গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্ত হত্যা বন্ধে ব্যর্থ সরকার

আগের সংবাদ

ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ! জিনোম সিকুয়েন্সিং বাড়ানোর তাগিদ > সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে আরো দুই সপ্তাহ লাগবে : বিশেষজ্ঞদের মত

পরের সংবাদ

সামরিক শাসন ইসলামি পাকিস্তানকে বাঁচাতে পারেনি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানি রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুস সাত্তার গাজ্জালি অনেকটাই নির্মোহ দৃষ্টিতে পেছন ফিরে চেয়েছেন, পাকিস্তানের ভাঙন ও বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখেছেন। তার ‘ইসলামিক পাকিস্তান : ইল্যুশনস এন্ড রিয়েলিটি’ গ্রন্থে তিনি এই উপসংহারই টেনেছেন যে রাজনীতির ইসলাম ইসলামেরও খেদমত করেনি, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রকেও বাঁচাতে পারেনি।
অক্টোবর ১৯৫৮ থেকে সাড়ে তিন বছর সামরিক শাসন চালিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬২-এর মে-তে তার সংবিধান চালু করলেন, যা সামরিক আইনের অনুপস্থিতিতে তার কর্তৃত্বকে নব বলে বলীয়ান করবে। নতুন সংবিধান অনেক ঘষামাজা করে পাকিস্তানের জন্য ইসলামের নীতিমালা স্বীকৃতি দিল, নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের পদ্ধতিবিহীন প্রেসিডেন্টশাসিত এক সরকারকে মেনে নিল এবং একটি ফেডারেল কাঠামো দাঁড় করাল, যেখানে আইনি অধিক্ষেত্রে প্রদেশগুলোর জন্য বরাদ্দ হলো পর্যাপ্ত মাত্রার স্বায়ত্তশাসন। এই ফেডারেল কাঠামোর ডানা ভেঙে দিল প্রধান নির্বাহীর প্রতিষ্ঠানের একক কর্তৃত্ব- যেখানে প্রেসিডেন্ট প্রদেশসমূহের গভর্নরদের নিয়োগ করবেন এবং সেই গভর্নররা নিজ দায়িত্ব ও কর্তৃত্বে প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করবেন, যা কোনোভাবেই প্রাদেশিক আইন পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ হবে না। প্রাদেশিক সরকার প্রকৃত অর্থে সরাসরি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। শুরুতে মৌলিক অধিকার বলে কিছু ছিল, পরে তা সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে লোপ করা হয়।
আইয়ুবের পদ্ধতি প্রেসিডেন্সিয়ালও নয়, ফেডারেলও নয়, বিষয় ও কাঠামোতে প্রতিনিধিত্বশীলও নয়। প্রকৃতপক্ষে এই সংবিধান একক কর্তৃত্ববাদী একটি রাজনৈতিক পদ্ধতির সূচনা করে, যা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নতি ও রাজনৈতিক সামরিকায়নের পথ মসৃণ করে তোলে- আর সবই ঘটে পশ্চিমের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক আঁতাতের সুবিধার্থে সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সেন্টো) এবং সাউথ এশিয়ান ট্রিটি অর্গানাইজেশনের (সিয়াটো) ফ্রেমওয়ার্কে।
রাষ্ট্রের নামের সঙ্গে প্রযুক্ত শব্দ ‘ইসলামিক’ নতুন সংবিধানে বাদ দেয়া হয়। (একটি সামরিক অধ্যাদেশে এর আগে ঘোষণা করা হয়েছিল, এই রাষ্ট্র ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের বদলে পাকিস্তান হিসেবে পরিচিত হবে)। সংবিধানের মূল নির্দেশনায় কুরআন-সুন্নাহকে ও ইসলামি জীবনধারার উৎস হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, আর এই নীতিমালার আলোকে আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব; সে অঙ্গের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাকে কেউ প্রশ্ন করতে পারবে না। সংবিধান অনুযায়ী ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন আদালতে বলবৎ করা যাবে না, যেখানে ১৯৫৬-এর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯৮, যার অধিক্ষেত্র একই বিষয়, তা আদালতে বলবৎযোগ্য। অন্যদিকে দেশের আইনি বিধানগুলো ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করার প্রশ্নে সংবিধানে কোনো সুযোগও সৃষ্টি করা হয়নি, যদিও ১৯৬২-এর সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘বিরাজমান সব আইনকে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।’ ১৯৬২-এর মূল সংবিধানে ছিল : ‘কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন প্রণয়ন করা যাবে না’, তার ব্যাখ্যা দিয়ে যোগ করা হয় ‘পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ-য় ইসলামের শিক্ষা ও চাহিদার স্েঙ্গ অসঙ্গতিপূর্ণ কোনো আইন হতে পারবে না।’ এই সংশোধনী ১৯৫৬-এর ৯৮ অনুচ্ছেদের টীকা পুনরুজ্জীবিত করল, যাতে বলা হয়েছে, কুরআন ও সুন্নাহ বলতে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংশ্লিষ্ট ভাগের ব্যাখ্যা বোঝাবে।
