পরিকল্পনামন্ত্রী : দেশে রাজনীতিবিদের চেয়ে আমলাতন্ত্রের দাপট বেশি

আগের সংবাদ

শ্যামল দত্ত’র প্রত্যয় : চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাবে ভোরের কাগজ

পরের সংবাদ

বিষাদের ছায়াঘেরা সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: জানুয়ারি ১, ২০২২ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

শরীফা বুলবুল : ২০২১, বিষাদময় একটি বছর। করোনার অভিঘাতে স্তব্ধ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। মঞ্চে জ্বলেনি আলো। মঞ্চকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানকে যারা পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, তারা কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। টিকে থাকতে না পেরে কেউ কেউ জড়িয়েছেন ভিন্ন পেশায়। স্থবিরতার কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে শত শত সাংস্কৃতিক সংগঠন। যেসব সংস্কৃতিকর্মী ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন, তাদের অনেকেই পারেননি সক্রিয় হতে। অনেকে মনোবল চাঙ্গা রাখতে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মকাণ্ড সচল রাখার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু মঞ্চের অনুষ্ঠানের বিকল্প হতে পারেনি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরম।
গত বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর বন্ধ হয়ে যায় থিয়েটার হল ও মঞ্চের অনুষ্ঠান। বন্ধ হয়ে যায় দেশের সংস্কৃতিচর্চা ও বিনোদনের সব কার্যক্রম। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায় দলবদ্ধ অনুষ্ঠানের মহড়াও। অক্টোবর মাসের দিকে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলে শিল্পকলা একাডেমির থিয়েটার হল ও মিলনায়তনগুলো সপ্তাহে দুদিনের জন্য খুলে দেয়া হয়। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে বিদায়ী বছরের ৩ এপ্রিল থেকে আবারো সব মঞ্চ মিলনায়তন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে অনেক কিছুই চালু হলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ওপর বিধি-নিষেধ বলবৎ রাখা হয়।
সকল নিষেধের মধ্যে নিজেদের চর্চা ধরে রাখা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রবাহমান রাখার জন্য বিকল্প হিসেবে অনেকে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান শুরু করেন। বিশেষ করে আলোচনা, সংগীত ও আবৃত্তির অনুষ্ঠান হচ্ছে ভার্চুয়ালি। কিন্তু মঞ্চনাটক ও পথনাটক প্রদর্শনী, যাত্রা, নৃত্যানুষ্ঠান, কনসার্ট যেগুলো একাধিক শিল্পী-কর্মীর অংশগ্রহণমূলক, সেগুলো সম্পূর্ণই বন্ধ ছিল। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকার কারণে শিল্পীদের পাশাপাশি কলাকুশলী যারা এটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তারাও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে যন্ত্রশিল্পী, রূপসজ্জাকর, শব্দ ও আলোক নিয়ন্ত্রণের কলাকুশলীরা মানবেতর জীবনযাপন করেছেন। যারা এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দীর্ঘ সময় থেকে কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে ফেডারেশনভুক্ত ৩৪২টি নাট্য সংগঠনের মধ্যে ৪০-৫০টি খুবই নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছে এবং স্থবিরতা নেমে এসেছে। 
তার ওপর বছরজুড়ে এই ভাইরাসের করাল গ্রাসে বিপর্যস্ততার পাশাপাশি আকাশ বাতাস ভারী ছিল স্বজন হারানোর বেদনায়। অনেকেই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেও না ফেরার দেশে চলে গেছেন উল্লেখ করার মতো শতাধিক গুণী ব্যক্তিত্ব। এই একটি বছরে সবচেয়ে বেশি গুণীদের হারিয়েছে দেশ, যারা দেশের শিল্প ও সংস্কৃতির উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছেন। তবে এমন ঘনঘোর বিষাদ-বিসর্জনের মাঝেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার

