নজরুল ইসলাম খান : খালেদা জিয়ার কিছু হলে রেহাই পাবেন না

আগের সংবাদ

নতুন বছরে সরকারের ১০ চ্যালেঞ্জ

পরের সংবাদ

কমছে গতি, বাড়ছে দুর্ঘটনা : ৬৬ বছরের পুরনো ইঞ্জিনে চলছে ট্রেন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ২, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এন রায় রাজা : মেয়াদোত্তীর্ণ ৭৩ শতাংশ ইঞ্জিন দিয়ে চলছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। সাধারণত ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশ রেলওয়ের বহরে ৬০-৬৬ বছরের পুরনো ইঞ্জিনও রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নিয়ে আসা কানাডার জিএম বি-১২ মডেলের ইঞ্জিনই মূলত রেলের ভরসা। যেগুলো অনেক আগেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাদুঘরে ঠাঁই নিয়েছে। অন্যদিকে জরাজীর্ণ লাইন, ঝুঁকিপূর্ণ রেলসেতুর কারণে কমেছে রেলের গতি, বাড়ছে দুর্ঘটনা। এমনকি দীর্ঘ সময় চলাচল ও ইঞ্জিনের সক্ষমতা না থাকায় আগুন লাগার ঘটনাও মাঝেমধ্যে ঘটছে। সব মিলিয়ে অনেকটা জীবনবাজি রেখেই চলছেন রেলযাত্রীরা। নিরাপদ বাহন হয়ে উঠেছে অনিরাপদ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, স্বাধীনতার সময় রেলওয়েতে লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন ছিল ৪৮৬টি। বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ২৭৩টিতে। তবে এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ১৯৫টির মেয়াদ নেই। মিটারগেজ ও ব্রডগেজের ৩৯টি মিলিয়ে বর্তমানে ৭৮টি ইঞ্জিনের কার্যদক্ষতা রয়েছে। অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন দিয়ে চলছে রেলওয়ের সেবা।
রেল সূত্র জানিয়েছে, ২০০৭-০৮ সালে সচল ইঞ্জিন ছিল ২৮৫টি। ২০১০-১১ সালে কমে হয় ২৫৯টি, ২০১১-১২ সালে ইঞ্জিন ছিল ২৯৫টি, ২০১২-১৩ সালে ২৫৮টি, ২০১৩-১৪ সালে ২৯৩টি, ২০১৫-১৬ সালে ২৭৮টি, ২০১৬-১৭ সালে ২৭৩টি ইঞ্জিন ছিল। বর্তমানে এই ২৭৩টি ইঞ্জিনই রয়েছে রেলওয়েতে। এর মধ্যে ব্রডগেজ ইঞ্জিন রয়েছে ৯৪টি। বাকি ১৭৯টি রয়েছে মিটারগেজ ইঞ্জিন। মিটার গেজের ১৪০টি ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব ইঞ্জিনের মধ্যে ৪৫টি ইঞ্জিনের বয়স ২১-৩০ বছর, ৩১টি ইঞ্জিনের বয়স ৩১-৪০ বছর এবং ৬৪টি ইঞ্জিনের বয়স ৪১-৬০ বছরের বেশি। আর ৯৪টি ব্রডগেজ ইঞ্জিনের মধ্যে ২৪টির বয়স ৩১-৪০ বছরের মধ্যে। ৩১টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন ৪১ বা তারও বেশি বছর ধরে চলছে। এদিকে ২০১৯ সালে ২১টি রেল ইঞ্জিন নবরূপায়ণ

