পাসপোর্ট ডিজির সঙ্গে ব্রাজিল রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

আগের সংবাদ

ই-কমার্স গ্রাহকের টাকার কী হবে

পরের সংবাদ

স্যার, বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের অগ্রদূত

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

৩০ নভেম্বর (২০২১) প্রয়াত হলেন আমাদের প্রিয় শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। নজরুল বিশেষজ্ঞ এবং স্বাধীনতা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অধ্যাপকের বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। ১৯৯০ সালে যখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন স্মিতহাস্যময় ড. রফিকুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে সরাসরি পরিচয়। তিনি আমাদের তৃতীয় বর্ষে ধ্বনিতত্ত্ব পড়াতেন। তবে তার আগেই প্রথম বর্ষে নজরুলের অগ্নিবীণা পাঠের সময় নজরুলের জীবন ও সাহিত্যকর্মের বিশ্লেষণ নিয়ে তার অন্যতম গ্রন্থটি আমার পাঠ করার সুযোগ হয়। তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। শিক্ষকদের দলবাজি ও নোংরা রাজনীতি তিনি পছন্দ করতেন না। আবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দিলখোলা আড্ডা দেয়ার ক্ষেত্রেও তার স্বভাব ছিল ভিন্নমাত্রার। তিনি একাডেমিশিয়ান ছিলেন, ছিলেন প্রকৃত গবেষক এবং অনেক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যোগ্য প্রশাসক। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা নীরবে তার পাঠদান মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুনতেন। আর ক্লাসের বাইরে মিডিয়ায় তার পদচারণা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও দীপ্তময়। নজরুলবিষয়ক অনুষ্ঠানে তার বিকল্প ২০২১ সাল পর্যন্ত তৈরি হয়নি বলেই আমরা জানি।
সর্বশেষ রফিকুল ইসলাম স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল চলতি বছর মে মাসের পর। তখন তিনি বলেছিলেন করোনার প্রকোপ কমলে বাংলা একাডেমিতে এসে দেখা করতে। কিন্তু সে সময়ই জেনেছিলাম তিনি শারীরিকভাবে খুব একটা সুস্থ নন। ফলে দেখা হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। আসলে মৃত্যু এক ভয়াবহ বাস্তবতা। যারা ধর্মবিশ্বাসী তাদের কাছে মৃত্যুবরণ হতে পারে আনন্দময়। কারণ পারলৌকিক জীবনকে তারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। কিন্তু রফিকুল ইসলামের কাছে পরকালের চেয়ে ইহকাল বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি ছিলেন আমার শিক্ষক আবার আমার অনেক শিক্ষকেরও শিক্ষক। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও প্রিয় শিক্ষক, গুরুজন ও অভিভাবক।
এজন্য তার মহাপ্রয়াণে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ তার এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে হারালো, আর আমি হারালাম একজন অভিভাবককে।’ এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এই প্রত্যক্ষ সাক্ষী যেসব ইতিহাস গ্রন্থিত করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যের জন্য অমূল্য সম্পদ। নজরুল গবেষণায় ড. রফিকুল ইসলামের অবদান অনন্যসাধারণ। বিশিষ্ট এই গুণী লেখক ও গবেষকের সাহিত্যকর্ম বাঙালি জাতিকে সবসময়ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। তিনি মনেপ্রাণে জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ ও লালন করতেন এবং মুজিববর্ষের নানা আয়োজন সফল করতে দক্ষতার সঙ্গে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। বাংলা সাহিত্য ও গবেষণায় তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।’

উল্লেখ্য, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্বেও ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক ছিলেন রফিকুল ইসলাম। গত শতকের ষাটের দশকে তাকে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী কমিটির সভাপতি ছিলেন রফিকুল ইসলাম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সব আয়োজনে তাকে পাশে রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন, বিকাশ, চর্চা, প্রচার-প্রসারে অবদান রাখায় ২০২১ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি সরকার অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে প্রথম ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকে’ ভূষিত করে। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা রফিকুল ইসলাম সেই সময়ের দুর্লভ আলোকচিত্রও ধারণ করেছিলেন। তিনি অন্তত ৩০টি গ্রন্থের রচয়িতা। রফিকুল ইসলাম বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক হন। শিক্ষা, সাহিত্য ও গবেষণায় অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক পেয়েছেন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। ২০২১ সালের ১৮ মে সরকার তাকে তিন বছরের জন্য বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব দেয়।

তার এই কর্মময় জীবন সত্যিই বিস্ময়কর। আমরা যারা তার সরাসরি ছাত্র সবাই তার গুণের ভক্ত। রফিকুল ইসলাম স্যারকে আমরা সবসময় দেখেছি পরিপাটি ও ক্লিন শেভে। তিনি ক্লাসে এসে ছাত্রদের ক্লিন শেভে ক্যাম্পাসে আসার পরামর্শ দিতেন। তার রাগান্বিত চেহারা আমরা কমই দেখেছি। তবে আমার ছাত্রজীবনে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের একটি অনুষ্ঠানে তাকে বক্তৃতা না দিয়ে চলে যেতে দেখেছিলাম। কারণ তিনি যখন বক্তৃতা দিতে উঠেছেন তখন সদ্য সমাপ্তকারী পূর্ববর্তী বক্তা সভাস্থল ত্যাগের জন্য আয়োজকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, যা ছিল অনুষ্ঠানটির মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার শামিল। ফলে স্যার রাগ করলেন এবং ওই ব্যক্তির সামনে দিয়ে সভাস্থল ত্যাগ করে চলে গেলেন। অর্থাৎ গুণীর কদর দিতে না পারলে তাকে ডেকে অপমান করার কারো অধিকার নেই- এটা সেদিন তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
আমরা যতদিন জীবিত থাকব ততদিন রফিকুল ইসলাম স্যারের স্মৃতি রোমন্থন করে যাব। যতদিন দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি আমাদের ভালোবাসা দেখাতে পারব ততদিন তার প্রতিও সম্মান দেখানো সম্ভব হবে। কারণ তিনি ছিলেন দেশপ্রেমের শ্রেষ্ঠ প্রতীক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়