মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র : মাইন বিস্ফোরণে তিন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী আহত

আগের সংবাদ

সংসদ প্রাণবন্ত করার তাগিদ : বিশ্লেষকদের মতে, ‘৭০ ধারা বড় বাধা’, সংশোধনীর দাবি, কার্যকর বিরোধী দলের বিকল্প নেই

পরের সংবাদ

যে শহরে আমি নিঃসঙ্গ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ৩, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। রাইটার ক্লাবের সামনেই বাসস্ট্যান্ডটা। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। শূন্য ও নীরব মনে হচ্ছে চারপাশ। জিহ্বা খসখস করছে। ঠোঁট দুটো শুকিয়ে এক্কেবারে মরুভূমি। একটার পর একটা বাস কয়েক মুহূর্ত স্টপেজ দিয়ে দ্রুত চলেও যাচ্ছে। যাত্রী ছাউনির নিচে গিয়ে বসে পড়লাম। আমি তখন একাকিত্ব খুঁজতে লাগলাম। চলমান একমুঠো একাকিত্ব। সিগারেট ধরালাম। জ¦লন্ত সিগারেটের ধোঁয়ার মাঝেও নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে অস্থির হয়ে উঠছি অনবরত। অনেক ধকল সহ্য করতে হয়েছে আজ রাইটার ক্লাবে। কবি লেখকদের মাসিক মিটিংয়ে এলেই আমার এমন হয়। মুখটা ঘামছে খুব। রুমালে মুখ সেধিয়ে ঘামগুলো মুছে নিলাম। শরীরজুড়ে রাজ্যের ক্লান্তি। গলা শুকিয়ে কাঠ। এই মুহূর্তে ফ্রিজে রাখা একটা কোল্ড ড্রিংক্স হলে ভালোই হতো। চোখ বুজে আসছে। থেকে থেকে দমকা বাতাসে তিরতির করে কাঁপছে আমার মাথার পাতলা চুলগুলো। নাহ, এভাবে হয় না! উঠে পড়লাম সেখান থেকে। বাসস্ট্যান্ড এরিয়াতেই একটা ল্যাম্পপোস্ট আছে। রাতে বেশ আলোকময় করে রাখে বাসস্ট্যান্ডটাকে। ওটার নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছি। যদিও পাবলিক প্লেসে এটা দণ্ডনীয় অপরাধ। তো কী করব? ফেলে দিলাম সিগারেটটা। পকেট থেকে টিস্যু বের করে ঠোঁট দুটো মুছে নিয়ে একটা চুইংগাম চিবোতে লাগলাম। বাতাস তখন ভেজা ভেজা। বৃষ্টি আসবে নাকি? ভালোই হতো তাহলে। ভিজতে ভিজতে বাসায় ফিরতাম। আবাসিক কম্পাউন্ড ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটা হয় না বহুদিন।

২.
এত রাতে গলির মোড়ে কুকুরগুলো অযথাই ঘেউ ঘেউ করছে। ভারি বিদঘুটে ও ক্ষ্যাপাটে সেসব শব্দ। মেহেরুন তখনো ঘুমিয়ে। আমি ঘুমাইনি। করিডরে এসে দাঁড়ালাম। কী নিস্তব্ধ, কী শান্ত, কী মুখিয়ে থাকা আবাসিক এলাকাটা! দূরে কোথাও কুকুরগুলো হয়তো বা কামলীলায় নিজেদের আতৃপ্ত করছে। পাশের ফ্ল্যাটের দু-একটা রুমে টেবিলল্যাম্পের আলো দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ে আছি ওদিকে। কী দেখছি, জানি না। ঢোক গিললাম। গলাটা ব্যথা করছে। শেকড়-টেকড় গজাবে না তো? যা হয় হোক। শুয়ে পড়ব নাকি এখন? নাহ, থাক! আরেকটু ওয়েট করি এখানে। মেহেরুন একটু আরাম করে ঘুমাক। সারাদিন কত ব্যস্ততা ওর। হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে সংসারের যাবতীয় কাজ, স্বামী-সন্তান সামলানো, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা- সবার জন্য কত করে বেচারি। রোগীদের সেবা করে এসে আবার সংসার সেবা- চাট্টিখানি কথা? ওকে কতবার বললাম- নার্সের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই থাকো। নাহ, সে চাকরি ছাড়বে না। করবে যখন, করুক। কষ্টটা তো আর আমার হবে না। আমি তো বরাবর সংসারবিবাগী, সন্ন্যাসী। মনে হচ্ছে রাতের নিকষ অন্ধকার আমার বুকটাকে খামচে ধরছে তার নিজের মতো করে। সারারাতের জমাট নিশ্বাস আমাকে কাবু করতে চাইছে। রীতিমতো হাঁ করে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করলাম। রাত যত গভীর হয়, তত আমার অ্যালার্জির উপদ্রব বাড়তে থাকে। শেষ রাতে খুশখুশি কাশি শুরু হয়। ভোর পর্যন্ত চলে। রাত জাগলে নাকি এমনটিই হয়।

