মোটরসাইকেল ধাক্কায় রমনায় নারী নিহত

আগের সংবাদ

উল্লাপাড়ার শুঁটকি মাছে সমৃদ্ধ হবে রাজস্ব খাত

পরের সংবাদ

কেমন আছে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার কতজন মানব বৈচিত্র্যতা বা বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে জন্মগ্রহণ করেছেন, যাদের সমাজের প্রচলিত ভাষায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বলা হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভবত দেয়া সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এ কারণেই যে, প্রয়োজন সত্ত্বেও অদ্যাবধি প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী সঠিক পরিসংখ্যান করা হয়ে ওঠেনি। সাধারণত লক্ষণ দেখে প্রতিবন্ধিতা শনাক্ত করা হয়। যদিও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩-এ ১২ ধরনের প্রতিবন্ধিতার কথা বলা হয়েছে, যেমন- অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, সেরিব্রাল পালসি, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, বাক প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ প্রতিবন্ধিতা, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধিতা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা। বলাবাহুল্য যে প্রতিবন্ধিতা ধরন অনুযায়ী সঠিক পরিসংখ্যান ছাড়াই বছরের পর বছর জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, যার যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা কতটা সেই বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়ে যায় আজো। সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ২৭ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছেন। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী হওয়ার কথা মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১০ সালের ঐওঊঝ অনুযায়ী ৯.০৭ শতাংশ। এই হিসাব মতে বাংলাদেশে দেড় কোটির মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তি রয়েছেন।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩-এ যেসব অধিকারসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে তার কতটা এই বিশেষ জনগোষ্ঠী ভোগ করতে পারছেন সেই বিষয়ে কোনো মন্ত্রণালয় কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের কাছে কোনো তথ্যাদি আছে কিনা জানা নেই। থাকলে তা দৃশ্যমান হওয়া দরকার। বোঝা দরকার যে তারা তাদের অধিকার কতটা ভোগ করতে পারছেন। এ কথা বলা যায় যে, সমাজে পিছিয়ে থাকা, পিছিয়ে পড়া এবং পিছিয়ে রাখা জনগোষ্ঠীর ভেতর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থানই অত্যন্ত নাজুক ও দুর্বল। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সেবাপ্রদানের কাঠামো ও কৌশল এমনভাবে করা যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ওইসব ক্ষেত্রে সহজ প্রবেশগম্যতা ও ন্যায্যতা প্রাপ্তির সম্ভাবনা ঘটে না। সোজা কথায় নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে তাদের সুখকর অভিজ্ঞতা তেমন একটা হয় না। ফলে ক্ষোভ, অভিমান নিয়ে তাদের অধিকার আদায়ে লড়াই করতে হয়। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। পারিবারিক বিশেষ যতেœ বেড়ে ওঠা সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত একজন তরুণী নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আইন শাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য গেলে তাকে বলা হলো, স্বাক্ষর করতে। শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন এবং কলম ধরে স্বাক্ষর করতে পারেন না। তখন তাকে পরামর্শ দেয়া হলো নিরক্ষর কথাটা উল্লেখ করতে। তরুণী অভিমানে ঘরে ফিরে আসেন। ক্ষোভ ও অভিমানে ভেঙে পড়েন। মেধার যোগ্যতায় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আইনশাস্ত্রে পড়–য়া একজন শিক্ষার্থীর প্রতি জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানকারীদের এমন মনোভাব পোষণ মোটেও সম্মানজনক নয়। কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে মানব বৈচিত্র্যের বিষয়টি বিবেচনায় না আনা বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের মানব মর্যাদার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় বলে ভেবে নেয়া যায়। অনেকেই তাই মনে করেন। আবার অপ্রতিবন্ধী কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, সুবর্ণ নাগরিক কার্ডই তো আছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য। যে কার্ডের মাধ্যমে তারা প্রতিবন্ধী ভাতা ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধাদি পেয়ে থাকেন, পেতে পারেন। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে যারা যোগ্যতা ও সক্ষমতার ভিত্তিতে সমাজের মূলধারায় ইতোমধ্যে একীভূত হয়ে সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, রাখছেন তারা কিন্তু সুবর্ণ নাগরিক কার্ডের চেয়ে অন্য সবার মতো জাতীয় পরিচয়পত্রটাকেই বেশি পছন্দ করেন।
সুবর্ণ নাগরিক উপাধি অত্যন্ত মানব মর্যাদাসম্পন্ন নিঃসন্দেহে। কিন্তু সুবর্ণ নাগরিক পরিচয়পত্রটি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিতে ফেলে, যা সমাজের মূলধারায় একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে শ্রেণিবৈষম্যের সুযোগ তৈরি করে বলে কেউ কেউ মনে করেন। এখনো সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের করুণা, বিবেচনায় দেখতে অনেকেই পছন্দ করেন, ভাবেন। সরকারপ্রধান প্রতিবন্ধীবান্ধব হলেও সামাজিক আচার-রীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখনো একপেশে হয়ে আছেন, থাকছেন। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের আচার-রীতি-নীতিতে তাদের অবস্থান আশানুরূপভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তার একটি বড় প্রমাণ মেলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তাদের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করলে।
এছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সদৃশ রেখে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ২১টি অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে এবং এই অধিকারগুলো প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কমিটিও তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে মন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন স্তর ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রতিনিধি রয়েছেন। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ঐকান্তিক ইচ্ছায় অধিকার সুরক্ষা আইন-২০১৩ এবং অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিটি তৈরি হলেও বাস্তবায়ন ও কার্যকরের কোনো দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত নেই বলে অনেকেই মনে করেন। কমিটিতে নিযুক্তরা সভা করেছেন ঠিকই, কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি কিংবা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এসব মনিটরিং ও ফলোআপ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করা হয়নি। অথচ এসব করার জন্য লোকবল সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছেন। যা নেই তা হলো জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা। এ কথা বললে কতটা অযৌক্তিক হবে যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনের পরিবর্তন ও নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত হতে পেরেছে অধিকার সুরক্ষা আইন প্রণয়নের ৭ বছর পর তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান, তথ্য দায়িত্বশীলরা দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। সরকারপ্রধান নিজে প্রতিবন্ধীবান্ধব হলেও তার প্রশাসনে দায়িত্বে নিযুক্তদের অনেকেই হয়তো প্রতিবন্ধীবান্ধব হয়ে ওঠেননি। তাদের কাছে বিষয়টি চ্যারিটি মুডে রয়ে গেছে। কিংবা সবকিছুই কাগজ-কলমে কিংবা বক্তব্যে রয়ে গেছে। বলতেই হয় যে, প্রবেশগম্যতা ও অভিগম্যতা তাদের অধিকার হলেও সরকারের কয়টি ভবনে ও প্রতিষ্ঠানে সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে বিগত ৭ বছরে, তার অনুসন্ধান করলে সন্তোষজনক কিছু আসবে বলে মনে হয় না।
প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুরা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিন প্রচারমাধ্যমে তা প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে। নিজের প্রতিবন্ধিতার কারণে নির্যাতনের বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়াটা যেমন তার পক্ষে কঠিন কিংবা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তার চেয়েও অবর্ণনীয় মানবেতর অবস্থার কারণ হয়ে দাঁড়ায় নানা ধরনের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু প্রক্রিয়া, কৌশল, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনা আছে কিনা তা জানা নেই। কীভাবে এবং কোন কৌশলে শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, শ্রবণ ও বাক ব্যক্তিরা সাক্ষী দিতে পারেন, ন্যায় বিচার পেতে পারেন সেটা নিশ্চিত করার জন্য আইনি গবেষণার ভিত্তিতে প্রতিবন্ধীবান্ধব একটা সুস্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করা দরকার। দরকার তাদের উপযোগী পৃথক আইনি ব্যবস্থা। প্রচলিত আইন প্রক্রিয়ায় শারীরিক, মানসিক ও বুদ্ধির দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন চালানো সহজ বলে নির্যাতনকারীরা মনে করে।
এই বিশেষ জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যত আয়োজন ও উদ্যোগ, তার অধিকাংশই যেন অনুষ্ঠাননির্ভর। এই মানসিকতার পরিবর্তন না হলে অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি, শ্রেণিগোষ্ঠীর প্রচার-প্রচারণা ও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে কেবল, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়ন কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমাদের সমাজে এমন আচরণ রয়েছে যে, অসহায়কে পুঁজি করে কেউ কেউ নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেন। অমানুষ থেকেও নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রচার, প্রচারণার জন্য এমন কৌশল অবলম্বন বা আচরণ করে থাকেন। এদের চিহ্নিত করার দরকার। পরিশেষে বলব, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সুরক্ষা আইন ২০১৩ সার্বিকভাবে বাস্তবায়ন এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কর্মরত সব সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে খুঁজতে হবে, বুঝতে হবে প্রকৃত অর্থে কোন ব্যক্তি, সংগঠন প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করছে। এই তথ্য ও উপাত্ত সঠিকভাবে গ্রহণ ও নির্ধারণ না হলে স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি-গোষ্ঠীই কেবল লাভবান হবে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। সমাজের অন্যান্য সেক্টরের মতো এই সেক্টরেও সিন্ডিকেট রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। থাকলে তা নির্মূল করতে হবে।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়