করার পরিকল্পনা নেয় রেলওয়ে। প্রকল্পের আওতায় বারবার টেন্ডার ডকুমেন্ট বিক্রি করা হলেও দরপত্র মেলেনি। দরদাতাদের ভাষ্য, কিছুসংখ্যক লোকোমোটিভের অবস্থা এতটাই নাজুক যে সেগুলো তাদের জন্য লাভজনক নয়। ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) যে ব্যয় ধরা হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এসব কারণেই মূলত পাওয়া যায়নি দরদাতা।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, ২১ লোকোমোটিভ প্রকল্পের নবরূপায়ণের জন্য তিনবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি। রেল ইঞ্জিন নবরূপায়ণের দরপত্রটি খোলার তারিখ পাঁচবার পরিবর্তন করে সংশোধন করা হয়। নতুন করে নির্ধারণ করা হয় দিন-তারিখ। এতে ১৪টি টেন্ডার ডকুমেন্ট বিক্রি করা হয়েছিল। একমাত্র দরপত্র জমাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি টেকনিক্যালি নন-রেসপনসিভ হওয়ায় পুনঃদরপত্রের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে বারবার দরপত্র আহ্বানেই শেষ হচ্ছে প্রকল্পটি। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২৪২ কোটি ১৪ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রকল্পটি শেষ করার সুপারিশ করে রেলের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে রেলের এ-সংক্রান্ত কমিটি।
রেল সূত্র জানায়, ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২২শ সিরিজের (এমইজি-৯) ১১টি, ১৯৬৯ সালে কানাডা থেকে ২৩শ সিরিজের (এমইএম-১৪) ৮টি, কানাডা থেকে ১৯৭৮ সালে ২৪শ সিরিজের (এমইএম-১৪) আরও ৯টি এবং ১৯৮১ সালে হাঙ্গেরি থেকে ৩৩শ সিরিজের (এমএইচজেড-৮) তিনটি ইঞ্জিন পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জন্য আনা হয়েছিল। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২৯শ সিরিজের (এমইআই-১৫) একটি ইঞ্জিন আনা হয়। এসব ইঞ্জিনের ইকোনমিক আয়ুষ্কাল ২০ বছর নির্ধারিত। যক্তরাষ্ট্র থেকে আনা ১১টির আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে ৩৮ বছর আগেই। কানাডা থেকে প্রথম ধাপে আনা ৮টি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ৩০ বছর আগেই। দ্বিতীয় ধাপে কানাডা থেকে আনা ৯টির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়ে ৪১ বছর হয়েছে। হাঙ্গেরি থেকে আনা তিনটির আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়ে ৩৮ বছর হয়েছে।
এ ব্যাপারে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেলওয়ের আধুনিকায়নে আগে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আমি দায়িত্ব নেয়ার পরে দেখা যায় ৭৩ শতাংশ রেল ইঞ্জিনের মেয়াদ পার হয়ে গেছে। তবে ইতোমধ্যে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বেশকিছু ইঞ্জিন আমদানি করা হয়েছে। ভারত ১০টি মিটারগেজ ও ১০টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন দিয়েছে চালানোর জন্য। রেলমন্ত্রী বলেন, রেলের আধুনিকায়নে ব্রডগেজ লাইনের ৪০টি ইঞ্জিন আনার চুক্তি হয়েছে। তবে ইঞ্জিন আনার আগে ডাবল লাইন করার ওপর জোর দেন তিনি।
এদিকে রেলের ওয়ার্কশপ ও ড্রাইভারদের ভাষ্যমতে, মেয়াদোত্তীর্ণ এসব ইঞ্জিনের অনেকটির পায়ের ডিজিটাল ব্রেক কাজ করে না। ডেডম্যান ফুট প্যাডেল কাজ করছে না। হাতের ব্রেক কাজ করলেও জরুরি পায়ের ব্রেক কাজ করছে না। সামনে বিপদ এলেও জরুরি ট্রেন থামাতে পারেন না চালকরা। এ রকম ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন বিভিন্ন রুটে লাখ লাখ যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে ট্রেনগুলো।
রেলের ড্রাইভারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় বি-১২ মডেলের ইঞ্জিনের গতি ছিল ৬৫-৭৫ কিলোমিটার। এখন এর গতি ৩০-৩৫ কিলোমিটারের বেশি ওঠে না। এসব ইঞ্জিনের জ¦ালানি খরচও বেশি। বি-১২ মডেলের ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ এখন কোথাও পাওয়া যায় না। জিআই তার দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে ব্রেকসহ নাট-বল্টু। এসব ইঞ্জিন দিয়ে মালবাহী ট্রেন চলাচল করে।
রেলওয়ের কমলাপুর ও পাহাড়তলী ওয়ার্কশপের ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ১০-১২টি ইঞ্জিন মেরামতের জন্য ওয়ার্কশপে আসে। অধিকাংশ ইঞ্জিন জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হয়। জাপানি ইঞ্জিনগুলোর যন্ত্রপাতি বাজারে পাওয়া যায় না। কর্মী সংকট থাকায় দ্রুত মেরামত করাও সম্ভব হয় না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, রেলওয়েতে বহু প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেয়া দরকার তা মেনে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে না। একটি দেশের ট্রেন চলাচল সচল রাখার জন্য ইঞ্জিন, বগি, ট্রেন লাইন, সিগন্যালিং এসব খুবই জরুরি। তিনি বলেন, সরকার অবকাঠামো তৈরি করবে কিন্তু সেবা দেয়ার সময় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ থাকবে। কারণ, সরকারি ছত্রছায়ায় উন্নয়ন হলেও সেবা সঠিকভাবে পাওয়া যায় না। সড়ক, নৌ, আকাশপথে যাত্রী পরিবহনে বেসরকারি বিনিয়োগ রয়েছে। শুধু রেলে সরকারিভাবে সেবা দেয়া হয়। রেল সেবাকে নিরাপদ এবং লাভজনক করতে চাইলে দ্রুত গতিতে চলার জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। রেলকে সরকারি-বেসরকারি দুই ধরনের বিনিয়োগের মধ্য দিতে চালাতে হবে। তাহলে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে সেবার মান বাড়বে। আর জরুরি ভিত্তিতে প্রকল্প নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়