মাহমুদুর রহমান মান্না : খালেদা জিয়া এখন তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে যাচ্ছেন

আগের সংবাদ

ওমিক্রন ঠেকাতে চার সুপারিশ

পরের সংবাদ

স্বাধীনতার পঞ্চাশে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ অনেক বদলে গেছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশকে পেছনে ফেলে ধারাবাহিকভাবে এক ঈর্ষণীয় সাফল্য ধরে রেখে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সারাবিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের জীবন্ত উদাহরণ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যে উন্নয়ন, এর ৭০ শতাংশ হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের এই আমলে অর্থাৎ গত ১২ বছরে। যা হাসিনা যুগ হিসেবে ধরা হয়। ৮০ শতাংশ কৃষিনির্ভর একটি দেশ ধীরে ধীরে কৃষিকে পেছনে ফেলে সেবা ও শিল্প খাত হয়ে উঠেছে জিডিপিতে অবদান রাখা প্রধান ও দ্বিতীয় খাত। ফলে কর্মসংস্থান বেড়েছে। বিশেষ করে নারী কর্মসংস্থান উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত মজবুত হয়েছে, তৈরি হয়েছে উদ্যোক্তা শ্রেণি। যা টেকসই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখছে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আর বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল নয়। খাদ্যশস্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য এসেছে। দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন এবং লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে আমাদের অর্জনগুলো নিয়ে এখন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ ও পূর্বাভাস দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে বিদেশে লেখা হচ্ছে বই। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন অর্থনীতি ও সামাজিক বেশিরভাগ সূচকে উদীয়মান একটি রাষ্ট্র। সিএনএন জার্মানির বিজনেস নিউজের সাবেক সঞ্চালক ড্যানিয়েল সিডল তুলে ধরেছেন ‘বাংলাদেশের ৫০ বছর’ নামে তার ওই বইয়ে। বইটি বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের হারে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়, তখন অনেকেই সেটিকে আকস্মিক সৌভাগ্য বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু সেই থেকে প্রতি বছরই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগোতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন বিস্ময়করভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। মাথাপিছু জিডিপির হারে পাকিস্তানকে বেশ পেছনে ফেলে এখন ভারতকেও ছাড়িয়েছে। নতুন ভিত্তিবছরের (২০১৫-১৬) হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ মার্কিন ডলার হয়েছে। এতদিন পুরনো ভিত্তিবছর (২০০৫-০৬) অনুযায়ী, মাথাপিছু আয় ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। ফলে মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১১ বি. ডলার। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ২৪ বি. ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে। বহুল সমালোচিত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতেও গত ৫০ বছরে রয়েছে বড় অর্জন। বিশেষ করে মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যের অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৩ বছর। যা প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান এমনকি বৈশ্বিক গড় আয়ুর চেয়েও বেশি। বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন নেতৃত্বের আসনে রয়েছে। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প সমৃদ্ধশালী হয়েছে। ৫০ বছর আগের তুলনায় দেশ এখন অনেক শক্তিশালী। সামগ্রিকভাবে দেশে উল্লেখযোগ্য অর্জন থাকলেও হতাশার জায়গাও কিন্তু কম নয়। পঞ্চাশ বছরেও অনেক কিছু বদলায়নি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি নরওয়ের অর্থনীতিবিদ ইয়ুস্ট ফালান্দের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রতিবেদন করা হয়। যেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নীতি, অর্থনীতির লক্ষ্য, মন্ত্রিসভা ও প্রশাসনের অদক্ষতা ও তীব্র দুর্নীতি নিয়ে কঠোর কিছু মন্তব্য করা হয়েছে। এর অনেক পরে ২০০৭ সালে পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম ‘বাংলাদেশ জাতি গঠনকালে এক অর্থনীতিবিদের কিছু কথা’ বইয়ে লিখেছেন, এখন যদি কেউ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনের এবং সরকারের প্রতিক্রিয়ার কথা স্মরণ করে, তাহলে মনে হবে বাংলাদেশের এ ক্ষেত্রে ৩০ বছরে তেমন কিছু বদলায়নি, আজো বাংলাদেশ এবং তার উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে দুর্নীতি। কেবল ৩০ বছর পরেই নয়, এটি স্পষ্ট স্বাধীনতার এই ৫০ বছরেও সব উন্নয়নের পাশাপাশি বিষয়বস্তু তেমন বদলায়নি। এখনো বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে চলার প্রধান প্রতিবন্ধকতা দুর্নীতি, আইনের শাসনের অভাব, জবাবদিহির অভাব, দুর্বল প্রতিষ্ঠান, রাজনীতিকরণ, সংঘাতপূর্ণ ও পৃষ্ঠপোষকতার রাজনীতি। ফলে বাংলাদেশ হয়ে ওঠেছে লুটপাটের এক স্বর্গরাজ্য। বাংলাদেশে এক নতুন ধনিক শ্রেণির বিস্তার ঘটেছে; এর সূচনা হয়েছিল সেনাশাসনের আওতায় ১৯৮০-এর