আইয়ুব খানের সংবিধান ১৯৫৬-এর সংবিধানের মতো ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেনি। আইয়ুব খান ইসলামকে বহুল ব্যবহƒত হাতিয়ারের মতো রাজনীতিতে ব্যবহারের বিরুদ্ধে ছিলেন, আবার একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নীতি থেকে ইসলাম বিসর্জন দেয়ার সম্ভাব্য বিপজ্জনক পরিণতি সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তার আত্মজীবনী ‘প্রভু নয়, বন্ধু’তে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লিখলেন, ‘ইসলামের যে কোনো বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা কিংবা সময়ের চাহিদার সঙ্গে আইন সঙ্গতিপূর্ণ করার যে কোনো পদক্ষেপ বিপথগামীর কর্মকাণ্ড বলে উলেমাদের সেøাগান দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে।’ যা-ই হোক, আইয়ুব সাবেক আইনমন্ত্রী এ কে ব্রোহীর মতো বিশ্বাস করতেন, ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য কুরআন কোনো সংবিধান দাখিল করেনি। তিনি বলেছেন, ‘পবিত্র কুরআনে পরিচালনার নীতিমালা রয়েছে, কিন্তু দেশ পরিচালনার জন্য একটি বিস্তারিত সংবিধান কেমন হবে তার ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয়নি।’ ইসলামি রাষ্ট্র গঠনে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উদাহরণগুলো অজ্ঞাত নয়। মহানবীর পর চার খলিফা ইসলামি নীতির প্রশ্নে তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাষ্ট্র সংগঠন ও পরিচালনা করেছেন। প্রত্যেকেই তার সময় বিরাজমান অবস্থা অনুযায়ী ইসলামি নীতিমালা ও মহানবীর শিক্ষার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট ধরন এবং এমনকি সরকারপ্রধান নির্বাচনের পদ্ধতিও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই উপসংহারে না পৌঁছার কোনো সুযোগই নেই যে, ইসলাম কোনো বিশেষ ধরনের সরকার পদ্ধতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়নি, বরং তা সমাজ ও সম্প্রদায়ের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে, যাতে কুরআন ও সুন্নাহর নীতিমালা মেনে নিয়ে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তারা নিজস্ব পদ্ধতি গড়ে তোলেন।
আইয়ুব খান যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন, ইসলামিক নীতিমালার ব্যাখ্যা দেয়ার দায়িত্ব অবশ্যই সমাজের ওপর বর্তাবে। তিনি ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে প্রেক্ষাপটে রেখে আইন প্রণেতাদের সহায়তা করার জন্য অ্যাডভাইজারি কাউন্সিল অব ইসলামিক আইডিওলজি প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এতে উলেমারা সন্তুষ্ট হবেন না জেনেই তিনি লিখলেন, ‘তারা চান ইসলামের ব্যাখ্যা ও ধর্মসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার একচ্ছত্র অধিকার। এ দাবি জানিয়ে গেলেও তারা কোনো সাংবিধানিক দলিল দাখিল করা থেকে বরাবরই দূরে থেকেছেন, কারণ তারা জানেন এ ধরনের উদ্যোগ তাদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ জনগণের সামনে তুলে ধরবে। তাদের দাবি সরকার একটি ইসলামিক সংবিধান প্রণয়নে সম্মতি জানাবে, আর কোনো আইন বা ব্যবস্থা ইসলামিক এবং কোনটা অনৈসলামিক- উলেমারা সে সিদ্ধান্ত দেবেন।’
ইসলামি সংবিধান সম্পর্কে উলেমাদের দাবির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আইয়ুব খান বলেছেন : “যেহেতু কেউই ইসলামিক সংবিধানের মৌল বিষয়সমূহের ব্যাখ্যা করেননি, উলেমাদের আশীর্বাদপুষ্ট না হলে কোনো সংবিধানকেই ইসলামিক বলা যাবে না। ইসলামি সংবিধান পাওয়ার একমাত্র উপায় উলেমাদের কাছে দেশের ভার দিয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করা- ‘অনুগ্রহ করে এবার আলো জ্বালুন’। সংক্ষেপে তারা এটাই চান। তখনই একটি সংবিধানকে ইসলামি বলা যাবে যদি উলেমারা তা প্রণয়ন করেন, বিচারক্ষমতা পেয়ে বিচার করেন এবং শাসনক্ষমতা পেয়ে শাসনও করেন। এ অবস্থা মেনে নিতে জনগণ বা আমি প্রস্তুত হই।”