চেষ্টা চলছে। মঞ্চেও জ্বলছে আলো। এর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গন আড়মোড় ভাঙতে শুরু করছে। নতুন নাটক, উৎসব আর নতুন কনসেপ্ট পরিবেশ থিয়েটার মিলিয়ে বছর শেষে কিছুটা হলেও প্রাণের সঞ্চার হয় এ অঙ্গনে।
নতুন নাটক : ঢাকার মঞ্চাঙ্গনে যুক্ত হয়েছে অনেক নতুন নাটক। ঢাকা পদাতিক, পদাতিক নাট্য সংসদ, মহাকাল, বাতিঘর নাট্যদল, আরণ্যক, প্রাঙ্গণেমোর, বাংলাদেশ থিয়েটার, জেনেসিস থিয়েটার, দেশ নাটকসহ বেশ কয়েকটি নাটকের দল তাদের নতুন প্রযোজনা এনেছে। গত ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্রাঙ্গণেমোর মঞ্চে আনে নতুন নাটক ‘মেজর’ ও ‘পতাকা পাগল’। ঢাকা থিয়েটার ও দেশ নাটক যৌথ প্রযোজনায় আনে নতুন নাটক ‘পেণ্ডুলাম’। ৩টি নাটক মঞ্চে আনে দেশ নাটক। নাটকগুলো হলো ‘শক্তিরূপ’, ‘পারো’ এবং ‘পারাপার’। পালাকার মঞ্চে আনে নতুন একটি নাটক। নাট্যদল বটতলা আনে নতুন ৫টি নাটক। এগুলো হচ্ছে- ‘মার্কস ইন সোহো’, ‘যোজনগন্ধা মায়া’, ‘মাই বডি মাই চয়েস’, ‘রাইজ এন্ড শাইন’ ও ‘বাঘ’। মণিপুরি থিয়েটার মঞ্চে আনে ‘শহীদ সুদেষ্ণা’। প্রাচ্যনাট আনে ‘দ্য আল্টিমেট মাস্ক’।
এছাড়া নাটকের দল বটতলা ও যাত্রিক যৌথভাবে মঞ্চে নিয়ে আসে নাটক ‘সোহোতে মার্ক্স’, ম্যাড থেটার এনেছে ‘আনা ফ্রাঙ্ক’, আপস্টেজ মঞ্চে এনেছে ‘স্বপ্নভুক’। বছর শেষের আরেক আলোচিত নাটক ছিল শিল্পকলা একাডেমির প্রযোজনায় মাসুম রেজার রচনা ও নির্দেশনায় ‘জনকের অনন্তযাত্রা’। এখানেই শেষ নয়, মঞ্চে এসেছে নাট্যম রেপার্টরির ‘কোথায় জ¦লে মরাল চলে’, নান্দীমুখ এনেছে পথ নাটক ‘অনুরণন’, দেশের তারুণ্যদীপ্ত ও সম্ভাবনাময় নাটকের দল বাতিঘর ‘অলিখিত উপাখ্যান’, ‘ঊর্নাজাল’, ‘হিমুর কল্পিত ডায়েরি’, ‘র‌্যাডক্লিফ লাইন’সহ বেশ কিছু দর্শকপ্রিয় মঞ্চনাটক দিয়ে ছিল আলোচনায়। করোনার সময়ও বাতিঘর নাটকের দল কর্মী ও শিল্পীদের নিয়ে নিজস্ব ভবনে নিয়মিত মহড়া চালিয়ে গেছে প্রাঙ্গণেমোর, আরণ্যকসহ বেশ কিছু দল। নাটকটির প্রদর্শনী। এর মধ্যে ‘মুক্তি’ নাটকের শততম রজনী পূর্ণ হয়েছে এ বছর। অনেক নাটকেরই শততম মঞ্চায়ন হয়েছে। কিন্তু মুক্তি একটু ব্যতিক্রম। এ নাটকের প্রতিটি রজনীতেই চারজন নারী অভিনয় করেছেন। তারা হলেন- ফেরদৌসী মজুমদার, তানভীন সুইটি, তানজুম আরা পল্লী ও তামান্না ইসলাম। নাটকটির নির্দেশনায়ও ছিলেন একজন নারী, ত্রপা মজুমদার। সবকিছু মিলিয়ে মঞ্চের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। প্রায় দেড় দশক আগে অর্থাৎ ১৭ বছর আগে মঞ্চে শুভ মুক্তি ঘটে।
তবে করোনাকালে নাট্যকর্মীরা অনেকেই যখন ঘরে ডুব দিয়েছিলেন, ঠিক তখনই সাহসী মশাল হাতে শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটার মহিলা সমিতিতে মঞ্চায়ন করে ‘লাল জমিন’। মূলত দলটির এমন সাহসী প্রদর্শনীর মধ্য দিয়েই করোনাকালে প্রথম মঞ্চের দরজা খোলে।
জ¦লেছিল উৎসবের আলো : রাজধানীতে সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্যে বড় আয়োজন গঙ্গা–-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব। ওই উৎসবে এবার ১৪০টি সাংস্কৃতিক দল অংশ নেয়। এর মধ্যে ৩৬টি নাট্যদল ৩৬টি মঞ্চনাটক প্রদর্শন করে। পথনাটক, আবৃত্তি, নৃত্য, সংগীতসহ নানা আয়োজনে আনুমানিক সাড়ে তিন হাজার শিল্পীকলাকুশলী অংশগ্রহণ করেন। মহাকাল নাট্যসম্প্রদায় আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা নাট্যোৎসব। ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা উদ্বোধন করেছিলেন ওই বর্ণিল আয়োজনটি। যেখানে ছিল ৫০ বছরের নাটকের পোস্টার, স্থিরচিত্র প্রদর্শনী ও সম্মাননা। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী, শিক্ষাবিদ ড. নীলিমা ইব্রাহিমের জন্মশতবর্ষ উদ্?যাপন উপলক্ষে নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছিল বাংলাদেশ মহিলা সমিতি। এছাড়া বরাবরের মতোই সৈয়দ মহিদুল ইসলাম স্মরণ উৎসব আয়োজন করেছিল ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠী। পদাতিক নাট্য সংসদ আয়োজন করে সৈয়দ বদরুদ্দীন হোসাইন স্মৃতি নাট্যোৎসব ও স্মারক সম্মাননা। দেয়া হয় লোক নাট্যদল স্বর্ণপদক, আলী যাকের সম্মাননা। মণিপুরি থিয়েটারের রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজন করে বছরব্যাপী আয়োজন। এসবের পাশাপাশি ভাস্কর্য প্রদর্শনী, চলচ্চিত্র উৎসব, জাদুঘর আয়োজন করেছে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নিদর্শন ও গ্রন্থের বিশেষ প্রদর্শনী-২০২১’ শিল্পকলার আয়োজন করেছে ‘এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল’সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শিল্পকলা একাডেমি আয়োজন করেছে গণহত্যা পরিবেশ থিয়েটার। নতুন কনসেপ্ট অর্থাৎ যেখানে বধ্যভূমি সেখানেই প্রদর্শনী। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর পরিকল্পনায় এই কর্মযজ্ঞ দেশব্যাপী ৬৪টি জেলার ৬৫টি বধ্যভূমিতে অনুষ্ঠিত হয়। 
ভার্চুয়াল প্ল্যাটফরম : নিজেদের চর্চা ধরে রাখা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রবাহমান রাখার জন্য বিকল্প হিসেবে অনেকে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান শুরু করেছেন। বিশেষ করে আলোচনা, সংগীত ও আবৃত্তির অনুষ্ঠান হয়েছে ভার্চুয়ালি। কিন্তু মঞ্চনাটক ও পথনাটক প্রদর্শনী, যাত্রা, নৃত্যানুষ্ঠান, কনসার্ট যেগুলো একাধিক শিল্পী-কর্মীর অংশগ্রহণমূলক, সেগুলো সম্পূর্ণই বন্ধ থাকায় সংগীত ও আবৃত্তিশিল্পীরা অনলাইনের জুম মিটিং এবং ফেসবুক লাইভে নিজেদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করেছেন। শিল্পকলা একাডেমি করোনাকালে ‘করোনার বিরুদ্ধে শিল্প’ কর্মসূচির মাধ্যমে ৬৪ জেলার প্রায় ২০ হাজার শিল্পীকে নিয়ে অনলাইনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের আয়োজনে ৮টির বেশি নাটকবিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
করোনাকালীন সংকটে দেশের প্রায় ১০ হাজার সংস্কৃতিকর্মীকে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা করে সহায়তা দেয় সরকার। তবে এ সহায়তা যথেষ্ট মনে করছেন না সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। এ প্রসঙ্গে তিনি বললেন, কয়েক হাজার সাংস্কৃতিক সংগঠন নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। এসব দলের বেশির ভাগ সদস্যই ছোট চাকরি, ব্যবসা, টিউশনি কিংবা মিডিয়ায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের মতে, মহামারি বদলে দিয়েছে পৃথিবী, ঠিক তেমনি করোনা বদলে দিয়েছে একুশ শতকের জীবনযাপনের রীতি-সংস্কৃতি। এমন পরিস্থিতিতে সংস্কৃতিকর্মীদের প্রণোদনা দিয়ে সরকার এগিয়ে না আসলে সংস্কৃতিকর্মীরা কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা দুঃসাধ্য হয়ে যাবে। কারণ করোনায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সংস্কৃতিকর্মীরা সকলেই ক্ষতির মুখে পড়েছে। এ ক্ষতি পোষাতে সরকারের এগিয়ে আসতে হবে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়