পরিকল্পনামন্ত্রী : দেশে রাজনীতিবিদের চেয়ে আমলাতন্ত্রের দাপট বেশি

আগের সংবাদ

শ্যামল দত্ত’র প্রত্যয় : চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে ভোরের কাগজ

পরের সংবাদ

শুভ বারতা নিয়ে আসুক নতুন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

ইংরেজি বর্ষপঞ্জিকে লালন করি আমরা বিশ্বজুড়েই। এই বর্ষপঞ্জি ইংরেজি ভাষীদের যতটা ততটাই বিশ্ববাসীর আজ। বহু শতাব্দীর, বহু ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্তে বিলেতি এই প্রচলন আমাদের আপন হয়েছে। কাজেই পহেলা বৈশাখ যেমন আমাদের, জানুয়ারির নববর্ষও সঙ্গত কারণেই আমাদের। তবে তফাৎ নিশ্চয়ই আছে বৈকি, পহেলা বৈশাখের হৃদয় ব্যঞ্জনা বঙ্গের মাটি-জল-বায়ুতে, এই মাটির অতীত ও বর্তমানে।
নতুনকে আমরা স্বাগত জানাই পুরনোকে বিদায় দিয়ে। এই রীতি চিরন্তনী বাণী উপহার দিয়েছে মানুষকে। ২০২২-এর প্রথম সূর্যোদয়কে সে কারণেই স্বাগত জানাই নানা বর্ণিল প্রত্যাশা ও স্বপ্ন দেখার বাসনায়। কিন্তু যে বছরটি চলে গেল কিংবা তারও আগে বছর খানেকের যে সময় গত হলো, শোক ও দুঃখে, সর্বগ্রাসী ত্রাস ও মৃত্যু ভয়ে, তাকে বিদায় জানালেও স্মৃতি থেকে বাদ রাখা কি সম্ভব? একেবারেই নয়। বিশ শতকে পৃথিবী দুটি মহাসমর দেখেছে, ধ্বংস, মৃত্যু ও ভয় দেখেছে অগণিত, কিন্তু একুশ শতকে করোনা মহাসমরের তাণ্ডব ছাড়িয়ে গেছে সবকিছু। কোনো একক জনপদ, একক রাষ্ট্র বা মহাদেশ নয়, এ মহাদানবের রণাঙ্গন বহুজাতিক, বহুরাষ্ট্রিক। এর থাবা ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি মহাদেশে; এর বিধ্বংসী আগ্রাসনে বিপন্ন কোটি মানুষ- সে মানুষ সাদা, ধূসর, কটা, কালো, বাদামি; বড়-ছোট, গরিব-ধনী; সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব বিশ্বাসের, সব আকৃতির।
প্লেগের মহামারি কোটি মানুষের জীবন নিয়েছে এককালে; কলেরা, গুটিবসন্ত ছিনিয়ে নিয়েছে লক্ষ প্রাণ। এসেছে প্রাণঘাতী ভাইরাস সার্স। কিন্তু এই মহাদানবের থাবা অসীমান্তিক, যা গোটা মানবজাতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। এ এক সর্বগ্রাসী মহাসমর, নজিরবিহীন। প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ, খোদাতালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, আত্মসমর্পণ করবে, নাকি প্রতিরোধ যুদ্ধে নামবে? না, মানুষ আত্মসমর্পণ করেনি, সে হন্তারক শত্রæকে পরাজিত করার, যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা করে চলেছে।
আগেকার যুদ্ধ বা মহাযুদ্ধগুলো পাল্টে দিয়েছে বিশ্বকে, সে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে এক ভূখণ্ড থেকে আরেক ভূখণ্ডে, দেশ-অঞ্চল ও ভূরাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ কাঠামোতে। দ্বিতীয় মহাসমরের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন পৃথিবীর প্রায় সব জনপদে মানুষের বোধবিশ্বাসের পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনি ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিবর্তন ঘটেছে জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে। আমার বিশ্বাস করোনার এই যুদ্ধ বিশ্বকে আগের মতো রাখবে না। অর্থনৈতিক মন্দা, নিরাপত্তার সংকট গ্রাস করবে সব অঞ্চলকে। জেগে উঠবে উগ্র জাতীয়তাবাদ, ঘটবে মন ও রাষ্ট্র-সীমান্তের অনাকাক্সিক্ষত সংকোচন, যা অধুনা বিশ্বায়নের যুগকে, যার বহিরাঙ্গে যদিও স্বাধীনতা ও উন্মুক্ততা, অন্তরাঙ্গে প্রভাবশালীদের বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ, তাকেও ফেলবে চ্যালেঞ্জের মুখে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ছোট অর্থনীতি, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী, বিপন্ন হবে মানবসভ্যতা।
