গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্ত হত্যা বন্ধে ব্যর্থ সরকার

আগের সংবাদ

ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ! জিনোম সিকুয়েন্সিং বাড়ানোর তাগিদ > সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে আরো দুই সপ্তাহ লাগবে : বিশেষজ্ঞদের মত

পরের সংবাদ

মাই নেম ইজ খান : নিয়তির আঁকড়ে থাকা পরিচয়

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ভারতের শাহরুখ খান। শুধু একটি নামই নন, শুধু একজন অভিনেতাই নন- রীতিমতো একটি প্রতিষ্ঠান। সিনেমা জগৎ ভারতকে অনেক কিছুই দিয়েছে। হলিউডের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে চলেছে বলিউডের সিনেমা জগৎ। আর সে জগতের সর্বস্বীকৃত দুজন বাদশার নামোল্লেখ করতেই হয়- অমিতাভ বচ্চন আর শাহরুখ খান। অনেকের মতো এ দুজনের ক্ষেত্রে সবসময়ই সবার স্মরণে থাকে ‘হিন্দু না মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?’ অমিতাভ বচ্চনকে রাজনীতিতে টানার চেষ্টা হয়েছে অনেকবার। গান্ধী পরিবারের রাজীব গান্ধী ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু সেই রাজীবের আহ্বানেও তিনি সাড়া দেননি। আজীবন থেকে গেলেন অভিনেতা হিসেবেই। ১৯৪২ সালের কথা। তখন ‘ভারত ছাড়ো’ সেøাগানে উত্তাল অবিভক্ত ভারত। মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ অনুরাগী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন পেশোয়ারের কিস্সা খোয়ানি বাজারের এক সদ্য তরুণ। নাম মীর তাজ মুহম্মদ খান। কংগ্রেসের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তিনি কাজ করতে লাগলেন। দেশভাগের কথা শোনা যাচ্ছিল। প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি তাজ মুহম্মদের মতো তরুণ নেতারা। শেষ পর্যন্ত সত্যিই সে দিনটি এলো। এর নির্মম ঘা খেলেন পশ্চিম পাঞ্জাব আর পূর্ববঙ্গের বাসিন্দারা। জানমাল বাঁচিয়ে স্বাধীন ভারতে শরণার্থীদের জীবনে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হলেন কেউ কেউ। তাজ মুহম্মদ উল্টোটা করে ফেললেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে নস্যাৎ করে চলে এলেন মহাত্মা গান্ধীর ভারতে। দিল্লিতে বেছে নিলেন শরণার্থীর জীবন। দিল্লির মেয়ে লতিফ ফাতেমাকে বিয়ে করলেন। দম্পতির দুই সন্তান। মেয়ে লালরুখ এবং ছেলে শাহরুখ।
শাহরুখ মানে বলিউডের আজকের মহাতারকা শাহরুখ খান। জন্ম ১৯৬৫ সালে। সবার সমানাধিকারের জন্য লড়ে যাওয়া তাজ মুহম্মদ যেমন চেয়েছিলেন, তেমনভাবেই শাহরুখের পড়াশোনা এবং বেড়ে ওঠা শুরু হয়েছিল। দিল্লির সেন্ট কলম্বাস স্কুল এবং সরকারি হিন্দু কলেজে পড়েছেন এ অভিনেতা। অভিনয় শিখেছেন নাট্য পরিচালক ব্যারি জনের কাছে। সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে নাটকের নেশায় অর্ধেক দিনই ক্লাস করা হয়নি। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে আর পরীক্ষায় বসতে দেয়নি। শৈশব তার কেমন ছিল এমন প্রশ্নে এ অভিনেতা বলেছিলেন, ‘প্রতি রবিবার বিকালে বাবার সঙ্গে দিল্লির রাস্তায় রাস্তায় এমনিই ঘুরে বেড়াতাম। কখনো কনট প্লেসের একাধারে বসে চার আনা বা আট আনার চিনাবাদাম খেতে খেতে শহরের ঠাটবাট দেখতাম। চিনাবাদামের চেয়ে বেশি কিছু কিনে দিতে পারতেন না আমার গরিব বাবা। কিন্তু কী অপার্থিব আনন্দের ছিল সেসব দিনগুলো! জন্মদিনে কখনো নতুন উপহার পাইনি। পুরনো কিছু শখের জিনিস উপহার দিতেন বাবা। একবার দিয়েছিলেন পুরনো দাবা বোর্ডটি। আর একবার দিয়েছিলেন পুরনো টাইপ রাইটার। টাইপ রাইটার দিয়ে বাবা বলেছিলেন, একবার ভুল টাইপ করলে তা মোছা কঠিন; তাই সতর্ক থাকতে হবে, নিখুঁত কাজ করতে হবে।’ এ মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে-ওঠা শাহরুখ বাবাকে হারান ১৫ বছর বয়সে; মাকে হারান ২৬ বছর বয়সে। ততদিনে শাহরুখ ছবিতে অভিনয় না করলেও ‘ফৌজি’, ‘সার্কাস’, ‘ওয়াগলে কি দুনিয়া’-র মতো ধারাবাহিকের সুবাদে ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছেন। আর ততদিনে পাশের পাড়ার মেয়ে গৌরী চিব্বাকে বিয়ে করে সংসারী হয়ে পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্নের নগরী মুম্বাইয়ে। ২৭ বছর বয়সে শাহরুখ প্রথম সিনেমা করেন ‘দিওয়ানা’। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। নব্বই এবং এ শতাব্দীর প্রথম দশকে দাপটের সঙ্গে শাসন করেছেন শাহরুখ খান। আক্ষরিক অর্থে শাহরুখ এক ‘সেলফ মেড ম্যান’। তার তিন সন্তান- আরিয়ান, সুহানা ও আব্রাম।
পুত্র আরিয়ান মাদক মামলায় অভিযুক্ত হওয়ায় অনেক আঙুল উঠেছে পিতা শাহরুখের দিকে। শাহরুখ কোনো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ছেলেকে কোনো ব্যাপারে বাধা দেব না। ও চাইলে সব করতে পারে।’ ছেলে অন্য এক সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘বাবা এত ব্যস্ত থাকেন, তার সঙ্গে দেখা করতে আমারও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে।’ সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এ দুই সাক্ষাৎকার মিলেমিশে দুইয়ে-দুইয়ে চার হয়ে শাহরুখের মুণ্ডুপাত শুরু হয়ে গিয়েছিল।
শাহরুখ পুত্র আরিয়ান খান কতটা অন্যায় করেছেন তা এখনো স্পষ্ট নয়। তার বিরুদ্ধে মাদক মামলা কোন ভিত্তিতে তা-ও স্পষ্ট নয়। ২ অক্টোবর ২০২১ রাতে প্রমোদতরীতে তল্লাশি করে আরিয়ানের কাছ থেকে ছিটেফোঁটা মাদকও উদ্ধার হয়নি। সাড়ে তিন সপ্তাহ জেলে কাটিয়ে জামিন পেয়েছেন আরিয়ান। পুত্রের গ্রেপ্তারের পর শাহরুখ খান যেন রাতারাতি এক নিঃসঙ্গ সম্রাট হয়ে গিয়েছিলেন। আরিয়ানের জামিন পাওয়ার আগে শাহরুখের চারপাশ আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিল। শুধু সরব ছিলেন একজন- সালমান খান। একসময় যাদের প্রবল রেষারেষি নিয়ে কলামের পর কলাম লেখা হতো। গ্রেপ্তারের পর সবসময়ই যোগাযোগ রেখেছিলেন সেই সালমান খান। অনেকেই শাহরুখের বন্ধুবলয়ের মধ্যে থাকলেও ভারতের গত লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ডাকে ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ সেলফি অনুষ্ঠানে মোদির সঙ্গে শাহরুখকে দেখা যায়নি। বিষয়টি ভাবিয়েছিল শাসক গোষ্ঠীকে। তাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তা নিয়ে। কিন্তু শাহরুখ তাতে নীরব ছিলেন বরাবর। লক্ষণীয় বিষয়, আরিয়ানকে ছাড়াতে কোনো প্রভাব খাটাননি শাহরুখ। আগাগোড়াই তিনি সংযত থেকেছেন। দেশের আইনের প্রতি ভরসা রেখেছেন এবং অপেক্ষা করেছেন, তা যতই দুঃসহ হোক না কেন। চোখের বদলে চোখ তুলে নিলে পৃথিবীটাই একদিন অন্ধ হয়ে যাবে- এভাবেই মহাত্মা গান্ধী দিয়েছিলেন অহিংসার মন্ত্র; শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বকে। তার সে মন্ত্র ভারত এখন কতটা ধরে আছে- সে প্রশ্নই যেন সামনে নিয়ে আসে নরেন্দ্র মোদির সরকারের নানাবিধ কার্যক্রম। ১১ জনের ভারতীয় ক্রিকেট দল শারজায় পরাজিত হলে একা যাবতীয় আক্রোশের শিকার হন বেচারা মুহম্মদ শামি। তবে কি সে কারণেই নিশানা হয়ে উঠেন শাহরুখ পুত্র আরিয়ান? সেকুলার ভারত আর হিন্দু ভারতের দৌড়ের খেলায় শাহরুখ খানের মতো বাদশারাও কি বিভাজনের বিষের কোপানলে পড়ে যায়?