আইয়ুব খান ইসলামের যে উদার ব্যাখ্যা দিয়েছেন সংবিধানে তার প্রতিফলন ঘটেছে। ১৯৬০ সালে আইয়ুব নিয়োজিত সাংবিধানিক কমিশন সুপারিশ করেছিল : আইনকে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে আমাদের উচিত একটি আন্তর্জাতিক মুসলিম কমিশন প্রতিষ্ঠা করা। এ ধরনের কমিশন কোনো বাস্তব উপকারে লাগবে কিনা এ নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে। আমি কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানের সামনে বিষয়টি উত্থাপন করলে তারা এ নিয়ে কোনো উৎসাহ দেখাননি। কাজেই এটা স্পষ্ট- আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদের বের করতে হবে।
সংবিধান কমিশন উল্লেখ করেছে, আইনকে কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করলেই তা ভালো মুসলমান তৈরি করবে না।
রাজনীতিতে উলেমাদের ভূমিকা নিয়ে আইয়ুব খান এতই সন্দিহান ছিলেন যে, তার একটি চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ১৯৬৩ সালে যখন তখনকার দেশের সবচেয়ে সংগঠিত, প্রতিবাদমুখর রাজনৈতিক দল জামায়াত-ই-ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আইয়ুব খানের সরকার মনে করেছে, ধর্মীয় দলগুলোর কর্মকাণ্ড দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। সে সময় সব সরকারি কর্মচারী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হলফনামা দিতে হয়েছে যে, তারা জামায়াত-ই-ইসলামীর সদস্য নন বা জামায়াত-ই-ইসলামীর সঙ্গে কোনো সংশ্রব নেই।
সংবিধান ঘোষণার আগে আইয়ুব খান ২ মার্চ ১৯৬১ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ জারি করেন- যার আওতায় অনিয়ন্ত্রিত বহুবিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, দ্বিতীয় বিয়ের আগে বর্তমান স্ত্রীর লিখিত সম্মতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়। তাৎক্ষণিক তিন তালাক উচ্চারণের মাধ্যমে তালাক দেয়ার প্রথায় নিয়ন্ত্রণ আনা হয়; দ্বিতীয় বিবাহের অনুমোদন, স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ নিষ্পত্তি এবং স্ত্রী ও সন্তানদের খোরপোশ নির্ধারণের জন্য শহর ও গ্রামাঞ্চলে সালিশ কাউন্সিল গঠন করা হয়। মানতেই হবে আইয়ুব খানকে যত গালাগালই দেয়া হোক না কেন ১৯৪৭ থেকে এ পর্যন্ত এতটা প্রগতিশীল পদক্ষেপ কোনো শাসকই নেননি- হোন তিনি স্বৈরাচারী কিংবা কথিত গণতন্ত্রী।
মুসলিম পারিবারিক আইন সব মুসলিম বিয়ে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়, ইউনিয়ন কাউন্সিলকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রতি ওয়ার্ডে একজন ম্যারেজ রেজিস্টার বা কাজী নিয়োগের; এ কাজের জন্য ফি নির্ধারিত হয়। ইমাম ও খতিবরা দ্রুত এই পদগুলো দখল করেন। অধ্যাদেশে ফি ধার্য করার কারণে ধর্মীয় নেতাদের পকেটে প্রতি বছর পাঁচ কোটি টাকা যেতে থাকে। জামায়াত-ই-ইসলামী যখন এই অধ্যাদেশকে অনৈসলামিক আখ্যা দিয়ে অসন্তোষ ছড়াতে ও আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা করল, ধর্মীয় নেতারা তখন হয় প্রেসিডেন্টকে সমর্থন করলেন নতুবা নিশ্চুপ রইলেন।
২৩ অক্টোবর ১৯৬১ আইয়ুব খান পশ্চিম পাকিস্তান ওয়াকফ সম্পত্তি অধ্যাদেশ জারি করলেন, যার আওতায় সরকার বিভিন্ন মুসলিম ট্রাস্টের বিপুল পরিমাণ মূল্যবান সম্পত্তি নিজ দখলে নিয়ে আসে। ওয়াকফ সম্পদের বিপুল অর্থ যা আগে সুবিধাভোগী ব্যক্তির পকেটে যেত, তা সরকারি তহবিলে জমা হতে থাকে। এই অর্থের কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য মসজিদগুলোর ইমাম ও খতিবদের বেতন প্রদানে ব্যয়িত হতে থাকে। প্রেসিডেন্ট এভাবে আরো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ধর্মীয় নেতার সমর্থন পেলেন। পারিবারিক অধ্যাদেশের আওতায় চাকরি পেয়ে এমনিতে তারা প্রেসিডেন্টের কাছে ঋণী।
ইসলামি নীতি ও আদর্শের এই উদারপন্থি আইয়ুবি ব্যাখ্যায় উলেমারা ক্ষুব্ধ হয়ে পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করলেন। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টাও অনৈসলমিক বলে চিহ্নিত হলো।
১৯৬৮-৬৯-এ আইয়ুববিরোধী বিক্ষোভ অপ্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিরুদ্ধে হলেও রক্ষণশীল জনগোষ্ঠী তাদের আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলনকে অনৈসলামিক নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করে। ১০ মার্চ ১৯৬৯ রাওয়ালপিন্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আইয়ুব খানের বৈঠকে জামিয়াত-ই-উলেমা-ই-ইসলামের নেতা মুফতি মাহমুদ মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের বিরোধিতা করেন এবং ১৯৫১ সালে উলেমাদের সঙ্গে বৈঠকে স্বীকৃত ২২ দফা বাস্তবায়ন করে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার আবেদন জানান।
