বহুবিবাহের আইনি নীতিমালা করতে হাইকোর্টের রুল

আগের সংবাদ

অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র : উন্নয়ন সহযোগীদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা চলছে, ২০২২ সাল হবে অবকাঠামো উন্নয়নের এক মাইলফলক > জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

পরের সংবাদ

যে কোনো মূল্যে সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করতে হবে

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৭, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বেপরোয়া বাস চালনায় শোকাবহ মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশে এক দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য সৃষ্টি করে চলেছে। প্রতিদিন শুধু অঘটনের সংখ্যাই বৃদ্ধি পাচ্ছে না, সেই সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। কখনো মা-মেয়ের বাসচাপায় মৃত্যু, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বা ছাত্রীর বাসচাপায় প্রাণহানি, কখনো বাস থেকে নামা শিক্ষক পাশের বাসচাপায় নিহত।
এসব ঘটনা হরহামেশা ঘটে চলেছে, সংবাদপত্রে এসব ঘটনার বিশদ বিবরণ প্রকাশ পাচ্ছে, একাধিক পত্রিকায় নম্র ভাষায় প্রতিবাদী সম্পাদকীয় ছাপা হচ্ছে; কিন্তু তাতে কি বাসচালক কিংবা বাস মালিক- তাদের কারো চেতনায় দাগ পড়ছে না, মানবিকবোধ উসকে উঠছে না, প্রতিকারের কথা মনে আসছে না।
পরিবহন খাত এ দেশে এক ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে, এর নাম সড়ক দুর্ঘটনা। আমি এগুলোকে নৈরাজ্যিক হত্যাকাণ্ড বলে মনে করি। বাস চালনায় রীতিনীতি মানার দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি চালক যেমন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে, মৃত্যু তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করছে না, বরং গণচাপের ভয়ে একটা অঘটন ঘটিয়ে দ্রুতবেগে পালিয়ে যাচ্ছে, তেমনি বাস মালিক এতসব নির্মম ঘটনায়ও নির্বিকার, বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। নিয়মনীতি চুলোয় যাক। তাদের এই নিষ্ঠুর মানসিকতার উদাসীন শীতলতা আমার অপার বিস্ময়ের কারণ।
রাজধানীতে, এর আশপাশে এবং বিশেষ করে জনপথ তথা হাইওয়ে সড়কে দিনের পর দিন পূর্বোক্ত অঘটন ও তজ্জনিত মৃত্যুর মিছিল তৈরি হয়ে চলেছে তাতে কোনো ব্যাপক ও শক্তিমান সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে দেখছি না। ক্ষতি যাদের হচ্ছে, তারাও নির্বিবাদে সয়ে যাচ্ছেন, উচ্চ আদালতের সহৃদয় বিচারপতিদের শরণাপন্নই হচ্ছেন না।
এ উদাসীনতার কারণ কী? অর্থাভাব, ব্যবস্থাপনার অভাব, নাকি ভয়-আতঙ্ক- পাছে পাল্টা প্রবল প্রতিহিংসার ভাবনা? অনেকের দেখেছি এমন চিন্তা- ক্ষতি যা হয়েছে, তা তো আর পূরণ হওয়ার নয়, আদালতে গিয়ে আরো ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার চেয়ে মার খেয়েও নীরবে সয়ে যাওয়া বরং মন্দের ভালো। এ জাতীয় ক্লীব আপসবাদী মানসিকতা এখন সমাজে প্রবল। মার খেয়ে নীরবে সয়ে যাওয়াই এখন সামাজিক দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বহু অঘটন-ঘটন ও অন্যায় সম্পর্কে এ জাতীয় সামাজিক হীনম্মন্যতার প্রকাশ তো পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে দেখিনি। তখন প্রতিবাদটা ছিল নানামাত্রিক- সর্বাধিক ছাত্র যুবফ্রন্টে, কিছু মাত্রায় সমাজের অন্যত্র। এখনো অবশ্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিবাদের প্রকাশ প্রায়ই দেখি রাজপথে, সমান্তরাল যাত্রায় শাহবাগে। পুলিশ নিয়মিত কঠিন লাঠিপেটায় এবং অন্যান্য পদ্ধতিতে তাদের দমন করে, শায়েস্তা করে।
অবাক হই দেখে যে রাজনৈতিক দলগুলো এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সমর্থনে পথে নামে না, নেমে বিরাট আন্দোলনের জন্ম দিতে, সহায়ক শক্তি হয়ে ওঠে না। কেন? ‘ট্র্যাজিক ঘটনাগুলো কি সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যা নয়? এর তাৎপর্য কোন যুক্তিতে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে, অন্তত তাৎক্ষণিক কর্মসূচিকে স্পর্শ করে না! আমি আমার যুক্তিতে বুঝতে পারি না।