কী দেখা গেছে এ যাবত? ছোট অর্থনীতি বা গরিব দেশগুলোর কথা বাদ দিই, বড় অর্থনীতি বা শক্তিশালী দেশগুলোর জনজীবনকেও এই যুদ্ধ কতই না উলঙ্গভাবে প্রকাশ করেছে! পশ্চিমের শহরগুলোর সুবিশাল সুপারমল, চেইনশপগুলো রাতারাতি খালি হয়ে গেছে! মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে; এই অসহায়ত্ব কেবল দ্রব্যপ্রাপ্তির বিষয় নয়, এই অসহায়ত্ব ভোগবাদী বিশ্বের মনোজাগতিক দীনতা। একটি আঘাত ধস নামিয়েছে সবকিছুর। শুধু তাই নয়, ধর্মাচার বা ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতির পুরোধাদেরও বাধ্য করেছে করোনার দানব তাদের দীর্ঘ লালিত বিশ্বাস বা রাষ্ট্রশাসন কৌশলের পরিবর্তন ঘটাতে!
বর্তমান সময়টি, সে কারণেই বোধ জাগাবার সময়, মানুষ হওয়ার সময়। একবার কি ভেবে দেখব- কী অসহায় হয়েছে মানুষ, শক্তিধর কিংবা দুর্বল, সবপ্রান্তের মানুষ, যে মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে বুদ্ধিমান, সবচেয়ে বিচক্ষণ প্রজাতি! অতএব এ দানবকে পরাস্ত করার বিকল্প কোথায়? যাদের জীবন গেছে, তারা সবকিছুর বাইরে, কিন্তু যারা বেঁচে আছে তারা পাড় করেছে শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম এক বিচ্ছিন্নতা! কোনো বড় যুদ্ধ প্রলয়ে যা ঘটেনি- তাই ঘটেছে উন্মত্ত ভয়ংকর এই সময়ে!
না, এই মহাপ্রলয় নতুন বছরকে ছেড়েছে বা ছাড়বে, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাবে না; নানা নামে বিবর্তিত হয়ে ২০২২ সালেও এই মহাদানবের বিচরণ অব্যাহত থাকবে ধরেই নিতে হবে। বাংলাদেশের জীবনকেও ক্ষতবিক্ষত করেছে এই মহাপ্রলয়, সংখ্যার ভেদে কম ভাবা হলেও এই শকুনি ছোবল খুব কম ছিনিয়ে নেয়নি আমাদের। ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের বহুবিধ পুরোধাকে, যারা আমাদের নমস্য ছিলেন কর্ম ও কীর্তিতে, পরাভূত হয়েছেন তারাও মৃত্যুতে!
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ২০২১ সালে আরো একটি আতঙ্কজনক আগ্রাসন ঘটেছে ; আফগানিস্তান থেকে ২০ বছরের দখলদারিত্ব গুটিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে দেশটিতে পুনরুত্থান ঘটেছে তালেবানিদের, যারা ধর্মের উগ্রবাদী শাসনের জাঁতাকলে গণতন্ত্র, নারী অধিকার এমনকি মানবাধিকারকে পদদলিত করে চলেছে!
এরপরও বলি, আমাদের জন্য ২০২১ এসেছিল ইতিহাসের আশীর্বাদ হয়ে দুটি জাতীয় মহালগ্নের সাতরঙা পুষ্পস্তবক হাতে। প্রথমটি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, অন্যটি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। কারণ এর পেছনে আছে দীর্ঘ জাতীয় সংগ্রাম ও আনন্দ-বেদনার মিশ্রিত ইতিহাস, বাংলাদেশের জন্ম, টিকে থাকা ও বৃদ্ধির ইতিহাস। নৃশংস অতিমারির তাণ্ডবে এই দুই মহালগ্নের বাহ্যিক আয়োজন সীমিত থাকলেও তাৎপর্যের মানদণ্ডে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমার বিশ্বাস, সে গুরুত্ব বাংলাদেশের নতুন নাগরিকদের যেমন জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম নায়কের জীবন, কর্ম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস