এবার রাজধানীতে গাড়িচাপায় সাইকেল আরোহী নিহত

আগের সংবাদ

প্রতিকারহীন মৃত্যুর মিছিল!

পরের সংবাদ

দুই শতাধিক যুদ্ধাপরাধীর খোঁজ নেই : দেশে ও দেশের বাইরে পলাতক > গ্রেপ্তারে নিষ্ক্রিয় উচ্চ ক্ষমতার দুটি সেল

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এস এম মিজান : বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত অন্তত দুই শতাধিক আসামি পালিয়ে গেছে। পলাতকদের মধ্যে যেমন আছে অভিযুক্ত, তেমনি আছে বিচারে দণ্ডপ্রাপ্তও। অনেকে দেশে আত্মগোপন করে আছে, আবার বিদেশ পাড়ি দেয়ার সংখ্যাও অনেক। দীর্ঘ সময় ধরে কুখ্যাত এসব রাজাকার-আলবদর একে একে আত্মগোপনে চলে গেলেও তাদের গ্রেপ্তারে বা বিদেশে পালিয়ে যাওয়া রোধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিচারে শাস্তি হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগও দেখা যায়নি। এসব যুদ্ধাপরাধীকে ধরতে ট্রাইব্যুনাল থেকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ প্রশাসনকে বারংবার নির্দেশনা দেয়া সত্ত্বেও ব্যর্থ হচ্ছে তারা। অথচ এসব যুদ্ধাপরাধী বিদেশে বসে রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় আসামি গ্রেপ্তারে সফলতা না থাকায় স্বয়ং ট্রাইব্যুনালও একাধিকবার উষ্মা প্রকাশ করেছেন।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হলেই তাদের নজরদারিতে রাখার কথা। যথাযথ নজরদারি না থাকায় তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ট্রাইব্যুনালের এক রায়ে বলা হয়েছে, স্থানীয় রাজাকাররাই সবচেয়ে বেশি ভয়ংকর ছিল। এরা নিজ হাতে সাধারণ মানুষ, স্বাধীনতাকামী মানুষকে খুন করেছে। রাজাকার, আলবদর, আল-শামসসহ নানা নামে তারা চালিয়েছে লুটপাট, নারী ধর্ষণ, ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করা, অপহরণ, নির্যাতনের মতো ভয়াবহ কর্মকাণ্ড। শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের নির্দেশনা পালন করতে এরা এসব অপকর্মে লিপ্ত ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিকামী মানুষের হাতে নিহত হয়েছে, আবার অনেকে এলাকা ছেড়েছে। অনেকেই আবার বহাল তবিয়তে ছিল দাপটের সঙ্গেই। স্থানীয় জনগণ এদের শাস্তির অপেক্ষায় থাকলেও বিচারকাজ শুরু হতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত বিচার শুরু হলেও দেখা যাচ্ছে এদের বেশির