\ দুই \
এই সামাজিক-রাজনৈতিক দুর্বলতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এর ফলে পরিবহন খাতে মালিক, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃত্ব যে শক্তিমান ত্রিভুজ তৈরি করতে পেরেছে তা নানা দিক থেকে এতটা অপরিমেয় শক্তিধর যে এই ত্রিভুজের সামনে সরকারও দেখে অসহায়। তাই প্রথমোক্তরা মহাদাপটে রাজপথে ও হাইওয়েতে অরাজকতা চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো প্রকার আইনি ভয় তাদের কাবু করতে পারছে না। তাই সড়কে-মহাসড়কে মৃত্যুর লাগাতার মিছিল। এই যে পরিবহন সিন্ডিকেট, তা কি সরকারের চেয়েও শক্তিমান মিনি সরকার যে তাদের দমন করা যায় না, কিংবা তাদের নিয়ম-শৃঙ্খলা ও আইন-কানুনের আওতায় আনা যাবে না! সমাজতত্ত্ববিদ হয়তো বলবেন, ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থায় এমনটাই দস্তুর। এমন মন্তব্যের বিপরীতে আমার প্রথম কথা, বাংলাদেশ কি ধনতন্ত্রী দেশে পরিণত হয়েছে? অবশ্য যাত্রাপথটা একই চরিত্রের, কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে দূর অস্ত। দ্বিতীয়ত, যতদূর জানি উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে পরিবহন ব্যবস্থার এতটা অন্যায়, এতটা মৃত্যু, এতটা নৈরাজ্য ঠাঁই পায় না। তাহলে বাংলাদেশের সড়ক-মহাসড়ক পরিবহন ব্যবস্থায় এতটা নৈরাজ্য, এতটা স্বেচ্ছাচার কীভাবে জন্ম নিল, কোন সূত্রে কোন শক্তির হাত ধরে জন্ম নিল- এসব উৎস ও বৃত্তান্ত নিয়ে কি কোনো কিছু চলেছে? আমার তো মনে হয় না।

