নৌপুলিশের অভিযান : ৩৫ লাখ মিটার জাল জব্দ

আগের সংবাদ

পঞ্চম দফায়ও সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা > ভোটে ঝরল আরো ১১ প্রাণ : পুলিশের গাড়িতে আগুন, আহত শতাধিক, আটক অর্ধশত

পরের সংবাদ

নতুন কারিকুলাম নিয়ে তালগোল : কাজ চলছে এনজিওর প্রেসক্রিপশনে > কমিটি থেকে ৪ বিশেষজ্ঞের পদত্যাগ > বই ছাপা হয়নি তবু পাইলটিং

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৫, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

অভিজিৎ ভট্টাচার্য : ইউনিসেফের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং অনভিজ্ঞ লোকদের নিয়ে নতুন কারিকুলাম (শিক্ষাক্রম) প্রণয়ন করছে সরকার। বিদেশি শিক্ষাব্যবস্থার আদলে তৈরি হওয়া নতুন কারিকুলাম এ দেশে কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য হবে তা নিয়ে এখনই প্রশ্ন উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এসব হঠকারী সিদ্ধান্তে কারিকুলাম কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছেন চার বিশেষজ্ঞ। পাশাপাশি নতুন কারিকুলামে বই লেখার দায়িত্ব পেয়েছেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের ডেস্ক অফিসার ও ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষকরা। ভোরের কাগজের অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
২০২৩ সাল থেকে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরুর লক্ষ্যে চলতি বছর মাধ্যমিক স্তরের ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং করা হবে। প্রাথমিকে কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং হবে তা এখনো জানানো হয়নি। অথচ দুই বছর আগে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, অন্ততপক্ষে ২০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাইলটিং হবে। কিন্তু এনসিটিবির এমন তালগোল পাকানো কাজের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এছাড়া পাইলটিংয়ের জন্য বই প্রস্তুত না করায় চার মাস পর পর শিখন উপকরণ দিয়ে ১২ মাস পাইলটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, যা শুরু হচ্ছে ফেব্রুয়ারি থেকে। কারিকুলাম প্রণয়ন ও পাঠ্যবই লেখার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে অভিজ্ঞ অধ্যাপকদের দিয়ে নতুন কারিকুলামে পাইলটিংয়ের ফলাফল সংগ্রহ করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফল সুষ্ঠুভাবে পর্যালোচনা করার পর যেন নতুন কারিকুলাম দেশজুড়ে বাস্তবায়ন হয়। কারণ শিক্ষায় ধীরে ধীরে পরিবর্তন করতে হয়। যারাই একসঙ্গে পুরো ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে গেছে তাদেরই

সর্বনাশ হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ থেকে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণির নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হবে। প্রথম বছর ২০২৩ সালে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হবে নতুন বই। এ লক্ষ্যে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাইলটিং হবে প্রাথমিক স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির। ২০১২ সালে প্রণীত শিক্ষাক্রম চলছে এখন। প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নবায়ন করা হচ্ছে। অন্য শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করা হচ্ছে। পুরোপুরি নবায়ন করা হচ্ছে মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কারিকুলাম হচ্ছে শিক্ষার পরিকল্পনা। এতে দুর্বলতা থাকলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পুরো বিষয় দেখে সংশ্লিষ্টদের মনে হয়েছে, এনসিটিবি জাতির ক্ষতি করার জন্য নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করছে। বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) নির্দেশিকাতেই