গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্ত হত্যা বন্ধে ব্যর্থ সরকার

আগের সংবাদ

ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ! জিনোম সিকুয়েন্সিং বাড়ানোর তাগিদ > সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে আরো দুই সপ্তাহ লাগবে : বিশেষজ্ঞদের মত

পরের সংবাদ

পাহাড়ি সশস্ত্র সংগঠনগুলো ব্যস্ত আধিপত্যের লড়াইয়ে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:২৪ পূর্বাহ্ণ

কাগজ প্রতিবেদক, বান্দরবান থেকে ফিরে : পাহাড়ের সশস্ত্র সংগঠনগুলো ব্যস্ত আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, অপহরণ এবং খুন-খারাবিতে। গত তিন বছরে চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মূল দল জেএসএস, জেএসএস (এমএন লারমা) গণতান্ত্রিক, ইউপিডিএফ জেএসএস ও মগ লিবারেশন পার্টির (মারমা পার্টির) সশস্ত্র সংঘাতে শুধু বান্দরবান জেলায় খুন হন ২৫ জন। চাঁদাবাজি ও অপহরণ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে জেএসএস-ইউপিডিএফের মধ্যে বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। প্রশাসনের অদৃশ্য ভূমিকা পালনের কারণে দিন দিন আরো বেড়ে উঠেছে পাহাড়ে চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।
আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে জেএসএস ভেঙে গঠিত হয়েছে নতুন নতুন সশস্ত্র দল। ২০০৫ সালের দিকে জেএসএস আরেক দফা ভেঙে গঠিত হয়েছে জেএসএস সংস্কার (এমএন লারমার গ্রুপ)। বান্দরবান জেলায় ২০১৯ সালের দিকে হঠাৎ গড়ে তোলা হয় মগ লিবারেশন পার্টি নামে আরেকটি নতুন সশস্ত্র সংগঠন। আর ইউপিডিএফ ভেঙে ২০২০ সালের দিকে আরো একটি নতুন দল ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে জন্ম নেয়। বর্তমানে এই কয়েকটি সংগঠনের মিশন ও ভিশন এক এবং অভিন্ন। এসব দলের সদস্যদের কাছে রয়েছে সর্বাধুনিক বিদেশি ভারি অস্ত্র ও গোলাবারুদ। স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র মতে, বান্দরবান জেলায় ২০১৯ সালের ৭ মে মারমা পার্টি নামে পরিচিত মগ লিবারেশন সদস্যরা জনসংহতি সমিতির কর্মী বিনয় তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করে। অপহরণ করা হয় ফোলাধন তঞ্চঙ্গ্যা নামের অপরকর্মীকে। এখন পর্যন্ত খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। এরপর ৯ মে জনসংহতি সমিতির সমর্থক জয় মণি তঞ্চঙ্গ্যাকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯ মে জেএসএস অস্ত্রধারীরা রাজবিলা আওয়ামী লীগের সমর্থক ক্যচিং থোয়াই মারমাকে (২৭) অপহরণের পর গুলি করে হত্যা করে। জেএসএস সদস্যরা ২২ মে আওয়ামী লীগ নেতা চ থোয়াই মং মারমাকে বালাঘাটা চড়ইপাড়া এলাকা থেকে অপহরণের পর হত্যা করে। রোয়াংছড়িতে ২৫ জুন আওয়ামী লীগ কর্মী অংসিংচিং মারমাকে গুলি করে হত্যা করে। ২২ জুলাই রোয়াংছড়ি শামুক ঝিড়ি এলাকায় জেএসএস সদস্যরা তারাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মংমং থোয়াই মারমাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। গত