\ তিন \
আমি এখানে গুটিকয় খবর তথা সংবাদ চিত্রের শিরোনাম তুলে ধরছি। অবশ্য এটাও এক বিচারে অর্থহীন। কারণ এমন দিন কমই যায়, যখন কোনো সড়ক দুর্ঘটনায় নিরীহ মানুষ তথা যাত্রীর মৃত্যু ঘটে না। যেমন ‘বাসচাপায় প্রাণ গেল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের’ (২৮.১২.২০২১)। পরিবহন সিন্ডিকেটের কী শক্তি, কী স্পর্ধা, যে ‘নিরাপদ সড়কে দাবিতে শিক্ষার্থীদের দেশজুড়ে আন্দোলনের মধ্যে বাসচাপায় প্রাণ গেল আরো এক শিক্ষার্থীর।’ একই খবরে প্রকাশ, ‘নবাবগঞ্জে স্বজনের লাশ দেখতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত হয়েছেন চার জন।’ কী চমৎকার।
ঘটনা এমনই নিয়মিত যে ৭.১২.২০২১-এর একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম : ‘সড়ক দুর্ঘটনা কি চলতেই থাকবে’ (সমকাল)। সড়কে অব্যাহত অবাঞ্ছিত মৃত্যুর জের ধরে ‘প্রথম আলো’র সংবাদ শিরোনাম, ‘সড়কে মনে হয় মৃত্যুদূত চলছে’ (১২.১২.২০২১)। ক’দিন আগের (৩০.১১.২০২১) সমকালের শিরোনাম ‘এবার রামপুরায় বাসে পিষ্ট শিক্ষার্থী’।
ভাবা যায়, এভাবে নিয়মিত দিনের পর দিন সড়কে-মহাসড়কে বাসচালকের বেপরোয়া স্টিয়ারিংয়ের চালনায় অবিরাম যাত্রী-পথযাত্রীর প্রাণ যাচ্ছে। এর কোনো প্রতিকার নেই, শাস্তি নেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাই ‘কালেরকণ্ঠ-এ সম্পাদকীয় শিরোনাম : শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যবস্থা নিন’/ ‘বাস থেকে যাত্রী ফেলে দেওয়া।’
এ প্রসঙ্গে বাসের সহকারীদের উদ্ধত আচরণ এবং বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে যাত্রী ফেলে দেয়ার ঘটনা তাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। কারণ একটাই। বিচারহীনতা। এ ঘটনা দু-চারটে নয়, সংবাদপত্রে প্রায়ই তা প্রকাশিত হয়। উপলক্ষ যাত্রীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে বা কোনো কারণে সহকারীর (হেলপারের) তর্কবিতর্ক।
তর্কবিতর্ক বা মতভেদ হলেই তাকে চলন্ত বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিতে হবে? এবং এরপর বাসের দ্রুত পলায়ন। ফলাফল হতভাগ্য সেসব যাত্রীর কখনো মৃত্যু, কখনো হাড়গোড় ভেঙে পঙ্গুত্ব, ক্বচিৎ প্রাণে বাঁচা। এ ধরনের অমানবিক আচরণের কোনো প্রকার শাস্তি হয় বলে জানা যায় না।
এসবকেই বলা হয় ‘দুর্ঘটনা’। আমি এ শব্দটি ব্যবহারের ঘোরবিরোধী। দুর্ঘটনার চরিত্র আলাদা। ‘ঢালাও দুর্ঘটনা’ শব্দটি সংবাদপত্রে ব্যবহার অপরাধী চালক কিংবা তার সহকারীর পক্ষে যায়। রিপোর্টার সাংবাদিক এবং সম্পাদক বন্ধুদের প্রতি আহ্বান জানাই ‘দুর্ঘটনা’ শব্দটি ভেবেচিন্তে সঠিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে।
এবার মূল কথায় আসি। দীর্ঘদিন যাবৎ সড়কে-মহাসড়কে বাসচালক ও সহকারীদের উচ্ছৃঙ্খলতা চলছে, বন্ধ হচ্ছে না এত লেখালেখি ও শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী মিছিল সত্ত্বেও। এ ব্যাপারে পূর্বোক্ত সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘চালক ও সহকারীরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসছে না। যাত্রীদের জীবনের কোনো মূল্য তাদের কাছে আছে বলে মনে হয় না।… দেশের প্রচলিত আইনের প্রতি পরিবহন শ্রমিকরা একেবারেই শ্রদ্ধাশীল নন।… এ ধরনের ঘটনা চালক ও সহকারীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে’ (২৯.১১.২০২১)।
আমরা এ বিষয়ে একমত। শুধু তাই নয়, চালকের বেপরোয়া চালনার ফলে সংঘটিত মৃত্যুকে ‘দুর্ঘটনা’ বলা যাবে না। নিয়ম-শৃঙ্খলাবিহীন চালনার ফলে ঘটিত মৃত্যুও এক প্রকার খুন। এসব ক্ষেত্রে চালকের কঠোর শাস্তি, চরম শাস্তি হওয়া উচিত সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে। তা না হলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলতে থাকবে। সেটা নিশ্চয়ই সরকারের কাম্য নয়। তাই অবিলম্বে সঠিক তদন্ত, সঠিক বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা নিতে হবে। এটাই আরো কিছু ব্যবস্থার সঙ্গে সড়কে-মহাসড়কে মৃত্যু বন্ধের একমাত্র উপায়।
আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়