নতুন কারিকুলাম তৈরি করছে। এমন শিক্ষাক্রম নিয়ে খোদ এনসিটিবিতেই বিরোধ দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান, অধ্যাপক ড. মরিয়ম বেগম ও ইংরেজির অধ্যাপক ড. শায়লা সুলতানা, অধ্যাপক ড. গৌতম রায় কারিকুলামের কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এর পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, এনজিও কর্মকর্তা মিলে নতুন কারিকুলামের কাজ করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান নিজেই অতি উৎসাহী হয়ে এমন লোকদের দিয়ে কারিকুলামের কাজ করাচ্ছেন। এজন্য প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের টাকায় তিনি সুইডেন ও পরে ডেনমার্ক ঘুরে আসেন। বর্তমানে ইউনিসেফ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও টিকট্যালিক নামে তিনটি এনজিওর তত্ত্বাবধানে নতুন কারিকুলামে পাঠ্যবই লেখার কাজ চলছে। পাঠ্যবই লেখার কাজ শেষ না হলেও এনসিটিবি বলছে আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের ৬০টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর পাইলটিং শুরু হবে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ এই পদ্ধতির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে। অথচ এই মশিউজ্জামান এখন এনসিটিবির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য জোর তদবির করছেন।
নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, শিক্ষাক্রম পরিমার্জন, নবায়ন কার্যক্রম, জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির (সিডিআরসি) সঙ্গে সমন্বয় রক্ষায় গঠন করা ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর আহ্বায়ক এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান। অভিযোগ রয়েছে, ১৫ সদস্যের ওই গ্রুপের ছয়জন সদস্যকে একপাশে সরিয়ে ইউনিসেফ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রতিনিধিসহ অন্য সদস্যদের নিয়ে কারিকুলাম তৈরির কাজ হচ্ছে। এনজিও প্রতিনিধিরা যে পরামর্শ দিয়েছেন সেটাই করছেন অধ্যাপক মশিউজ্জামান। তবে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এনজিওদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেছেন তিনি। তবে এসব ঘটনাকে আংশিক সত্য বলে জানিয়েছেন।
জানতে চাইলে এনসিটিবির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও সদস্য (শিক্ষাক্রম) প্রফেসর মো. মশিউজ্জামান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, যারা এতদিন কারিকুলামের বড় বড় কাজ কুক্ষিগত করে রাখতে চেয়েছিল তারা এবার সেই সুযোগ পায়নি। সেটা না পেয়েই পেশাগত ঈর্ষা থেকে কারিকুলাম নিয়ে মিথ্য প্রচারণা চালাচ্ছে। আমরা শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর নির্দেশেই নতুন কারিকুলামে পাঠ্যবই লেখার কাজ করছি। তিনি এও বলেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের টাকায় বিদেশ যাননি। সরকারি একটি অনুষ্ঠানে তিনি সুইডেন গিয়েছেন। এরপর ছুটি নিয়ে তিনি ডেনমার্ক ঘুরে আসেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ভালো রাজনীতিক, ভালো বিতার্কিক, চিকিৎসক- সর্বোপরি দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়েছেন। তিনি কীভাবে এই দেশে বাস্তবায়নযোগ্য নয় এমন কারিকুলামের অনুমোদন দেন? তবে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি সাড়া দেননি।
