গয়েশ্বর চন্দ্র রায় : নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্ত হত্যা বন্ধে ব্যর্থ সরকার

আগের সংবাদ

ওমিক্রনের সামাজিক সংক্রমণ! জিনোম সিকুয়েন্সিং বাড়ানোর তাগিদ > সার্বিক পরিস্থিতি বুঝতে আরো দুই সপ্তাহ লাগবে : বিশেষজ্ঞদের মত

পরের সংবাদ

অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি দিতে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৮, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আলী ইব্রাহিম : অর্থ পাচারের ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানির আড়ালে। তাই দেশের অর্থ বিদেশে পাচার বন্ধে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি বন্ধে জোর দিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কিন্তু এনবিআরের কড়া নির্দেশনার পরও কাস্টম হাউস দিয়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি বন্ধ হচ্ছে না। শুধু মিথ্য ঘোষণায় শেষ নয়; ক্ষেত্র বিশেষে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যও দেশে প্রবেশের নজির রয়েছে। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির পেছনে রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীচক্র। তাদের সঙ্গে রয়েছে কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ। এসব কারণে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি-রপ্তানি অন্যতম সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অর্থ পাচারের সিংহভাগ ঘটনা ঘটে বাণিজ্যের আড়ালে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে। বর্তমানে অর্থাৎ করোনা চলাকালে উদ্বেগজনকহারে বেড়েছে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি। যদিও মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি একটি পুরাতন ইস্যু। অবৈধ আর্থিক প্রবাহ বন্ধে বারবার বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নিলেও কার্যকর ফল মিলছে না। আইনের ফাঁকফোকর ও কাস্টমসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে এই চক্র এখনো দেশের বিভিন্ন কাস্টমস হাউসে সক্রিয়। এই চক্র মিথ্যা ঘোষণা ছাড়াও দেশে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যও নিয়ে এসেছে। সবশেষ ঢাকার কাস্টম হাউস আইসিডি পানগাঁও এবং বেনাপোল কাস্টম হাউসে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা কয়েকটি কন্টেইনার ধরা পড়ে। সংশ্লিষ্ট কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ এবং

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব অবহেলার কারণে এই পরিস্থতি তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন এনবিআরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকতা। এর আগে দেশের কাস্টমস হাউসগুলোর কাছে মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা পণ্যের বা কারা মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য এনেছে এবং এ বিষয়ে মামলার তালিকা চায় এনবিআর। দফায় দফায় এনবিআর থেকে চিঠি দিলেও সঠিক পরিসংখ্যান মেলেনি। দেশের ৬টি কাস্টম হাউসের মধ্যে একটি বা ক্ষেত্র বিশেষে দুটি কাস্টম হাউস এই তথ্য দিলেও বাকিরা নানা অজুহাতে পূণাঙ্গ তথ্য দেয়নি। এ কারণে কার্যকর পদক্ষেপও নিতে পারছে না এনবিআর। আইন থাকলেও সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে সরকার। এনবিআরের বর্তমান প্রশাসন মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি বন্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে এগোচ্ছে।
এসব বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের কাস্টমস নীতির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য মো. মাসুদ সাদিক ভোরের কাগজকে বলেন, মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি হলে আমরা কাস্টমস আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। সাধারণত বাজেটে আইনের পরিবর্তন হয়। যদি বাজেটে এই আইনের কোনো পরিবর্তন আসে, তাহলে এনবিআর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলে জানান সরকারের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী বছরে কাস্টমসে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে বেনাপোল কাস্টম হাউসে। বেনাপোল কাস্টমসে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য ভায়াগ্রা আমদানি করা হয়। দুই অফিসারের দ্ব›েদ্বর কারণে বিষয়টি সামনে আসে। বেনাপোল কাস্টম হাউসের তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার ড. নেয়ামুল ইসলামের ভাগিনা সিএন্ডএফ এজেন্ট মো. মোয়াজ্জেম (আমিন ইম্পোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট) এই ভায়াগ্রার চালান ছাড় করান। এই ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর ড. নেয়ামুলকে বেনাপোল কাস্টমস থেকে বদলি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যুক্ত করা হয়।
শুধু নেয়ামুল নয়, পরবর্তীতে কাস্টম হাউস পানগাঁওয়ে আসে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য সিগারেট। এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স সেল (সিআইসি) বেশকটি কন্টেইনার লক দেয়। এই লক দেয়াকে ভালোভাবে নেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। পরবর্তীতে কায়িক পরীক্ষা করে কন্টেইনারে আমদানি নিষিদ্ধ সিগারেট পাওয়া যায়। এই কারণে হাউসের কমিশনার কে এম নুরুজ্জামান ও অতিরিক্ত কমিশনার জুয়েল আহমদকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। এর আগেও কাস্টম হাউসগুলোতে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি ছিল ওপেন সিক্রেট। গত বছরের বেশকিছু সিএন্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। সেই সঙ্গে দায়িত্বে অবহেলা ও যোগসাজেশের কারণে অনেক কাস্টমস কর্মকর্তার নামে বিভাগীয় মামলা ঝুলছে। আবার অনেকের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অভিযোগ না পাওয়ায় শুধু বদলি করে দায় সারছে এনবিআর।
এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, মিথ্যা ঘোষণার পণ্য আমদানি বন্ধে এনবিআরের সবার আগে প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিত করা। বিশেষ করে এনবিআরের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে এনবিআরের গোয়েন্দা ইউনিটকে আরো দক্ষ ও গতিশীল করতে হবে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গেøাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে অবৈধভাবে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি দেয়ার উদ্দেশ্যে মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি করায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশসহ ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশে সম্ভাব্য প্রায় এক দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন বা এক লাখ ৬০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে। এ সময়ে উন্নয়নশীল দেশ ও ৩৬টি উন্নত অর্থনীতির মধ্যে অবৈধ আর্থিক প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৮৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। সম্প্রতি ২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৩৪টি উন্নয়নশীল দেশের বাণিজ্য সম্পর্কিত অবৈধ আর্থিক প্রবাহ নামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে।
প্রতিবেদনে আরো দেখানো হয়, মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি উন্নয়নশীল দেশে একটি স্থায়ী সমস্যা। যার ফলে দেশ হারায় বিশাল অঙ্কের রাজস্ব এবং দেশ থেকে অবৈধভাবে অর্থ বিদেশে পাচার হয়। ২০১৮ সালে ৩৬টি উন্নত দেশের সঙ্গে চীন, পোল্যান্ড, ভারত, রাশিয়া ও মালয়েশিয়া- এই ৫টি উন্নয়নশীল দেশের সবচেয়ে মূল্য ঘাটতি চিহ্নিত করা হয়েছে। আর ২০১৮ সালে, ৩৬টি উন্নত দেশের সঙ্গে মোট বাণিজ্যের শতাংশ হিসেবে সবচেয়ে মূল্য ঘাটতি হয়েছে গাম্বিয়া (৪৫.০ শতাংশ), মালাউই (৩৬.৬ শতাংশ), সুরিনাম (৩১.৯ শতাংশ), কিরগিজস্তান (৩০.৬ শতাংশ) ও বেলিজ (২৯.২ শতাংশ)। জিএফআইয়ের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী টম কার্ডামোন বলেন, করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য টিকা ও ওষুধ কেনার জন্য যখন উন্নয়নশীল দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে তখন সেখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার শুল্ক ও কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। এটা খুবই দুঃখজনক, খুব কম সংখ্যক সরকারই এত বিশাল ক্ষতির প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়