পাসপোর্ট ডিজির সঙ্গে ব্রাজিল রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

আগের সংবাদ

ই-কমার্স গ্রাহকের টাকার কী হবে

পরের সংবাদ

নীরব মহিরুহের বিদায়

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের মাথার ওপরের ছাদগুলো একে একে খসে পড়ছে। সর্বশেষ তারকা রফিকুল ইসলাম চলে গেলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি তার প্রস্থান এক বেদনা বিধুর ঘটনার পাশাপাশি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা। অমন পরিমিত কথা বলা আর প্রমিত বাংলায় কথা বলার মানুষ এখন আর নেই বললেই চলে। আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি ভাষা দূষণ নদী দূষণের চাইতেও ভয়ংকর। আর সে ভাষাই আজ মহাদুর্যোগের মুখে। নাটক সিনেমা কবিতা গান সব জায়গায় এমনকি মুখের কথায় ও বাংলা ভাষার ওপর এত অত্যাচার অভাবনীয়। আজকের প্রজন্ম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে জানে না। যাদের দেখে যাদের কথা শুনে জানত বা বুঝতে পারত প্রয়াত অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ছিলেন তাদের একজন।
নানা বিষয়ে পণ্ডিত মানুষটি কথা বলতেন কম কাজ করতেন অধিক। আমরা জাতীয় কবি আখ্যা দিয়ে নজরুল ইসলামকে বন্দি করে রেখেছি ঘেরটোপে। তার গান কবিতা নিয়ে আগের মতো কোনো কাজ হয় না। বরং তাকে এড়িয়ে কোনোভাবে দু-চার কথায় বন্দনা করেই কর্ম শেষ। একমাত্র্র রফিকুল ইসলামই কাজ করেছিলেন। বাংলার দুর্ভিক্ষ, ভাষা আন্দোলন, বাঙালির স্বাধিকারের লড়াই কিংবা জাতিসত্তার সংগ্রামের অগ্নিসাক্ষী জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের ইতিহাসকেই গ্রন্থিত করে গেছেন তার লেখায়।
সেই রফিকুল ইসলামই আবার নিজেকে উৎসর্গ করেছেন নজরুল সাধনায়। বিদ্রোহী কবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ জীবনী লিখেছেন তিনি, চেষ্টা করেছেন তার কর্মের আন্তর্জাতিকীকরণের।
কেমন ছিল তার জীবন বা জীবনবোধ? আজকের সমাজে যখন সাম্প্রদায়িকতা আবর হানা দিচ্ছে তখন তার দিকে ফিরে তাকানো জরুরি। সোনার চামচ মুখে জন্মাননি তিনি। নিতান্ত বাঙালি মুসলমান ঘরের সাধারণ জীবন। কিন্তু জীবনবোধ ছিল বড়।
বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ : তার বাবা ছিলেন রেলওয়ের চিকিৎসক; বাসা ছিল রেলওয়ে কলোনিতে। দশ বছর বয়সে রফিকুল ইসলাম দেখেছেন বাংলার দুর্ভিক্ষ। ১২ বছর বয়সে তাকে হতে হয়েছে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সাক্ষী। ঢাকার বাইরে থেকে এসে সেইন্ট গ্রেগরিস স্কুলে ভর্তি হলেও দাঙ্গার কারণে তাকে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়। অষ্টম শ্রেণির পর তাকে ভর্তি করানো হয় আরমানিটোলা স্কুলে।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সেই সময়টায় মুসলমান ছাত্রদের আরমানিটোলা স্কুলে ঢুকতে হতো মাহুতটুলি দিয়ে। আর হিন্দু ছাত্রদের ফটক ছিল পেছন, আরমানিটোলার দিকে।
এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘এই যে বিভাজন, এটা আমাদের আরো অসাম্প্রদায়িক করেছে। মানুষে মানুষে কেবলমাত্র বিশ্বাসের কারণে এই যে হানাহানি এবং এই যে ঘৃণা এটা যে কত অবাস্তব, এটা ছেলেবেলায় মনে গেঁথে গেছে। ছেলেবেলা থেকে আমরা একটা অসাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে গড়ে উঠেছি। চারদিকটায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার এই বিভীষিকা দেখে, এর বিরুদ্ধে ওই দাঙ্গার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের মধ্যে একটা ঘৃণা জন্মগ্রহণ করেছে।’
