পাসপোর্ট ডিজির সঙ্গে ব্রাজিল রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ

আগের সংবাদ

ই-কমার্স গ্রাহকের টাকার কী হবে

পরের সংবাদ

অজ্ঞাতনামা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: ডিসেম্বর ৩, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পেছন থেকে আঘাত করার ফলে আমি মাটিতে পড়ে যাই, আর উঠে দাঁড়াতে পারিনি। ঐ অবস্থায় নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাদের মারতে থাকে। প্রচণ্ড আঘাতে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে, যন্ত্রণায় আমি মারা গেছি বলা যায়। মণ্ডপের পাশ দিয়ে যাবার সময় পেছন থেকে আসা মিছিলের মানুষগুলো আমাদের পেছনদিকে কেন আঘাত করেছিল আমি বুঝতে পারছিলাম না। তখন সবাই জীবন বাঁচাতে পড়িমরি করে ছুটছিলাম। এখন আমি বড় নালাটার পাশে পড়ে আছি লাশ হয়ে। পূজামণ্ডপে, বাড়িঘরে লাগানো আগুনের লেলিহান শিখা সাপের মতো নেচে নেচে ক্লান্ত হচ্ছে। পূজামণ্ডপ, বাড়িঘর, বলা যায় দাহ্য যা কিছু আছে সব পুড়িয়ে দিয়েছে। ভাগ্যিস আমি একটু দূরে পড়েছিলাম না হলে ছাই হয়ে যেতাম। ভোরের সূর্যোদয়ে আলোকিত হচ্ছে পৃথিবী। মানুষজন ধীরে ধীরে আসছে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি চারপাশ ঘিরে রেখেছে। এখন এসে কি লাভ! যা হবার তা হয়ে গেছে। টিভি ক্যামেরা নিয়ে সাংবাদিক, উৎসুক মানুষ ধ্বংসস্তূপ ঘুরে ঘুরে দেখছে। আমার লাশের দিকে সবাই করুণভাবে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ওরা কত কিছু ভাবছে। স্থানীয় লোকজন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আমাকে। আমি জানি আমাকে কেউ চিনবে না। চেনার কথাও নয়। এই এলাকায় আমি প্রথম এসেছি। কাঞ্চনের দেয়া চার হাজার ইউরো ওর বাবার হাতে পৌঁছে দিতে এবং একটি ব্যাগের ভেতর ওর বোনের জন্য কসমেটিক্স, ঘড়ি আরো টুকিটাকি অনেক জিনিসও পাঠিয়েছে কাঞ্চন। এসব নিয়েই আজ এসেছি। মাইকে পূজার গান চলছে, উৎসব উৎসব ভাব চারদিকে এখনো রয়ে গেছে। মায়ার জন্য পাঠানো ব্যাগটি হাত থেকে কেড়ে নেয় লোকগুলো। হামলাকারীদের সেøাগান, মানুষের চিৎকার, কান্না, ভাঙাভাঙি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগে নারকীয় হয়ে ওঠে পরিবেশ। অনেক চেষ্টা করেও উঠতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল পদদলিত হয়ে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছি। অজ্ঞাতনামা হিসাবে কিছুক্ষণ পর আমাকেও সনাতনধর্মী সংখ্যালঘু হিসেবে ব্যাগবন্দি করে পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যাবে। আমার পরিবার জানবে না আমি কোথায়? কয়েকদিন অপেক্ষার পরে আমার ছবিসহ পত্রিকায় নিখোঁজ সংবাদ প্রচার করবে। যেখানে লেখা থাকবে- ‘ফরিদুল আলম এখন অব্দি বাসায় ফিরেনি। কেউ খোঁজ পেলে নিচের ঠিকানায় যোগাযোগ করুন। সন্ধানদাতাকে পুরস্কৃত করা হবে।’ আমার সামনে একজন ঘটনার বর্ণনা করুণভাবে লাইভ প্রচার করছে। সারা বিশ্ব জেনে গেছে পূজা-পরবর্তী লুটপাট, সহিংসতার কথা। এভাবেই আমার মৃত্যু হবে আমি কি কখনো ভেবেছিলাম? আমার খুব কান্না পাচ্ছিল আমার মা-বাবা, ভাইবোনদের চেহারাগুলো বারবার দেখতে পাচ্ছিলাম। দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেবার দিনগুলো কত ভয়াবহ ছিল। পাহাড়, নদী-নালা, সীমান্ত প্রহরীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাওয়া। ছোট্ট নৌকায় গাদাগাদি করে সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে রাতের অন্ধকারে কূলে ভেড়া। তখনো কতবার মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরে এসেছি। অথচ আজ নিজ দেশে স্বজাতির হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমার যদি স্বাভাবিক কিংবা দুর্ঘটনায়ও মৃত্যু হতো অন্তত লাশটাকেও সম্মান দেয়া হতো। কিন্তু আমার লাশটা নালার পাশে বিশ্রীভাবে পড়ে আছে। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় মারপিট হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ কেন হলো বুঝতে পারছিলাম না। এটা কি দাঙ্গা? তা-ও না। এক পক্ষ হামলা করেছে। কেউ বাধা দেয়নি। বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় আমাদের এলাকায় হিন্দুরা আতঙ্কে ছিল কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। আলো ঝলমল উৎসবের আনন্দের সময় নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল। এমনই এক দাঙ্গা চলাকালীন সময়ে আমার দাদু প্রাণ বাঁচাতে সহায়-সম্পত্তি ফেলে চিরদিনের জন্য দেশান্তরী হয়েছিলেন। সেই দিনটিও নিশ্চয়ই এমনই ছিল। কাঞ্চনের দেয়া জিনিসগুলো ওর বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়ে আমি চিরতরে হারিয়ে গেলাম। এটাই নিয়তি। কার মৃত্যু কখন, কোথায়, কীভাবে হবে কেউ জানে না। কাঞ্চন আমার ভালো বন্ধু ছিল। প্রবাসে সেই ছিল সুখ-দুঃখের সাথী। সেও নিঃসঙ্গ হয়ে গেল। এই সুন্দর পৃথিবীটাকে আজ আরো সুন্দর মনে হচ্ছে। কী সুন্দর ভোরের আকাশ। নীল আর সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। আমাকে পিটিয়ে মারুক বা অপঘাতে মরি দুঃখ নেই। কিন্তু যাদের কাছে এসেছি তারা কি বেঁচে আছে? নাকি আমার মতো লাশ হয়ে রক্তাক্ত দেহগুলো এদিক-ওদিক পড়ে আছে। মায়ার কথা কাঞ্চনের মুখে অনেক শুনেছি। বিয়েতে কাঞ্চন আসতে পারবে না জেনে মায়া বিয়ের তারিখ পেছাতে বলেছিল। ওর বিয়েতে ওর দাদা থাকবে না কিছুতেই মানতে পারছিল না মায়া। অনেক বোঝাপড়া শেষে বাস্তবতা মেনে মায়া রাজি হয়েছিল। কাঞ্চনের হয়ে আমাকেই বড় ভাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে কাঞ্চন। এতেই কিছুটা শান্ত¡না পরিবারের।
কাঞ্চনের পরিবারের কেউ আমাকে আগে দেখেনি। ভাগ্যান্বেষণে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের দুই প্রান্তের দুই তরুণ আমি আর কাঞ্চন জার্মানিতে এসেছিলাম। ইতালিতে পরিচয় সেখানেই বন্ধুত্ব। তারপর আবার জার্মানিতে থিতু হওয়া। আট বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে এই প্রথম আমি দেশে এসেছি। সপ্তাহখানেক বাসায় থেকে কাঞ্চনের পাঠানো জিনিসপত্র নিয়ে ওর বাসায় রওনা দিয়েছি। ট্রেন থেকে নেমে জুমার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরুতেই মায়া ফোন করেছিল। বললাম আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। মায়ার কণ্ঠস্বরটা আমি কান পাতলেই শুনতে পাই। ‘ভাইয়া’ তিন অক্ষরের এই শব্দটি আমার কাছে এত মধুর মনে হবে আমি ভাবতেও পারিনি। আমার নিজের কোনো ছোট বোন নেই। কিন্তু মায়াকে আমার মনে হতো সে আমার মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া বোন। তাকে একবার দেখার ভীষণ ইচ্ছে। সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় পৌঁছেই কাঞ্চনের ফোন পাই। ও বলল বন্ধু- আমার ছোট বোনটা অস্থির করে ফেলছে তুমি পৌঁছেছ কিনা।
প্লিজ ওর সাথে ফোনে কথা বল। – হ্যালো। – ভাইয়া কি অদ্ভুত! মায়ার সাথে কখনো কথা হয়নি অথচ রিসিভার তুলেই ও বললো ‘ভাইয়া’ – এক সপ্তাহ পরে আসছি। তোমার জন্য পাঠানো সব কিছু নিয়ে আসবো চিন্তা কোর না। তোমাকে দেখার আমারও ইচ্ছে। মায়ার সাথে কথা বলে মনে হলো ও যেন আমার কত চেনা। অনেক আগে এ শহরে একবার এসেছিলাম। প্রায় পনেরো বছর হবে। তখন কাঞ্চনের সাথে পরিচয় হয়নি। শহরটা অনেক বদলে গেছে। কাঞ্চনের দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী ওদের মহল্লায় চলে এলাম। ইচ্ছে করেই ফোন করলাম না মায়াকে চমকে দেবার জন্য। ঘণ্টাখানেক থেকে চলে যাবো। পরে আবার আসবো। ঠিকানা অনুযায়ী মায়াদের বাসার সামনের পুকুর ঘাটের পাশেই পূজার মণ্ডপ সাজানো হয়েছিল। ট্যাক্সি থেকে নেমে ওদের গলিতে ঢুকতেই মানুষের ছোটাছুটি, সেøাগান, চিৎকার ভাঙচুরের শব্দ শুনে ভয় পেয়েছিলাম। মুহূর্তেই সব কিছু যেন বদলে গেল। কিছু বোঝার আগেই মাথায় আঘাত পেয়ে লুটিয়ে পড়েছি। আঘাতের পর আঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত জেনে ওরা সরে পড়েছে। সন্ধ্যা থেকে সকাল অব্দি আমি এভাবেই পড়ে আছি।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়