও। এখানে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন সারওয়ার উদ্দিন চৌধুরী। যিনি এলাকায় অজনপ্রিয়, দখলবাজ ও অত্যাচারী হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধেও স্থানীয় হিন্দুদের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। এভাবে তৃণমূলের মতামত

উপেক্ষা করে কেন্দ্র থেকে বিতর্কিতরা মনোনয়ন পাওয়ায় বিস্মিত হচ্ছেন দলটির জেলা ও উপজেলা নেতারা। তাদের মধ্যে হতাশার পাশাপাশি বাড়ছে ক্ষোভও। ক্ষোভে-অভিমানে অনেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন রাজনীতি থেকে। তাদের প্রশ্ন, তৃণমূলের মতামত কেন্দ্রে পাল্টায় কীভাবে? এ নিয়ে দলটির সভাপতি ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগের পাহাড় জমা পড়ছে ধানমন্ডির অফিসে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া সেগুলোর সুরাহাও হয়নি। ফলে নৌকার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন একই দলের আরো একাধিক প্রার্থী। যাদের প্রায় সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া ও নির্যাতিত নেতা। যারা বিভিন্ন সময়ে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির দ্বারা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকের পরিবারের সদস্যদের প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের হাতে। নতুবা পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে। নৌকার বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হওয়ার সংখ্যাও কম না। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদ্রোহীদেরই জয়লাভের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। কিছু কিছু এলাকায় বিদ্রোহীদের কাছে হেরে নৌকার প্রার্থীর জামানতও বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
সপ্তম দফার নির্বাচনে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরি ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন আতাউর রহমান। গত ২৬ নভেম্বর স্থানীয় মাদ্রাসা মাঠে তার সমর্থনে আয়োজিত এক নির্বাচনী সমাবেশে নৌকাকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য করেন আতাউর রহমানের আপন ভাই প্রভাষক আহমদ আলী। তিনি তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক। ওইদিন আহমদ আলী বলেন, এবার নৌকার অবস্থা ভালো না। তাই নৌকা পেলেও আমরা নির্বাচন করব, না পেলেও করব। জোট থাকলে বিজয় ছিনিয়ে আনবই। মার্কাতে ভোট দেব না, ভোট দেব ব্যক্তিকে। একই সভায় নৌকার এই প্রার্থীকে নিজেদের জোটের প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দেন সুনামগঞ্জ জেলা জামায়াতের রোকন মো. জসীম উদ্দিন। দুজনের এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। একই উপজেলার শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন জামায়াতের সক্রিয় নেতার ভাগ্নে আবুল খায়ের। গত শুক্রবার ঘোষিত মনোনয়নে তিনি নৌকা পাওয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অনতি বিলম্বে আবুল খায়েরের প্রার্থীতা বাতিলের দাবি জানান।
এর আগে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ৬নং দক্ষিণ রণিখাই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীক পান ইকবাল হোসেন ইমাদ। ইমাদ এক সময়ের উপজেলা ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি ছিল বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা সমালোচনা চলে। ইমাদ ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে পরের বছরে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটিতে সদস্যপদ লাভ করে। মাত্র দুই বছরের মধ্যে নৌকার মনোনয়ন পাওয়ায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা তা মেনে নেননি। নির্বাচনে ইমাদ চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন।