এই বোধ বা বিশ্বাস অনেকের হয় কিন্তু দীর্ঘ হয় না। আমৃত্যু সে ধারা বহনের শক্তিও থাকে না সবার। কিন্তু তিনি পেরেছিলেন। তার লেখা কথা জীবন আচরণে বারংবার তিনি সে পরিচয় দিয়ে গেছেন। বর্ণাঢ্য জীবন প্রবাহে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রথম নজরুল অধ্যাপক এবং নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই সময়ের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্রও তুলেছিলেন তিনি। বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের এই প্রত্যক্ষ সাক্ষী সেসব ইতিহাস গ্রন্থিত করেছেন তার লেখায়। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রথম গ্রন্থ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থসহ প্রায় ৩০টি বই লেখা এবং সম্পাদনা করেছিলেন তিনি।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একুশে পুরস্কার, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। এছাড়া এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
তিনি একসময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্যের দায়িত্বও পালন করেন এবং শেষ সময় পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৮ সালে তাকে জাতীয় অধ্যাপক ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুরু ছিলেন তিনি। কিন্তু এসব বিষয়ে থাকতেন নীরব। এ নিয়ে সুযোগ সুবিধা আদায়ের মানুষ ছিলেন না তিনি। সারস্বত সাধনা বিষয়টি এখন আমরা বুঝি না। না হলে জানতাম একজন মানুষ কতটা গভীরে গেলে কেউ নির্লোভ আর প্রচার বিমুখ হতে পারে। কিছুদিন আগে আমরা আর একজন রতœকে হারিয়েছি। সাহিত্যিক অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক। তিনিও সুবিধালোভী কেউ ছিলেন না। এবং এরা সবাই মনে প্রাণে ছিলেন বাঙালি। আজকালকার বুদ্ধিজীবীদের কেউই প্রায় সে পথ অনুসরণ করেন না। আর সে কারণেই ভয় বাড়ছে।
পরিণত বয়সে স্যারের প্রয়াণ বয়সের বিচারে হয়তো স্বাভাবিক কিন্তু সময় কি তা বলে? আমাদের মাথার ছাদ ছাতা আর আকশের মতো এরা চলে যাওয়া মানে শিল্প সাহিত্য জীবন অন্ধকারে নুয়ে পড়া। মানুষকে আজকাল বড় অসহায় মনে হয়। ডিজিটাল যুগে একা মানুষ তার একাকিত্ব কাটানোর জন্য কত ছলই না করে। কিন্তু পারে না। অন্যদিকে আছে উত্তেজনা আর জোশের ছড়াছড়ি। বাংলাদেশের সমাজে এমন সুস্থির আর প্রজ্ঞাবান মানুষের দরকার বড় বেশির তাই তার চলে যাওয়া এক অপূরণীয় লোকসান। এর কোনো বিকল্প নেই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় একাত্তরের জুলাই মাসে রফিকুল ইসলামসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা।
যুক্তরাষ্ট্রে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তৎপরতায় এবং মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির হস্তক্ষেপে তাদের সামরিক বন্দিশালা থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
সেই সময়ের বর্ণনা দিয়ে ২০১৫ সালে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘এভাবে আমরা আমাদের সহকর্মীদের তৎপরতায় ক্যান্টনমেন্টের বন্দিজীবন থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দিজীবনে এলাম। সেখানেও মুক্তিযোদ্ধা বোঝাই, কিন্তু আমাদের মনে হচ্ছিল, আমরা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এলাম।’
এমন মানুষ আর কি পাব আমরা? আমাদের সংস্কৃতির আকাশে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম একজনই। তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়