কাগজ প্রতিবেদক : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সামরিক জাদুঘর শুধু প্রদর্শনীর জন্য না, এটা দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। তারা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দিতে আগ্রহী হবে, এগিয়ে আসবে। গতকাল বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে রাজধানীর বিজয় সরণিতে অবস্থিত সামরিক জাদুঘর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানের জাদুঘরপ্রান্তে বক্তব্য রাখেন সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনীপ্রধান অ্যাডমিরাল এম শাহীন ইকবাল, বিমানবাহিনীপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রমুখ। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
জাদুঘর উদ্বোধন করে নিজেকে ধন্য মনে করছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি সশস্ত্র বাহিনীর জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং আমাদের তিন বাহিনী সম্পর্কে আমাদের তরুণ প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হবে। সম্যক জ্ঞান পাবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীসহ সশস্ত্র বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সদস্যদের মধ্যে একটি প্রেরণা আসবে। তারা তৃপ্ত হবেন।
সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার পেছনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পরে জাতির পিতা সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী গঠন করেন। তাদের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। সাড়ে তিন বছর সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য তিনি কাজ করেছেন। যুদ্ধ ক্ষতবিক্ষত দেশকে তিনি শূন্য থেকে দাঁড়িয়ে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রাম পর্যায়ে উন্নয়ন এবং গ্রামের জনগণ যাতে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন তার জন্য বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেটা তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। একই সঙ্গে আমার মা ও ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমার ছোট ভাই রাসেলের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সেনা অফিসার হবে। তার সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। তাকেও হত্যা করা হলো। আমরা আপনজন হারিয়েছিলাম এটা সত্য, কিন্তু বাংলাদেশ কী হারিয়েছিল? একের পর এক ক্যু হয়েছে। শত শত সেনাকর্মকর্তাকে জীবন দিতে হয়েছে। অনেক পরিবার এখনো তাদের খোঁজও পায়নি। পাশাপাশি রাজনৈতিক

নেতাদের ওপর চলে অত্যাচার-নির্যাতন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল তার থেকে বিচ্যুত হয়। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থেমে যায় যা কখনো হওয়ার কথা নয়।
সরকারপ্রধান বলেন, ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে উন্নয়ন, প্রযুক্তি জ্ঞান বৃদ্ধি এবং বিশ্ব দরবারে যেন তারা মাথা উঁচু করে চলতে পারে সেইভাবে আমরা পদক্ষেপ নিই এবং বাস্তবায়ন শুরু করি। সাধারণ মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে আমরা কাজ করি। ভাগ্য পরিবর্তনে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিই। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বেসরকারি খাতগুলো উন্মুক্ত করে দেই। সরকার জনগণের সেবক সেটা প্রমাণ করতে পারি।
সামরিক জাদুঘরের গুরুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের যে ইতিহাস রয়েছে তা স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতীক সশস্ত্র বাহিনী দেশের মানুষ যেন সে সম্পর্কে জানতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে, আমাদের সামরিক বাহিনী অর্থাৎ সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী কী কাজ করে, কীভাবে চলে বা অতীতে তারা কী করেছে সে বিষয়ে মানুষকে জানানো একান্তভাবে দরকার। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা, একই সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে জানা দরকার। আজকে যে সামরিক জাদুঘরটি আমরা দেখছি এটি প্রথমে নির্মিত হয়েছিল খুব ক্ষুদ্র পরিসরে। বিজয় সরণির পাশের জায়গাটিতে এটি নির্মাণ করা হয়। আমার খুব আকাক্সক্ষা ছিল এটিকে খুব আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে গড়ে তোলার। তারই পাশে আরেকটি জায়গায় আমি প্রথমবার যখন সরকারে আসি, প্ল্যানেটোরিয়াম করে ফেলি। যে কোনো কাজ আমি প্রথমবার যখন করতে গেছি, প্রতিটি ব্যাপারেই কিন্তু পরবর্তী সরকার এসে আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। প্ল্যানেটোরিয়াম যখন আমি করলাম এর জন্য আমার বিরুদ্ধে দুটো মামলা দেয়া হয়েছিল। কেন দেয়া হয়? আমি ঠিক জানি না। আমরা যখন প্ল্যানেটোরিয়াম করেছি, তখনই সমস্ত ইউটিলিটি যেন সামরিক জাদুঘর এবং প্ল্যানেটোরিয়াম উভয়েই শেয়ার করতে পারে সে ব্যবস্থাও নিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, সরকারপ্রধান হিসেবে বিভিন্ন সময় বিদেশে যখন আমরা যাই বা কোনো সরকারপ্রধান যখন আমাদের দেশে বেড়াতে আসে তখন যে উপহার দেয় সেগুলো সংরক্ষণ করা এবং দৃষ্টিনন্দনভাবে রাখা ও মানুষের সামনে তুলে ধরার ব্যবস্থাও করি। আমাদের যে তোষাখানা জাদুঘর আছে বঙ্গভবনে, সেখানে স্টোর রুমের মতো জিনিসপত্রগুলো রাখা। সেগুলো মানুষকে দেখানোর ব্যবস্থা আমি নিয়েছি। এজন্য এই জায়গায় আমরা তোষাখানা জাদুঘরও নির্মাণ করি। এটা সামরিক বাহিনীর হাতেই দিয়েছিলাম, একটা কমিটিও আমরা করে দেই। সেই সঙ্গে সামরিক জাদুঘরটাকেও অত্যন্ত আধুনিক করে গড়ে তোলা এবং এটা যেন দৃষ্টিনন্দন হয় সারা বিশ্বের যত সামরিক জাদুঘর হয়েছে, তার মধ্যে যেন শ্রেষ্ঠ জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় সেটাই আমার আকাক্সক্ষা ছিল। আমি এই জাদুঘরটি এখনো সরজমিনে দেখিনি, প্রাথমিক পর্যায়ে যখন কাজ শুরু হয় তখন কিছুটা দেখেছি, যখন যতটুকু ডেভেলপ হয়েছে আমি ছবিতে দেখেছি এবং যখন যেটা নির্দেশনা দেয়ার আমি দিয়েছি, কিন্তু যতটুকু এখন দেখলাম আমি মনে করি, এটা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ, সুন্দর, আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন একটি সামরিক জাদুঘর। কাজেই সেভাবে এটি তৈরি হোক সেটাই আমি চাই।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরটি বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের পশ্চিম পাশে ১০ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে। যেখানে স্বাধীনতার আগে ও পরে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উপস্থাপন করা হয়েছে। জাদুঘরটিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর জন্য নির্ধারিত গ্যালারিসহ ৬টি পৃথক অংশ রয়েছে। প্রতিটি বাহিনীর গ্যালারিতে রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নার। এখানে আর্ট গ্যালারিসহ মাল্টিপারপাস এক্সিবিশন গ্যালারি, ব্রিফিং রুম, স্যুভেনির শপ, ফাস্টএইড কর্নার, মুক্তমঞ্চ, থ্রিডি সিনেমা হল, মাল্টিপারপাস হল, সেমিনার হল, লাইব্রেরি, আর্কাইভ, ভাস্কর্য, মুর‌্যাল, ক্যাফেটারিয়া, আলোকজ্জ্বল ঝরনা ও বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত প্রান্তর সবকিছু মিলে একটি চমৎকার দৃষ্টি নন্দন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।