নজরুল ইসলাম খান : খালেদা জিয়ার কিছু হলে রেহাই পাবেন না

আগের সংবাদ

নতুন বছরে সরকারের ১০ চ্যালেঞ্জ

পরের সংবাদ

শেখ মুজিব ফিরে আসবেন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হেলসিঙ্কিতে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট পাকিস্তান সরকারের কাছে এই আবেদনটি পাঠায় : গোপন বিচার বন্ধ করুন : শেখ মুজিবকে মুক্তি দিন
মানব আচরণের সব বিধিমালা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং বিশ্ব জনমত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগণের নির্বাচিত নেতার বিচারের আয়োজন করেছে। গোপনে বিচার হচ্ছে, কেউ জানে না সামরিক শাসকরা কী ঘটাতে যাচ্ছে। ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের কথিত বিচার হচ্ছে। আসলে এ ধরনের শব্দগুচ্ছ সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে নেয়া। ঔপনিবেশিক রাজত্বের দিনগুলোতে শত শত ভারতীয় দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযোদ্ধার বিচার হয়েছে ‘রাজা-সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা’র জন্য তাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সে বিচার কখনো গোপনে হয়নি।
আর সব হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের মতো ইয়াহিয়ার একনায়কত্ব বিশ্বের কাছে এটাই প্রকাশ করেছে যে, এটাও জনবিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদী ও স্বৈরাচারীর অনুকারক। যে শেখ মুজিবুর রহমান ভারতে বহিরাগত ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন আর দোসররা আনুগত্যের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সেবা করেছেন, সেই মানুষটির একমাত্র অপরাধ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ তাকে ও তার দলকে ১৬৯-এর মধ্যে ১৬৭টি আসন উপহার দিয়েছে।
গণতন্ত্রের যে কোনো চর্চায় শেখ মুজিবুর রহমানের আজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী থাকার কথা, ইয়াহিয়া খানের আমলাতান্ত্রিক-সামরিক-সামন্ততান্ত্রিক গোষ্ঠী তাকে ক্ষমতা অর্পণ করতে এবং জনগণের প্রকাশ্য রায় মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। কাজেই জাতীয় আচরণ ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ ব্যত্যয় আচরণ ও আন্তর্জাতিক আইনের সম্পূর্ণ ব্যত্যয় ঘটিয়ে সঙ্গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বসানো হয়েছে- উদ্দেশ্য ক্ষমতালোভী ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করা, যারা বাংলাদেশের জনগণের ওপর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এর মধ্যে শতসহস্র মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ পৃথিবীর সর্বত্র জনমত পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যায় বিহ্বল হয়ে পড়েছে এবং এই ট্র্যাজেডি অবিলম্বে যদি বন্ধ না করা হয় তাহলে এটা সবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আর এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতিতে সমগ্র অঞ্চল বড় মাপের দ্ব›েদ্ব জড়িয়ে পড়বে, যা হয়ে উঠবে বিশ্বশান্তির জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। পৃথিবীর বিভিন্ন ধারার বিভিন্ন মতের মানুষ সর্বসম্মতভাবে জানিয়েছেন এখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান।
কেবল শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তার ও তার সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সমাধান বের করা সম্ভব। কারণ তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করেন। গোপনে তার বিচার করে তার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার উপযোগী অভিযোগ দায়ের করা বরং অকারণে ধ্বংসযজ্ঞকেই ডেকে আনা হবে- এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
পৃথিবীর যত শান্তিপ্রিয় মানুষ পাকিস্তানের জনগণের মঙ্গল ব্যতীত অন্যকিছু চায় না তাদের হয়ে ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল ইয়াহিয়া সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে দেরিতে হলেও সচেতন হোক এবং বিচার না করে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিক। ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল সব জাতীয় কমিটিকে আহ্বান জানাচ্ছে যেন তাদের পক্ষ থেকে শেখের মুক্তির দাবি জানিয়ে ইয়াহিয়া খানের কাছে বার্তা পাঠানো হয়। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, ওয়ার্ল্ড পিস কাউন্সিল পাকিস্তানি শান্তিকামী শক্তিকে যথাসময়ে সাড়া দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছে যেন মহাবিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হয়।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মতামত
জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার গোপন বিচার নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নভেম্বরে পূর্ব বাংলায় হারিকেনের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী কলেরা মহামারির চেয়ে ভয়াবহ হবে এই বিচারের পরিণতি।
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উ থান্টের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের জন্য ৯৮ ভাগ জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে তারা এই মন্তব্য করেন।… ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন কোথায় মুজিবুর রহমানের বিচার হচ্ছে তা প্রকাশ করতেও অস্বীকার করছে। তাদের সরবরাহকৃত তথ্যে বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানের কোথাও’ তার বিচার হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙালিরা কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবে তা যেখানে উদ্বেগের বিষয়, যেখানে তারা পশ্চিমাপন্থি, কিন্তু তারা রেড চীনের প্রতিবেশী, মুজিবুর রহমান যেখানে মধ্যস্থতার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বেশি ঝুঁকে আছেন- তিনি ভোটারের মতামত ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর চাওয়ার তফাতটা ভালো করেই জানেন, তার গোপন বিচারের পরিণতি ভালো হওয়ার নয়। (১৩ আগস্ট, ১৯৭১)

ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের প্রতিক্রিয়া
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের মহাসচিব ম্যাকডারমট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে ১৯৭১ সালের ১৭ আগস্ট যে চিঠি পাঠিয়েছেন :
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান
প্রেসিডেন্ট’স হাউস, রাওয়ালপিন্ডি
বিশ্ব জনমত অত্যন্ত আশঙ্কিত যে, সামরিক ট্রাইব্যুনাল শেখ মুজিবুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। তাই যদি হয়, ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট উদ্বিগ্ন হয়ে দণ্ড লাঘবে আপনার দয়া, ক্ষমতা ও বিচক্ষণতা প্রদর্শনের অনুরোধ জানাচ্ছে, যাতে চলমান সহিংসতা, সন্ত্রাস ও দুর্ভোগ আর বৃদ্ধি না পায়।
ম্যাকডারমট
সেক্রেটারি জেনারেল
পূর্ব জার্মানির প্রতিক্রিয়া
জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট শেখ মুজিবের বিচার নিয়ে বিবৃতি দেয় :
পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সামরিক আদালত পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু করেছে। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে শেখ মুজিবের দল জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ ও সরাসরি বিদ্রোহের’ অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সংবাদ জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকে গভীর আশঙ্কা ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, এই বিচার নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বৃহত্তম দলের প্রধান নেতার জীবনাশঙ্কা করে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাদের স্বর উচ্চকিত করেছেন।
এই দেশের জনগণ পাকিস্তান সরকারের কাছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ও মানবতার বিষয়টি মাথায় রাখার আবেদন জানিয়েছে এবং নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি উপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শনের অনুরোধ জানিয়েছেন। সামরিক আদালতে বিচার অব্যাহত রাখা এবং লীগের নেতাকে দণ্ডিত করলে তা যে কেবল সন্দেহাতীতভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দ্ব›দ্বকে আরো বাড়িয়ে দেবে তা-ই নয়, ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর তা ভয়ংকর প্রভাব বিস্তার করবে। এ ধরনের পরিস্থিতির অভ্যুদয় ঘটলে তা শান্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিঘিœত করে তুলবে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংয়ের বিবৃতি