২৩ বছরের আরিয়ান। সবে বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে এসেছেন। আবার হয়তো বিদেশেই চলে যাবেন বিতৃষ্ণায়। তার অপরাধ সে বাজিগর শাহরুখের পুত্র। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (এনসিবি) আচরণ ছিল রীতিমতো রহস্যজনক। মুম্বাই থেকে গোয়াগামী ক্রোজে সওয়ার হন আরিয়ান। গোটা পার্টির আয়োজক ফ্যাশন টিভির কর্ণধার কাশিফ খান। কিন্তু গ্রেপ্তার হওয়ার দলে তার নাম নেই। আরিয়ান জেলে কাটিয়ে দিলেন সাড়ে তিন সপ্তাহ। ইতোমধ্যেই দুজন সাক্ষী বক্তব্য পরিবর্তন করে এনসিবি কর্তার দিকে আঙুল তুলেছেন। কোনটা সত্যি, তা এখনো কেউ জানে না। আগামী দিনে জানতে পারব এমন আশাও প্রায় নেই। শুধু বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা গোলমাল এতে আছে। ইতোমধ্যে ঘটনা প্রবাহের পেছনে এনসিবিকে দায়ী করে সংবাদ সম্মেলন করলেন বিজেপি নেতা মোহিত কম্বোজ। তার অভিযোগ, বিজেপিকে কালিমালিপ্ত করতেই গোটা ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এদিকে জামিন দিয়ে মুম্বাই হাইকোর্ট উল্লেখ করে, শাহরুখ পুত্র আরিয়ান খান কোনো ষড়যন্ত্র করেছেন এমন প্রমাণ মেলেনি। শুধু আরিয়ানই নন, তার বন্ধু আরবাজ মার্চেন্ট এবং মডেল মুনমুন ধামেচার বিরুদ্ধেও কোনো ষড়যন্ত্রের প্রমাণ মেলেনি। তাই তাদের জামিন দেয়া হয়েছে।
আরিয়ান তার বাবার বাড়ি মন্নত-এ ফেরার পর শাহরুখ খান কি তাকে বাবার দেয়া সেই টাইপ রাইটারের গল্প বলেছেন? জানি না এখনো এমনটা। তিনি আর কেউ নন, বলিউডের বাদশা শাহরুখ খান। কিন্তু তারপরও কি সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে তাকে বাড়তি সতর্ক হতে হয়েছে? ছেলে আরিয়ানকে ছাড়াতে তিনি মুখ খোলেননি, একটিবারের জন্যও মিডিয়ার মুখোমুখি হননি। প্রভাব বিস্তার করেননি ছেলেকে দ্রুত বের করে নিয়ে আসতে। কোনো দেশেই কেউ সংখ্যালঘু নয়, সবাই সে দেশের নাগরিক- এমনটা বলার কি কোনো সুযোগ আছে? শাহরুখ খানকেও কি সংখ্যালঘু হিসেবে ভাবতে হবে? আজও কি আমাদের আত্মা বেঁচে আছে? সবকিছু ঠিকঠাক চলছে, না-কি স্মৃতি আর জীবনবোধের আর্তনাদের ওপর দিয়ে খণ্ডিত চিন্তার চিহ্নগুলো গোপনে হাঁটছে? ‘মাই নেম ইজ খান’- নিয়তির এ আঁকড়ে থাকা পরিচয় কি আমাদের কাছ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে শাহরুখ খানের মতো মানুষদের? ভয় হয়, এভাবেই হয়তো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে ভেঙে যাচ্ছি আমরা। লালফিতার দৌরাত্ম্য দেখিয়ে আইনের ফাঁকে শুধু জামিন পেতেই লেগে গেল প্রায় এক মাস। তাহলে বিনা বিচারেই যে প্রায় জেল খাটা হয়ে গেল আরিয়ানের! যেখানে তার অপরাধ প্রমাণিত হলেও সর্বোচ্চ শাস্তি হতো মাত্র এক বছর। এমন ব্যবস্থার সঙ্গে আর যা-ই থাকুক, তার সঙ্গে যোগ নেই সুবিচার দেয়ার ও পাওয়ার। এ ঘটনায় দিনের আলোর মতো প্রকাশিত হলো, নামকরা লোকের পুত্র হওয়ার যন্ত্রণা কতটা নির্মম! সাধারণ ঘর থেকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছানো বাবাকে শাসনের কী প্রাণান্তকরণ চেষ্টা রিমোট কন্ট্রোল দিয়ে! তবুও প্রমাণ করেছেন- তিনি শাহরুখ খান, বলিউডের অবিসংবাদিত জনপ্রিয় অভিনেতা। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে গিয়ে তিন সপ্তাহের কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করে নিয়েছেন তিনি। প্রভাবশালী বাবা-কাকার জোরে নয়, নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি হাঁটতে শিখেছিলেন। আর ছেলের এ নির্মম বাস্তবতায়ও তিনি প্রমাণ করলেন, নিজের পায়ের ওপরই এখনো দাঁড়িয়ে আছেন। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সবার সঙ্গে সেলফি না তুলেও প্রমাণ করলেন, তিনি শাহরুখ খান- বলিউডের শাহরুখ খান।

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়