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ নিয়ে উলেমাদের প্রবল বিরোধিতার পরও আইয়ুব খানের আমলে রাজনীতিতে ইসলামের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না। তবে ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান দুবার উলেমাদের রোষের শিকার হলেন; প্রথমবার শাওয়ালের চাঁদ দেখা নিয়ে- ধর্মীয় নেতারা ফতোয়া দিয়ে বসলেন, সরকার নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হবে না। ধর্মীয় বিষয়ে পাকিস্তানের জনগণ তাদেরই অনুসরণ করবে। ধর্মীয় বিষয়ে সরকারের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই।
অপর বিষয়টি ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ডক্টর ফজল উর-রেহমানের লেখা গ্রন্থ ‘ইসলাম’-এর বিরুদ্ধে উলেমাদের গণপ্রতিবাদ। সরকার ধর্মীয় লবির মোকাবিলা এড়াতে লেখককে পদত্যাগে বাধ্য করে। ডক্টর ফজলের উদারপন্থি ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে উলেমাদের যে বিক্ষোভ হয়, তা ১৯৫৩-এর কাদিয়ানিবিরোধী বিক্ষোভের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণবিক্ষোভ।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সামরিক রাজত্বে প্রধান লক্ষ্য ছিল আন্তর্জাতিক ধনতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে কিছু পরিমাণ রাজনৈতিক বৈধতা আদায় করা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক স্থাপনে আইয়ুব নিজেই ছিলেন উদ্যোক্তা ও হাতিয়ার। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের মনে তিনি গভীর দাগ কাটতে পেরেছেন, এমনকি এর চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত হয়েছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও সেক্রেটারি অব স্টেট জন ফস্টার ডুলেসের সঙ্গে। ১৯৫৪ সালে আইজেনহাওয়ার-নিক্সন প্রশাসন পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই বছর পাকিস্তান সিয়াটোতে যোগ দেয় এবং ১৯৫৫ সালে বাগদাদ চুক্তিতে অংশীদার হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম দেশীয় কমান্ডার-ইন-চিফ আইয়ুব সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ছিলেন আর সুবিধামতো সময়েই এ জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়ান। যুক্তরাষ্ট্র আইয়ুবের অনুরোধ রাখার জন্য এমনিতেই উদগ্রীব- সেই থেকে দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক শুভেচ্ছা ও সহযোগিতার একটি দীর্ঘমেয়াদি যুগের সূচনা। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করলেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রাথমিকভাবে এই ক্ষমতা অনুমোদন করেনি সত্য কিন্তু এতে বিচলিতও হয়নি।
১৯৬৯-এ ইয়াহিয়া খানের নিজেরই এজেন্ডা ছিল। তিনি সংবিধান রদ করলেন। ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ জেনারেল আইয়ুব খান গদিনসীন হয়ে যেভাবে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন, জেনারেল ইয়াহিয়া খানও একই পথ অনুসরণ করলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া আসলে এ ধরনের একটি সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তগত করতে তিনি বিলম্ব করেননি। গণতন্ত্রের অপর্যাপ্ততা জনসমক্ষে তুলে ধরতে তিনি গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথেই পা বাড়ালেন। তিনি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, কোনো রাজনৈতিক দলই সরকার গঠন করার মতো কার্যকরী সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কাজেই তিনিই জাতির সদয় ভাগ্যনিয়ন্তার ভূমিকায় থেকে যেতে পারবেন। আর দেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের সমর্থন তো তিনি উপভোগ করতেই থাকবেন- সেই দলের নাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এটাই তার পরম দুর্ভাগ্য, তার নিজের এই দলটি ঢাকায় চরমভাবে পরাস্ত হয়েছে। প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করা গোয়েন্দা সংস্থার সব পূর্বাভাস ডাহা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে,
নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়