এ ধাপে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া সদর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছিলেন এক সময়ের শিবির নেতা আতাহার আলী। জানা যায়, ফুলবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক সরকারের প্রভাবেই আতাহার আলীর নাম ঢাকায় পাঠানো হয়। যদিও মালেকের দাবি ছিল আতাহার কখনো জামায়াত-শিবির করতেন না। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগে নেতারা জানিয়েছিলেন, আতাহার আলী ৪ নম্বর ওয়ার্ডের জামায়াতে ইসলামীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এর আগে তিনি শিবির করতেন। আর আতাহারের দাবি, তিনি দুই বছর ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছেন। এর আগে মৎস্যজীবী লীগের কমিটিতে ছিলেন।
গত ২৩ নভেম্বর ঘোষিত তৃতীয় ধাপের মনোনয়নে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার কামারচাক ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শিবির নেতা নজমুল হক সেলিম। একদিন পর ২৪ নভেম্বর তাকে পরিবর্তন করে দলীয়ভাবে মনোনয়ন দেয়া হয় আতাউর রহমানকে। ২৫ নভেম্বর আবারো সেই মনোনয়ন পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষরিত দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয় নজমুল হক সেলিমকে। এ নিয়ে কামারচাক ইউনিয়নে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নজমুল হক ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তার বাবা সুন্দর আলী ও চাচা ফয়জুর হক সিদ্দিকী জামায়াতে নিয়মিত চাঁদা দেয়। তার পুরো পরিবারই জামায়াতের সক্রিয় সমর্থক।
চতুর্থ ধাপে ঠাকুরগাঁও সদরের ১৭ নং জগন্নাথপুর ইউনিয়নে নৌকার মনোনয়ন পান একসময়ের সক্রিয় শিবির কর্মী আলাউদ্দিন আলাল মাস্টার। সে সময় বিষয়টি নিয়ে একাধিকবার কেন্দ্রে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগসহ এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। জগন্নাথপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি দেবেশ চন্দ্র শর্মা ও সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার রায় স্বাক্ষরিত বেশ কিছু নথিপত্র ও অভিযোগনামা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে পাঠানো হয়। সেই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আলাল মাস্টার এক সময় সক্রিয় শিবির কর্মী ছিলেন। ২০০৯ ও ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি ইউনিয়ন জামায়াতের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে যোগ দিয়ে বিএনপির দলীয় সমর্থন নিয়ে ২০১২ সালের ইউপি নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। এরপরে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির হয়ে ভোটকেন্দ্র ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এভাবে প্রতিটি ধাপেই জামায়াত-শিবির, বিএনপি থেকে আসারা অর্থের বিনিময়ে দলের মনোনয়ন হাতিয়ে নিচ্ছেন। অভিযোগ আছে, এই অর্থ লেনদেনের সঙ্গে জড়িত স্থানীয় ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রুপিংয়ের সুযোগ নিয়ে দলটির প্রভাবশালী অন্য নেতাদের সহযোগিতায় কেন্দ্রে নাম পাঠানো কিংবা সুপারিশ করে দলীয় মনোনয়ন হাতিয়ে নিচ্ছেন। এতে মনোনয়ন বঞ্চিত হচ্ছেন দলটির যোগ্য ও পোড়খাওয়া নেতাদের অনেকেই।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের একজন সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, প্রতিবার মনোনয়ন ঘোষণার আগে-পড়ে অভিযোগের পাহাড় জমা পড়ে আমাদের ধানমন্ডির দলীয় অফিসে। মনোনয়ন বোর্ডে সবগুলো অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ হয় না। তবে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়। সমাধানও করা হয়। এরপরেও যেসব মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়, সেগুলোর দায়দায়িত্ব জেলা আওয়ামী লীগের। তারা যে সুপারিশ পাঠায়, সেই সুপারিশ থেকেই মনোনয়ন দেয়া হয়। এর বাইরে কাউকে মনোনয়ন দেয়ার সুযোগ নেই। মনোনয়ন বোর্ড সেভাবেই মনোনয়ন চূড়ান্ত করে থাকে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, এই ধরনের ঘটনায় আমরাও আশ্চর্য হই। কোনো না কোনো তথ্যের ঘাটতির কারণে বিতর্কিতরা মনোনয়ন পাচ্ছে। সেটা উপজেলা হোক, জেলা হোক, যে পর্যায়েই হোক। তবে দলীয় সভাপতির নির্দেশ অনুযায়ী, আমাদের সাংগঠনিক টিমগুলো এসব বিষয়ে কাজ করছে। আমরা এই বিতর্কিত এবং এদের পেছনে কারা? তাদের খোঁজে বের করতে পারব। এরপর দলীয় ফোরামে তাদের শাস্তির ধরন নির্ধারণ করা হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়