যতক্ষণ পর্যন্ত প্রশাসন ও সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়ন্ত্রণে আসছে এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হচ্ছে- শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখছি না। কারণ কেবল বিবৃতি দিয়ে তাদের ফেরানো যাবে না, তাদের মনে বিশ্বাস থাকতে হবে যে তারা তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে, চুলায় আগুন দিতে পারবে। ইয়াহিয়া খানের এই বিবৃতির প্রভাব কী? তার বিবৃতির পর আরো পঁয়ত্রিশ লাখ শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসেছে- এই হচ্ছে ইয়াহিয়ার বিবৃতির ফল। বিবৃতি কিংবা জাতিসংঘের আশ্বাস শুনিয়ে তাদের মনে আস্থা সৃষ্টি করা যাবে না। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার- তারা মনে করে কেবল ক্যাম্প বানালেই শরণার্থী সেখানে ফিরে যেতে প্রলুব্ধ হবে- তা কখনো ঘটার নয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না মূল সংকটের সমাধান হচ্ছে তারা ফিরে যাবে না। মূল সংকট হচ্ছে লড়াই- একদিকে জনগণ ও গণতান্ত্রিক শক্তি অন্যদিকে সামরিক শাসক ও অন্যসব (জনবিরোধী) বিষয়। এ কারণেই আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ, এই লক্ষ্য আমাদের বাস্তবায়ন করতেই হবে।
সর্দার শরণ সিংয়ের কথার সারাংশ হচ্ছে মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে এবং একমাত্র তিনিই সংকটের সমাধান করতে পারবেন; তিনি জনগণের নির্বাচিত নেতা, তার ওপরই জনগণের আস্থা।

‘মুজিব কি নেই?’ কেনেডি
বি জেড খসরুর ‘মিথস অ্যান্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত :
বিশিষ্ট আমেরিকানদের মধ্যে যারা মুজিবকে নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাদের একজন সিনেটর টেড কেনেডি। ৮ সেপ্টেম্বর কিসিঞ্জার স্পেশাল অ্যাকশন প্রæপের বৈঠকে বলেছেন, এই ডেমোক্র্যাট সিনেটর কেনেডি দিনের প্রথম দিকে উদ্বিগ্ন অবস্থায় এসে তাকে বলেছেন, মুজিব সম্ভবত আর নেই- কিসিঞ্জার স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের সদস্যদের কাছে এটা সত্য কিনা জানতে চাইলেন।
ফারল্যান্ডকে দেয়া ইয়াহিয়ার প্রতিশ্রæতির কথা উল্লেখ করে সিসকো বললেন, মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কথা নয়। সিআইএ প্রধান হেল্মস বললেন, এ গুজবকে সমর্থন করার মতো কোনো তথ্য তার কাছে নেই।
কেনেডি জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাহলে মুজিবের কোনো ছবি ছেপে তারা এ গুজবটাকে বন্ধ করছেন না কেন?
‘আমরা যেন যুক্তিসঙ্গতভাবে বিশ্বাস করতে পারি যে, তিনি জীবিত আছেন।’
কিসিঞ্জারের প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট জবাব কারো কাছেই নেই। তবে ইউএসএআইডির ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর উইলিয়ামস বরং সিসকোর সঙ্গে একমত হয়ে একই সুরে বললেন, ‘এটা আমার কাছে কোনোভাবেই বোধগম্য নয়, যেখানে তারা মুজিবের বিচারের ঘোষণা দিয়ে তার জন্য বড় মাপের আইনজীবীর জোগান দিচ্ছে, মৃত হলে তা কেমন করে সম্ভব।’
সিসকো তার সঙ্গে যোগ করলেন, ‘যখন দেশের প্রেসিডেন্ট আমাদের রাষ্ট্রদূতকে বললেন, আয়েশ করুন, মুজিবকে হত্যা করা হবে না, সেক্ষেত্রে এটা কেমন করে ঘটবে তা আরো বেশি অনধিগম্য।’
কিসিঞ্জার মন্তব্য করলেন, ‘আমি এটা ভাবতেই পারছি না, মুজিব মৃত।’
১১ অক্টোবর ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স সোবারকে বলেছেন, ‘মুজিবের বিচার চলছে। আদালত যদি তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন, তাহলে তার যে শাস্তি হবে তা অনুমেয়- মৃত্যুদণ্ড।’
ফারল্যান্ডের পাঠানো টেলিগ্রামের ওপর ভিত্তি করে ভ্যান হোলেন বলেন, প্রেসিডেন্ট ফারল্যান্ডকে বলেছেন, মুজিবের বিচার শেষ হয়েছে। তিনি ট্রাইব্যুনালের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন। ১৫ অক্টোবর হেল্মস নিক্সনের পররাষ্ট্রবিষয়ক সহযোগীদের বলেছেন, বিশ্বস্ত সূত্রে তিনি জেনেছেন, মুজিবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ইয়াহিয়া না পারবেন এ রায়কে বহাল রাখতে, না পারবেন হ্রাস করতে, না পারবেন ফেলে রাখতে। সিআইএ পরিচালক বললেন, ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তই ইঙ্গিত দেবে- তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কতটা আপস করতে চাইছেন।