২০২০ সালের ৭ এপ্রিল জেএসএস মূল দলের সদস্যরা রোয়াংছড়ি উপজেলার কানাইজো পাড়ায় জেএসএস সংস্কাপন্থি এমএন লারমা গ্রুপের একসঙ্গে ৬ নেতাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। এরপর মাস যেতে না যেতে ১৫ মে রুমা উপজেলার দুই বোটচালককে মারমা পার্টির সদস্যরা অপহরণের পর হত্যা এবং লাশ গুম করে। ২ জুলাই বান্দরবান সদর ইউনিয়নের হেব্রন পাড়া থেকে অপহরণ করা হয় রুয়াল লুল থাং বমকে। এখনো তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৬ জুলাই কুহালংয়ের ১ নং এলাকা থেকে গুংগা জলি ত্রিপুরা (৪১) নামে এক যুবককে অপহরণ করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর বাঘমারায় গুলিতে নিহত হয় মংসিংউ মারমা। ১৫ অক্টোবর রোংছড়ি নতুন পাড়ায় সাবেক মেম্বার ছাউপ্রæ মারমাকে (৫০) গুলি করে হত্যা করে মগ লিবারেশন পার্টির সদস্যরা।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির ৭২টি শর্তে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে সন্তু লারমাসহ শান্তি বাহিনীর কয়েক হাজার সশস্ত্র ক্যাডার অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে শান্তি বাহিনী নামক তাদের সশস্ত্র শাখাটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এই দিন সন্তু লারমাকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যায়িত করে জেএসএসের বিশাল একটি অংশ প্রসিত খীসার নেতৃত্বে গঠন করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামে আরেকটি সশস্ত্র সংগঠন। তারাও জেএসএসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে স্বাধীন জুমল্যান্ড গঠন এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে লাইনচ্যুত হয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে চাঁদাবাজি, খুন, গুম ও অপহরণ বাণিজ্যে।
২০২০ সালের ৭ এপ্রিল জেএসএস মূল দলের সদস্যরা রোয়াংছড়ি উপজেলার কানাইজোপাড়ায় জেএসএস সংস্কাপন্থি এমএন লারমা গ্রুপের ৬ নেতাকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। ১৫ মে জেএসএস সদস্যরা রুমা উপজেলার গালেগ্যা ইউনিয়নের দুই বোটচালককে অপহরণের পর লাশ গুম করে। ২ জুলাই রুয়াল লুল থাং বমকে (৩০) বান্দরবান সদর ইউনিয়নের হেব্রনপাড়া থেকে অপহরণ করা হয়। এখনো তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৬ জুলাই গুংগা জলি ত্রিপুরা (৪১) নামে এক যুবককে কুহালংয়ের ১নং এলাকা থেকে জেএসএস সদস্যরা অপহরণ করে। ১ সেপ্টেম্বর বান্দরবানের বাঘমারায় জেএসএস সদস্যদের গুলিতে নিহত হয় মংসিং উ মারমা। ১৫ অক্টোবর রোয়াংছড়ির নতুন পাড়ায় সাবেক মেম্বার ছাউপ্রু (৫০) মারমাকে গুলি করে হত্যা করে মগ লিবারেশন পার্টির সদস্যরা।
গত বছরের ১৮ জুন বান্দবান জেলার রোয়াংছড়িতে মসজিদের ইমান নওমুসলিম মো. ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে (৫০) ঘরে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একই বছরের ১৯ জুলাই বান্দরবান সদরের ক্যমলং পাড়া কুহালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ও পল্লী চিকিৎসক অংক্য থোয়াই মারমাকে (৪২) অপহরণের পর হত্যা করে। ২৩ নভেম্বর রোয়াংছড়ি তালুকদার পাড়ার উথোয়াই নু মারমাকে গুলি করে হত্যা করে। সর্বশেষ গত ১৩ ডিসেম্বর বান্দরবান সদরের ডলুপাড়া নিজ বাসা থেকে তুলে নিয়ে জেএসএসের সদর উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক পুশৈ থোয়াই মারমাকে মগ লিবারেশন (মারমা) পার্টির সদস্যরা অপহরণের পর লাশ আমতলী পাড়ায় মাটির নিচে পুঁতে ফেলে।
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজি ও অপহরণ বাণিজ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে বান্দরবান পার্বত্য জেলার সাত উপজেলায় প্রতিনিয়ত খুন, অপহরণ ও গুমের ঘটনায় পাহাড়িদের খালি হচ্ছে মায়ের কোল, বিধবা হচ্ছে মা-বোন এবং পিতা হারা হচ্ছে অনেক নারী-পুরুষ। পাহাড়ের এসব নতুন নতুন সশন্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ ও দলগুলোর ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত ও চাঁদাবাজি; একই সঙ্গে নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা, খুন, অপহরণ ও গুমের ঘটনায় ব্যাহত হচ্ছে সরকারের উন্নয়ন এবং সার্বক্ষণিক আতঙ্কিত অবস্থায় দিন যাপন করছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। তাদের দাবি- প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপে এসব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ২০২২ সালে পাবর্ত্যাঞ্চল যেন হয় নিরাপদ একটি আবাসস্থল।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়