পাঠের সুযোগ দিয়েছে, তেমনি পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার মর্মদন্ত ছবি দেখার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে ১৯৭১ সালে নিরস্ত্র বাঙালি জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্বিচার গণহত্যা, লুণ্ঠন ও নারী নিগ্রহের সকরুণ ইতিহাস জানারও সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র, প্রভূত সংকট-সীমাবদ্ধতার পরও, নিঃসন্দেহে এগিয়েছে। অর্থনীতি, অবকাঠামো ও সামাজিক সূচকে জাতীয় প্রগতির চিহ্নগুলো পরিষ্কার। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের প্রতিপক্ষ একের পর এক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেও এই এগিয়ে যাওয়া রুদ্ধ হয়নি। হয়তো এ কারণে আত্মতুষ্টি বড় হয়েছে কারো কারো কাছে। কিন্তু ২০২১ সালের কিছু ঘটনাবলি আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের অসীম ত্যাগ ও বিসর্জনের ইতিহাস পেরিয়ে, স্বাধীনতার রাজনৈতিক শক্তির হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও দর্শনগত বা মনমানসিকতার উন্নয়নে এগোতে পারিনি আমরা!
২০২১ সালে বেরিয়ে এসেছে সমাজ জীবনের এমন এক অভব্য, অমানবিক সাম্প্রদায়িকতার ক্লেদ- যা গোটা জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। সে ক্লেদ দেশের নানা অংশে বাঙালির অহংকারকে কলঙ্কিত করেছে। কুমিল্লার শ্রী চান্দমনি হিন্দু মন্দির এক শ্রেণির ধর্মান্ধ মানুষের হাতলার শিকার হয়েছে। পীরগঞ্জের জেলেপল্লী আগুনে পুড়েছে। ফেনীতে হামলার শিকার হয়েছে মন্দিরের প্রতিমা।
অনস্বীকার্য, এসব অঘটন বাংলাদেশের ভিতকে নড়িয়ে দিয়েছে। যে বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা অহংকারের বিজয় কেতন তুলে, সেই বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীর লগ্নে কালিমালিপ্ত হয়েছে জাতীয় অহংকারের মুখ। অতএব রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রক ও সমাজশক্তিকে ভাবতে হবে।
ধর্ম ব্যক্তির বিশ্বাস, আবেগ ও অনুভূতি, এর অবমাননা গর্হিত কাজ। কিন্তু আগের অনেকবারের মতো এবারো দেখা গেল ২০২১-এর ঘটনাবলি বেশির ভাগই পরিকল্পিত। স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষা করতে অপপ্রচারের এমন কিছু ফন্দি খোঁজে যাতে সমাজের বৃহত্তর অংশকে উত্তেজিত করা যায়। কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লা, ফেনী এবং পীরগঞ্জের জেলেপল্লীতে যেসব কলঙ্ক ঘটানো হয়েছে তার প্রায় সবই এই পরিকল্পনার ফসল। অতএব প্রশাসনযন্ত্রের সক্রিয় পদক্ষেপ যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সামাজিক প্রতিরোধ। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বিগত দিনের অপরাধগুলোর বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায়, বিচার বিলম্বিত হওয়ায়, এসব অপরাধের প্রবণতা আজও কমেনি।
আশা ছাড়া জীবন অচল হয়, স্বপ্ন দেখা ছাড়া জীবন স্থবির হয়। সে কারণেই আশা রাখি ২০২২ নতুন আশা, নতুন বিশ্বাসের জন্ম দেবে। মানুষ লড়াই করেছে, এ যাবত নানা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, আশা রাখি মহামারির তাণ্ডবকে পরাজিত করতে পারবে মানুষ। কারণ বেঁচে থাকার মূল শর্ত সংগ্রাম, লড়াই। মানুষ, মনুষ্যত্ব এই সংগ্রামে সফল হোক, প্রার্থনা করি।
হারুন হাবীব : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়