শুরুতে ইয়াহিয়া মুজিবকে ফাঁসি দেয়ার কথা যদি মনে রেখেও থাকেন, যখন তিনি ভারতের কাছে সামরিক পরাজয়ের আলামতগুলো দেখতে পেলেন, তিনি অনুভব করলেন, পরিস্থিতি যেভাবে দলা পাকিয়ে ফেলেছেন, একমাত্র শেখ মুজিবই তাকে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ করতে পারবেন। সবকিছুর উপরে এ সামরিক শাসক আমেরিকানদের কাছ থেকে বাঙালি নেতা মুজিবকে হত্যা না করার তীব্র চাপে ছিলেন।
তিনি তার কথা রাখার প্রতিশ্রæতিও দিয়েছেন। মুজিবের নিজের আশঙ্কা ছিল, পাকিস্তানি মিলিটারি তাকে হত্যা করতে চায়। তার এ অনুভূতির কথা তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী গুলাম মুস্তফা খারকে বলেছেন। ২০০৯ সালে খার এ তথ্য প্রকাশ করেছেন, এ বাঙালি নেতা উদ্বিগ্ন ছিলেন যে সামরিক বাহিনী তাকে মেরে ফেলতে পারে।
ইয়াহিয়া মুজিবকে মেরে ফেলতে চেয়েছেন- ইয়াহিয়া তা অস্বীকার করেন। ভুট্টোর আমলে গৃহবন্দি থাকার সময় জেনারেল ইয়াহিয়া ব্যক্তিগত ডায়েরি লিখে গেছেন। ১৯৮০ সালে মৃত্যুর আগে তিনি তাতে লিখেছেন, ভুট্টো মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ১৯৭১-এর অক্টোবরে ইরানের শাহ রাজত্বের আড়াই হাজার বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে যাওয়ার আগে ভুট্টো তাকে বলেছিলেন, দ্রুত সামরিক আদালতের বিচার গুটিয়ে মুজিবকে যেন শেষ করে দেয়া হয়। আমি তাকে বলেছি, কোর্টের প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে শেষ না হলে আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। ভুট্টো বলেছেন, ইরানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা মুজিবকে ছেড়ে দেয়ার জন্য আমার ওপর সব ধরনের চাপ প্রয়োগ করবে। কাজেই তাকে ঝুলিয়ে দিয়ে আমাকে দ্রুত কাজটা শেষ করে নিতে হবে। এটাই সত্য বলে জেনারেল দাবি করেছেন।
ইয়াহিয়ার দাবি পুরোপুরিভাবে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। কারণ মুজিব জীবিত থাকলে যে ক্ষমতার জন্য ভুট্টো এত লালায়িত, তা আদৌ তার কাছে আসবে কিনা, তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। এটাই স্পষ্ট, ভুট্টোর স্বার্থে ইয়াহিয়াকে এ বাঙালি নেতার জীবন হরণ করে পথ পরিষ্কার করতে হবে। যাতে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ভুট্টোর দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
ইয়াহিয়া আরো বলেছেন, ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে তিনি তাকে জানিয়েছেন, মুজিবের বিচারের আদালত পর্ব শেষ হয়েছে। তবে তা আইন মন্ত্রণালয়ের পর্যালোচনাধীন থাকায় তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
‘যেভাবে ভুট্টো জাতিকে বলেছেন, আমি মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দিয়েছি আর তিনি তাকে বাঁচিয়েছেন- এটা মিথ্যে! মিথ্যে! মিথ্যে! অবশ্য এ রকম একজন চরম মিথ্যেবাদীর কাছে এর চেয়ে বেশি কী আশা করা যায়? এটা তো সামরিক আদালতের কার্যক্রম, তারিখ-সময় এগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই প্রমাণ করা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরেই তা প্রক্রিয়াধীন হয়েছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভুট্টো যখন মুজিবকে বলেছেন, ইয়াহিয়া তাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছেন আর তিনি তাকে বাঁচিয়েছেন- সরল মুজিব এটাই বিশ্বাস করেছেন।’ ইয়াহিয়া তার জার্নালে এ কথা লিখেছেন।
বিজয়ীর বেশে ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর মুজিব নিউজ উইক ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যেদিন পূর্ব পাকিস্তানের পতন ঘটল, (১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১) ইয়াহিয়া তাকে সেদিনই ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতে অবস্থানরত যুদ্ধবন্দিদের জীবন তাতে বিপন্ন হবে- এ কথা বুঝিয়ে ভুট্টো তাকে নিরস্ত করেন এবং তার জীবন রক্ষা করতে ইয়াহিয়াকে রাজি করান। মুজিব নিউজ উইককে বলেছেন, ভুট্টোর চেষ্টা সত্ত্বেও জেলখানার ভেতরেই মুজিবকে হত্যা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ভুট্টো ‘মধ্যরাতে তাকে কারাগার থেকে পাচার করে বাইরে নিয়ে আসেন এবং তার মুক্তি পর্যন্ত মুজিবকে তার বাড়িতে এবং অন্যান্য গোপনীয় স্থানে লুকিয়ে রাখেন।’
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে উদ্বেগ তুঙ্গে- বঙ্গবন্ধুকে তারা হত্যা করবে না তো? তিনি কখন ফিরবেন?
ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়