৩.
শুয়ে আছি। গরম লাগছে খুব। শহরজুড়ে লোডশেডিং চলছে। দুপুরের দিকে বিশ্রাম নেয়ার সময় লোডশেডিং চললে মেজাজটা বিগড়ে যায়। চরম ক্লাইমেক্সযুক্ত সময় এটা। নিজেকে আলাদাভাবে অনুবাদ করার ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছি না। ইলেকট্রিসিটি ছাড়া প্রতিটি মুহূর্তকে ধোঁয়াশা এবং শ্বাসরুদ্ধকর মনে হয় আমার কাছে। লোডশেডিং ইদানীং রোজই চলছে। বালিশ ছেড়ে উঠে বসলাম। সিটি করপোরেশনের আওতাধীন আমাদের এই আবাসিক এলাকাটা হওয়ার কথা ছিল একটি মানচিত্রের মতো, একটি খণ্ডিত নির্মল ভূমির মতো। যাক গে! আবার শুয়ে পড়লাম। কোথায় যাব এখন? বিকাল হলে না হয় শহীদ মিনার কিংবা টিএসসির ওদিকটায় ঘুরতে বের হতাম। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। আজকাল বড্ড অস্বস্তি ফিল করি। বয়স বাড়ছে, তাই? নাকি ভেতরকার ভালোলাগাগুলো দিন দিন মরে যাচ্ছে, সেজন্য? বুঝতে পারি না এখন অনেক কিছুই। সকালের দিকে একবার বাইকে করে মেহেরুনকে হাসপাতালে রেখে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিলাম অ্যালার্জির জন্য। একগাদা টেস্ট দিয়েছে। রিপোর্ট নিয়ে সন্ধ্যার পর আবার যেতে বলেছে। ভীষণ ডিজগাসটিং! টেস্টের কাঁথায় আগুন। অতসত ধৈর্য নেই আমার। মাঝে মাঝে চোখ লাল হয়ে থাকে অ্যালার্জির কারণে। তাছাড়া রাত জাগলে চোখের নিচে কালি জমে। গাল-মুখ ভেঙে যায়। তবু আমি রাত জাগি। রাত জেগে জেগে একটি গভীর ও সংবেদনশীল হৃদয়ের সঙ্গে কথা বলি অবিরাম।
৪.
কলিংবেলটা বেজে উঠল। বারবার বাজছে। একটু থিতু হয়ে দরজাটা খুলে দিলাম। মেহেরুন ডিউটি থেকে বাসায় ফিরল। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। সেটা তো রোজই দেখা যায়। আমাকে জিজ্ঞেস করল- বাবুকে খাইয়ে দিয়েছ? অফিসে গিয়েছিলে?
– হ্যাঁ, হালকা করে উত্তর দিলাম।
– বাবা-মা কোথায়?
– মা তো তার রুমে। বাবা ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে ডাক্তারের চেম্বারে।
– ওহ, তুমি যাওনি কেন? বাবার সঙ্গে তোমার টেস্টগুলোও করাতে।
– আমি পারব না। ডাক্তারের ঝামেলা আমার ভালো লাগে না।
– কী যে বলো না তুমি! চিরকাল কি এভাবেই থেকে যাবে? নাকি নিজেকে একটু চেঞ্জ-টেঞ্জ করার চেষ্টা করবে?
– দরকার নেই। তুমি তো আছোই।
আমার এই কথা শুনে হাসতে লাগল মেহেরুন। সে কী হাসি! ওর দিকে তাকিয়ে আছি শান্ত ও বিমুগ্ধ দৃষ্টি ফেলে। এক ধরনের প্রাকৃতিক শক্তি আছে ওর মাঝে। সবকিছু সামলে নিতে জানে অতি সহজেই। দুর্দান্ত ক্রিয়াশীল হৃদয় মেয়েটার। এমনি একটি হৃদয়ের জন্যই হয়তো বা আমি এতটা বিচিত্র। ওকে বললাম- যাও, অ্যাপ্রোন চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও।

৫.
বেডরুমের সঙ্গেই একটা জানালা। ওটার ওপর পর্দা-টর্দা কিছুই নেই। তবে গøাস লাগানো আছে। আমি অফিস থেকে ফিরে চুপচাপ জানালাটার দিকে তাকিয়ে থাকি। এটা আমার পুরানো অভ্যাস। যখন মন খুব খারাপ থাকে কিংবা গল্প-কবিতার জন্য নতুন কোনো শব্দ খুঁজে না পাই, তখন ইজি চেয়ারটা টেনে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে বসে পড়ি। যাবতীয় নিস্তব্ধতা ভেঙে কখনো কফি, কখনো চা, কখনো দু-চারটে টোস্ট বি¯ু‹ট খেয়ে সময় পার করি। আমি এমনই। বাইরে তাকিয়ে কী যেন ভাবি! তীব্র সে ভাবনা। রোদভেজা বিষণ্ন চিলেরা উড়ে যায় দূর বহুদূর। ইলেকট্রিক তারের ওপর শক খেয়ে মরে ঝুলে থাকে বাদুড়। কী অদ্ভুত, তাই না? মৃত্যুই বোধ হয় চিরবিস্ময়! কতকাল এভাবে চলবে? সøাইড গøাসে ঢাকা জানালার ওপারে একটা পৃথিবী আছে। যে পৃথিবী আমাকে নতুন করে ভেতর থেকে আবার জন্ম দিতে চায়। নিজেকে মনে হয় কখনো উত্থান, কখনো পতন। হঠাৎ ওয়ালের দিকে চোখ পড়ল। ফ্রেমে বাঁধা আমাদের বিয়ের ছবিটা ওখানে ঝুলছে। কী গম্ভীরভাবে দুজন দুজনকে দেখছি! চোখ সরিয়ে নিলাম ছবির ওপর থেকে। ফোনে গান প্লে করলাম- ‘যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়!’

এম মনজুরুল ইসলাম : শিবগঞ্জ, বগুড়া

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়