উল্লেখ্য, চলমান কারিকুলাম বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষকরা ক্লাসরুমে তা কাজে লাগাননি। ফলে চলমান শিক্ষা ব্যবস্থা নোট-গাইডনির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসন্ন কারিকুলামেও শিক্ষকরা পাঠদান করাতে পারবেন না। বিদ্যমান শিক্ষাক্রমে পাঠ্যবইকে টেক্সটবুক বলা হলেও নতুন শিক্ষাক্রমে বলা হচ্ছে স্টুডেন্ট রিসোর্স বুক। শিক্ষক সহায়িকাকে বলা হচ্ছে টিচার রিসোর্স বুক। অথচ দেশের বেশির ভাগ শিক্ষক টিচার্স গাইড খুলেও দেখেন না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে ১৯৮০’র দশকে প্রথম কারিকুলাম তৈরি হয়। দ্বিতীয় কারিকুলাম প্রণীত হয় ১৯৯৫-৯৬ সালে। এর ১৭ বছর পরে ২০১২ সালে দেশে তৃতীয়বার কারিকুলাম পরিবর্তন হয়। ওই সময়ে কারিকুলাম পরিবর্তনের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান, অধ্যাপক ড. কবীর চৌধুরীর কন্যা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শাহীন কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হামিদুর রহমান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল, বুয়েটের অধ্যাপক ড. কায়কোবাদ, কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট উইংয়ের (সিডিডব্লিউ) অধ্যাপক গৌতম রায়সহ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা। সবমিলিয়ে ২০১২ সালের কারিকুলাম প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের সম্মিলন ছিল। কিন্তু ২০২১ সালে কারিকুলাম পরিবর্তনের কাজে এদের কাউকে রাখা হয়নি। পাঠ্যবই লেখার কাজে ড. জাফর ইকবালকে রাখা হয়েছে। ড. ছিদ্দিকুর রহমানকে রাখা হলেও তিনি ছেড়ে চলে যান। বাকিদের নামই নেই।
২০১২ সালের কারিকুলাম প্রণয়নের পর শিক্ষার আরেকটি প্রকল্প ‘সেসিপের’ মাধ্যমে ২০১৭ সালে এটি রিভিউ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সরকারের অর্থ ছাড়ে দেরি হওয়ায় সেই রিভিউ আর হয়নি। এরপর ঠিক হয় ২০১২ সালের কারিকুলাম রিভিউয়ের কাজটি করবে শিক্ষার আরেক প্রকল্প ‘এসইডিপি’। এসইডিপি রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নিলে সেসিপ আর কাজটি করেনি। ২০১৯ সালে এসে এনসিটিবি জানায়, ‘এসইডিপি’ নয়, রিভিউয়ের কাজটি এনসিটিবি নিজেরাই করবে। তখনই এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান নিজের বলয়ের লোকদের মাধ্যমে রিভিউ কাজ শুরু করেন। এসময় তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এনসিটিবিতে কাজ করে যাওয়া আরেক কর্মকর্তা মুর্শিদ আক্তারের। অভিযোগ রয়েছে, এই মুর্শিদ আক্তার এনসিটিবিতে কাজ করলেও অদক্ষ এবং অতি উৎসাহী হওয়ার কারণে ২০১২ সালের কারিকুলাম কমিটি থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। এর কিছুদিন পর তিনি পদোন্নতি পান এবং এনসিটিবি থেকে বদলি হয়ে কলেজে চলে যান। সেখান থেকে লিয়েনে তিনি প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের শিক্ষা বিভাগে যোগ দেন। কিন্তু মশিউজ্জামানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হওয়ায় মুর্শিদ আবার ফিরে আসেন। এরপর মশিউজ্জামান সুইডেন ও ডেনমার্ক সফরে যান। দেশে ফিরে আসার পর মুর্শিদই মশিউজ্জামানকে ধারণা দেন, কারিকুলামের কাজে বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞদের কনসালটেন্ট হিসেবে আনার দরকার নেই। তারা সম্মানি বেশি নেন এবং কারিকুলামে তাদের মতামত চাপিয়ে দেন। তাদের মতামত কেন শিক্ষার্থীরা পড়বে? এমন পরিস্থিতিতে মুর্শিদ আক্তারের লিয়েনের মেয়াদ শেষ হয় এবং গবেষণা কর্মকর্তা পদে এনসিটিবিতে ফিরে আসেন তিনি। মুর্শিদ এনসিটিবিতে পদায়ন পেয়েই মশিউজ্জামানকে ধারণা দেন, কারিকুলামের কাজে সরকারের লোক নেয়ার দরকার নেই। এরা করিৎকর্মা হয় না। এনজিওর লোকদের নিয়ে কাজ করালে স্মার্ট কারিকুলাম হবে। এরপরই মুর্শিদের মাধ্যমে ইউনিসেফের সম্পর্ক গড়ে উঠে মশিউজ্জামানের। প্রসঙ্গত, ইউনিসেফ এর আগে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে ছোট ছোট কাজ করলেও এত বড় কাজ কখনোই করেনি। এবারই প্রথম তারা তাদের প্রেসক্রিপশনে কারিকুলাম প্রণয়ন করে দিয়েছে। ইউনিসেফের শিক্ষা বিভাগে কাজ করা ইকবাল হোসেনের সঙ্গে মশিউজ্জামানের সম্পর্ক আরো গাঢ় হয়ে উঠে। অথচ ইকবাল হোসেন পদার্থ বিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। শিক্ষা নিয়ে তার কোনো ডিগ্রি নেই।
এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, কুমিল্লার বার্ডে বসে সরকারের টাকা কম খরচে ২০১২ সালের কারিকুলাম প্রণয়ন করে দিয়েছে। অথচ এবার এনজিওর প্রতিনিধিরা রাজেন্দ্রপুর ও সাভারে অবস্থিত ব্র্যাক সিডিএমে বসে কারিকুলাম প্রণয়ন করেছেন। এতে সরকারের কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
ইউনিসেফ যখন কারিকুলামের কাজ করছে তখন ইউনিসেফের ইকবাল হোসেন ‘টিকট্যালিক’ নামে আরেক পারিবারিক এনজিওকে এখানে ভেড়ান। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে বছর দুয়েক শিক্ষকতা করা নাসরিন সুলতানা মিতু এই ‘টিকট্যালিক’ এনজিওর মালিক। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জামাতা রাকিব উদ্দিন। এরপর মিতু তাদের দলে টেনে আনেন তারই বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক ড. রুবায়াত জাহানকে। রুবায়াত জাহান দলে টেনে আনেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিক আহসানকে। এদের সঙ্গে যোগ দেন কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক ও শেষবর্ষে অধ্যয়নরত কিছু শিক্ষার্থী। সংশ্লিষ্টরা বলেন, অধ্যাপক মশিউজ্জামান, মুর্শিদ আক্তার মিতু, ইউনিসেফে কর্মরত ইকবাল হোসেন, টিকট্যালিক এনজিওর মালিক নাসরিন সুলতানা মিতু, রুবায়াত কিংবা তারিক আহসান- এদের কারোরই কারিকুলাম লেখার অভিজ্ঞতা নেই। তবু তারা কারিকুলামের কাজ করেছেন; এখন তাদের মনোনিত ব্যক্তিরাই পাঠ্যবই লেখার কাজ করছেন।
জানতে চাইলে ইউনিসেফের শিক্ষা কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার আমাদের কাছে সাহায্য চেয়েছে। তাই আমরা সাহায্য করছি। এখানে এনজিওর প্রেসক্রিপশনে কিছু লেখা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনজিও দলটি কারিকুলামের কাজ শুরুর সময়ই ঘোষণা দেয়, এনসিটিবির কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট উইংয়ে কর্মরত বিশেষজ্ঞদের রাখবে না। অথচ কারিকুলামের কাজে এই বিশেষজ্ঞরা দক্ষ ও উপযুক্ত। এই উইংকে দুর্বল করে তারা তাদের মতো করে কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে। অন্যদিকে এনজিওর লোকেরা এনসিটিবিতে প্রচার করেছেন, কারিকুলাম প্রণয়নের কাজে তাদের চেয়ে দক্ষ আর কেউ নেই। এজন্য এনসিটিবির বিশেষজ্ঞদের এখানে রাখেনি তারা। এমন প্রচারণায় এনসিটিবির বেশির ভাগ কর্মকর্তা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। সদস্য (শিক্ষাক্রম) মো. মশিউজ্জামানের সঙ্গে শুরু হয় বিরোধ। এরপর এনসিটিবির ১০ জন করে বিশেষজ্ঞকে কারিকুলাম কমিটিতে নেয়া শুরু হয়। কিছুদিন ১০ জন কাজ করার পরে এদের বাদ দিয়ে নতুন করে আরো ১০ জন নেয়া হয়। এভাবে চলতে থাকে কাজ। কিন্তু কারিকুলাম নিয়ে কী কাজ হচ্ছে, তা এনসিটিবির কেউ বলতে পারেনি। শুরু হয় সমন্বয়হীনতা। ইংরেজি কারিকুলাম সমন্বয়ের দায়িত্ব পান প্রাণীবিজ্ঞান থেকে পড়াশোনা করে আসা একজন কর্মকর্তা।
অনুসন্ধানে এও জানা গেছে, অধ্যাপক গৌতম রায় ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ের কারিকুলাম প্রণয়ন করেন। কিন্তু সেই কারিকুলামে আপত্তি তুলেন মুর্শিদ আক্তার। তিনি সেটি এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানের মাধ্যমে কারিকুলাম রিভিউয়ের সিদ্ধান্ত দেন। এজন্য দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক ড. শায়লা সুলতানা ও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মরিয়ম বেগমকে। তারা কারিকুলাম দেখে ঠিক বললেও মুর্শিদ আক্তারের পছন্দ হয়নি। তিনি অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানকে দিয়ে সিনিয়র অধ্যাপকদের দ্বারা রিভিউ করা কারিকুলামকে আবার রিভিউ করার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক ড. রুবায়াত জাহানের কাছে পাঠান। জুনিয়র শিক্ষকের কাছে ইংরেজির প্রণীত কারিকুলাম রিভিউয়ের জন্য পাঠালে অধ্যাপক শায়লা সুলতানা ও অধ্যাপক ড. মরিয়ম বেগম এই কাজ থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন। অন্যদিকে অধ্যাপক গৌতম রায়কে ইংরেজি কারিকুলাম প্রণয়নের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে হিন্দু ধর্মের কারিকুলাম লেখার ভার দেয়া হয়। এই ক্ষোভে তিনিও এই কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। অথচ ২০১২ সালের কারিকুলাম প্রণয়নে অধ্যাপক গৌতম রায়ের বড় ভূমিকা ছিল।