ভাগই পালিয়ে গেছে। ক্রমেই এর

সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
জানা যায়, বিচারিক কার্যক্রম শেষে ট্রাইব্যুনালের ঘোষিত রায়ে অর্ধশতাধিক দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধী পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে ৩৬ জন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত, এর মধ্যে পলাতক থাকা অবস্থায় এক আসামি মারা যান। আর ২৪ জন আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে ১২ জনই পলাতক। এছাড়া তদন্ত পর্যায়ে পালিয়ে যায় প্রায় দেড় শতাধিক আসামি। তাদের মধ্যে অনেকের সন্ধান এখনো মেলেনি। এমন প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকজন পলাতক আসামির অনুপস্থিতিতেই বিচারকাজ শেষ হয়।
প্রসিকিউশন বিভাগের একাধিক সদস্য ভোরের কাগজকে বলেছেন, পলাতকদের বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দিয়েছেন তা কার্যকর হলে তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। কারণ, পলাতকদের গ্রেপ্তারে একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিবেদন জমা দিলেও এখন পর্যন্ত কার্যত বা দৃশ্যত কোনো সুফল আমরা পাইনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম। কেউ কেউ আগে থেকেই বিদেশে পালিয়েছিল। আবার কেউ কেউ তদন্ত শুরু হওয়ার পর বা ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পালিয়ে যায়। বিদেশে পালিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টাস্কফোর্স গঠিত হলেও এ পর্যন্ত কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। গত পাঁচ বছর এই সেলের কোনো বৈঠকও হয়নি।
এদিকে পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তারে ২০১৫ সালের ১৩ মে ট্রাইব্যুনাল স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আদেশ দেন। আদেশটি হলো- ট্রাইব্যুনালের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর পলাতক সব আসামিকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে ১৫ দিনের মধ্যে একটি মনিটরিং সেল গঠন, সেই সঙ্গে ৪০ দিন পরপর এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এই মনিটরিং সেল গঠিত হলেও গত ছয় বছরে দৃশ্যত কোনো ফল নেই। ইতোমধ্যে নিজেদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে পুলিশ ট্রাইব্যুনালে বেশ কয়েকবার প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। করোনা মহামারির আগে এই সেলটির বছরে দুয়েকটি বৈঠক হলেও গত দুই বছর ধরে কোনো বৈঠক হয়নি। অন্যদিকে আসামিদের গ্রেপ্তারে গত বছর তাদের ঠিকানা অনুযায়ী ৩০ জেলায় ও থানায় ছবিসহ তদন্ত সংস্থা থেকে চিঠি পাঠানো হয়। একই সঙ্গে আসামিদের গ্রেপ্তারের পর আদালতে সোপর্দ করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কারের ঘোষণাও দেয়া হয়। তাতেও কোনো কাজ হয়নি।
এ বিষয়ে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক এম সানাউল হক বলেন, মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। পলাতকদের ছবিসংবলিত চিঠিও ৩০টি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের আইজিসহ অন্য কর্মকর্তাদের কাছে তদন্ত সংস্থা থেকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে বিদেশে পলাতকদের গ্রেপ্তারের চেষ্টাও করা হচ্ছে। তবে আমরা কোনো ফল পাচ্ছি না।
ট্রাইব্যুনালসংশ্লিষ্টদের মতে, মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিলেও এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। সরকারের উচিত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইনজ্ঞ নিয়োগ করা, যেটি ওই দেশগুলোর সঙ্গে আইনি জটিলতা নিষ্পত্তি করতে কাজ করবে। এছাড়া পলাতকদের ফিরিয়ে দিতে ওই দেশগুলোর সরকারকে রাজি করতে লবিস্ট নিয়োগ করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি) মো. জাহাংগীর আলম বলেন, আমি এখন পলিটিক্যাল দিকটা দেখি না। তবে তিনি আরেক অতিরিক্ত সচিব জি এস এম জাফরউল্লাহর (রাজনৈতিক ও আইসিটি) সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। আপনি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় সর্বশেষ কবে এই সেলের বৈঠক হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার মনে হয় না যে, করোনার মধ্যে কোনো কাজ হয়েছে। এ বিষয়ে অতিরিক্ত সচিব জি এস এম জাফরউল্লাহকে ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে এই সেলের সভাপতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে ফোন করা হলে তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
জানা যায়, যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের এপ্রিলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এর আগেই পালিয়ে যায় এ যুদ্ধাপরাধী। এ ঘটনায় তোলপাড় হয় সারাদেশে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও নড়েচড়ে বসে। ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল বাচ্চু রাজাকারকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। কিন্তু গত ৮ বছরেও ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত এই যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলেও রেড অ্যালার্ট জারি রয়েছে। তবে বাচ্চু রাজাকার ঠিক কোন দেশে আত্মগোপন করে আছে, তা নিশ্চিত নন কেউ। শুধু বাচ্চু রাজাকার নয়, তার মতো দণ্ডপ্রাপ্ত আরো ৪৭ জন যুদ্ধাপরাধী পালিয়ে আছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের দাবিতে সোচ্চার সংগঠন ও মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, দণ্ডপ্রাপ্ত এসব যুদ্ধাপরাধী যত দিন পালিয়ে থাকার সুযোগ পাবে, তত দিনই তারা দেশের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা চালাবে। যে কোনো মূল্যে এদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।
পুলিশ সদর দপ্তরের ইন্টারপোল (এনসিবি) শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, দণ্ডিত এসব যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে বাচ্চু রাজাকার ছাড়া আরো ৬ জন বিদেশে আত্মগোপনে আছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের মাধ্যমে জারি রয়েছে রেড নোটিস। তবে এখনো ইন্টারপোল থেকে তাদের বিষয়ে তথ্য মেলেনি। বাচ্চু রাজাকার ছাড়া ইন্টারপোলের রেড নোটিস জারি থাকা অন্য ৬ যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে রয়েছে- আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মইনুদ্দিন, জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল জব্বার, সৈয়দ হাসান আলী ও সৈয়দ মুহম্মদ হোসাইন। এছাড়া বাকিরা কোথায় আছে তাও জানে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ পর্যন্ত ৪২ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষে ১০৩ জনকে সাজা দিয়েছেন। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ড হয়েছে ৭১ জনের। তাদের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লা, এম. কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এছাড়া ৯০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত কারাবন্দি যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আমির গোলাম আযম ২০১৪ সালের অক্টোবর এবং আমৃত্যু কারাদণ্ড পাওয়া বিএনপি নেতা আবদুল আলীম একই বছরের আগস্টে মারা যান। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড পাওয়া জামায়াতের অন্যতম নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ ৩০ জন কারাগারে রয়েছেন। বাকিরা বর্তমানে পলাতক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়