জানতে চাইলে অধ্যাপক শায়লা সুলতানা ভোরের কাগজকে বলেন, সরে আসার নিশ্চয়ই কয়েকটি কারণ ছিল। তবে এখন আর সেই কারণগুলো নিয়ে কিছু বলার নেই, আর বলতে চাইও না। অধ্যাপক ড. মরিয়ম বেগম বলেন, ইংরেজি কারিকুলামটি তারা যেভাবে লিখেছেন তাতে আমারই বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। আমিই যেখানে এটি বুঝতে পারিনি সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কর্মরত শিক্ষকরা এই কারিকুলামে কীভাবে পাঠদান করবেন- এমন প্রশ্ন তোলায় ওরা আমাকে আর এই কাজে ডাকেনি। শুনেছি আমাদের ছাত্ররা নতুন কারিকুলামের কাজ করছে ও পাঠ্যবই লিখছে। তিনি বলেন, আমাদের ছাত্ররা অবশ্যই মেধাবী। আমি দেখার অপেক্ষায় আছি তারা কী বই লেখেন। তখনই বুঝতে পারব কী হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়নে সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম (সেসিপ) কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও শিক্ষাক্রম প্রণয়নে এসব কর্মকর্তাদের রাখা হয়নি। বাদ দেয়া হয়েছে কারিকুলাম ডেভেলপমেন্ট উইংকেও। অন্যদিকে অখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও রাখা হয়েছে শিক্ষাক্রম প্রণয়নে। মাধ্যমিকের শিক্ষাক্রমে ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা শিক্ষকও রাখা হয়েছে। বাছাই করা হয়েছে পছন্দের লোক। এসব পরিস্থিতিতে ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির প্রধান চালিকা শক্তি ও ২০১২ সালে কারিকুলামে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান নিজেই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কমিটি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। ১০ বছর আগে প্রণীত কারিকুলামের প্রধান যিনি ছিলেন তিনিই নতুন কারিকুলামের কাজ থেকে অব্যাহতি নেয়ায় বড়সড় প্রশ্ন উঠেছে।
জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ২০১২ সালের কারিকুলামে আমিই প্রধান ছিলাম। দেশি কিংবা বিদেশি কোনো নেতৃত্ব ছিল না। ছিল না কোনো প্রেসক্রিপশন। নুতন কারিকুলামের আলোচনা শুনে এবং তাদের কারিকুলামের উপকরণ দেখে আমার যা মনে হয়েছে, মাঝপথে আমি ঢুকলে সেটাকে সুগঠিত করা কঠিন হবে। কমিটিতে থেকে যদি মতামতের প্রতিফলন না ঘটে, শুধু নাম রাখার জন্য থাকাটা ঠিক হবে না। তাই অব্যাহতি নিয়েছি। তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামের অনেক কিছুর সঙ্গে একমত থাকলেও বহু কিছুর সঙ্গে একমত নই। অনেক নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যেগুলো বাস্তবায়ন করা আমার কাছে কঠিন মনে হয়েছে। পাশাপাশি উন্নত বিশ্বের কারিকুলাম ডাউনলোড করে চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামে যোগ্যতাভিত্তিক কিংবা অভিজ্ঞতাভিত্তিক যেসব বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তার অন্তত ৮০ শতাংশ ২০১২ সালের কারিকুলামেই রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের কারণে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। তিনি বলেন, নতুন কারিকুলামে পাইলটিং হবে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অর্থাৎ অভিজ্ঞ শিক্ষকদের দিয়ে পাইলটিংয়ের ফলাফল সংগ্রহ করে দেশজুড়ে তা বাস্তবায়নের কথা বলেছেন এই অধ্যাপক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়