দশক থেকেই। কিন্তু তা ব্যাপক রূপ নিয়েছে ১৯৯০-এর পরে। রাষ্ট্রীয় পরিপোষণে এই শ্রেণি বেড়ে উঠেছে। হতাশার বিষয় হলো- সম্প্রতি সরকারের ‘এ’ ক্যাটাগরির কেপিআইভুক্ত (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন) প্রতিষ্ঠান বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, যা সার্বক্ষণিক কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে থাকে। সেই সচিবালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ‘স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ’ বিভাগ থেকে ১৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরি হয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বব্যাপী সত্যিই বিরল ও ন্যক্কারজনক। এটি ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে থাকবে। স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক দুর্নীতিই ২০২০ সালের দুর্নীতির ধারণাসূচকে আমাদের ডুবিয়েছে। অনুরূপভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের’ (এমসিসি) মূল্যায়নে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণসহ ২০ সূচকের মধ্যে ১৬টিতেই বাংলাদেশ রেড জোনে পড়ে রেকর্ড করেছে। সম্প্রতি ২০২২ সালের জন্য বাংলাদেশের মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে মার্কিন এই সংস্থা। এক্ষেত্রে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এত হতাশার মধ্যেও আশার কথা হলো, দেশে একশ্রেণির ভোক্তা তৈরি হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ডেটা ল্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে এশিয়ায়-বাংলাদেশের ভোক্তাশ্রেণির বিকাশ হবে সবচেয়ে বেশি। ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট ভোক্তাশ্রেণির মানুষের সংখ্যা ছিল সাড়ে ৩ কোটি। যা ২০৩০ সাল নাগাদ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে ৮ কোটি দাঁড়াবে। এই সুবাদে বৈশ্বিক ভোক্তাশ্রেণির তালিকায় বাংলাদেশ ১৭ ধাপ এগিয়ে যাবে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার জোরদারে এই ভোক্তাশ্রেণির ভূমিকাই প্রধান। মাথাপিছু আয় বাড়লে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ভোগ্যব্যয়ও বাড়ে। আর তার ওপর ভর করেই এগিয়ে চলে দেশের অর্থনীতি। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে- উন্নয়ন, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের এই কালপর্বে নব্বই দশকের শেষ সময়ে এর সঙ্গে সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে একটি ঝোঁক তৈরি হয়েছে এবং এটি এখন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আষ্টেপৃষ্ঠে জাতির মনোজগতে গেঁথে আছে। বিশেষ করে, জনমিতিক লভ্যাংশের এই পর্বে যখন একটি দেশ অধিক জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে যাবে। নেতৃত্বে থাকবে তরুণরা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তরুণদের মধ্যেই রাজনৈতিক এই অতি ঝোঁক। আবার স্বাভাবিকভাবে এটি সরকারি দলের সমর্থকদের মধ্যেই বেশি দেখা যাচ্ছে। কারণ, সবাই রাজনীতির উচ্চাকাক্সক্ষার আড়ালে তোষণনীতির মাধ্যমে ক্ষমতার রস আস্বাদন করতে চায়। ক্ষমতাচর্চায় প্রশান্তি খুঁজে পায়। অথচ শিক্ষার মান আজ তলানিতে। শিক্ষার মান বিশ্লেষণ বলছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের শিক্ষার মান ২ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কায় ২০ দশমিক ৮ এবং পাকিস্তানের শিক্ষার মান ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন শিক্ষার এই বেহাল দশা। কারণ শিক্ষা ক্ষেত্রে যথাযথ কাজ না করে সবকিছু রাজনীতিকরণ হচ্ছে। ধনী-গরিব, ব্যবসায়ী, ছাত্র-শিক্ষক, যুবক, কৃষক কিংবা সরকারি চাকরিজীবী কর্মকর্তা-কর্মচারী সবার মধ্যেই এই অতিরাজনীতির প্রবণতা প্রবলভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। এই শ্রেণির জনগোষ্ঠীর মাঝে দেশের যে কোনো পেশার চেয়ে রাজনীতি পেশা হিসেবে নেয়ার আগ্রহ লক্ষণীয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যে পেশায়-ই থাকুন না কেন নিজেকে সরকারদলীয় রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ে গর্ববোধ করেন এবং তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে। যা সরকার নিজেদের ক্ষমতা স্থায়ীকরণে সুকৌশলে আপামর জনসাধারণের মনে রাজনৈতিক এই বিষবাষ্প ঢুকিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন বিজ্ঞজনেরা। ফলে সরকার এখন সুফল পাচ্ছে ঠিকই কিন্তু কালক্রমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞানসমৃদ্ধ জাতি গঠনে এই অপকর্ম ও মিথ্যা দম্ভোক্তির ভোগান্তির শেষ থাকবে না। জাতি হিসেবে আমরা দেউলিয়া হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই, দেশ আজ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে ঠিকই; কিন্তু এর সঙ্গে দুর্নীতির অবাধ প্রবাহ যে বন্যার আশঙ্কা তৈরি করছে তাতে জীবন বাঁচাতে হাবুডুবু খাচ্ছে দেশের বিশাল এক দরিদ্র জনগোষ্ঠী। আর নিজেদের আখের গোছাচ্ছে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী একশ্রেণির লোকজন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র আজ বঙ্গবন্ধুর নৌকায় উঠে বসে আছে। আর উজানে গুণ টানছে দেশের খেটে-খাওয়া সাধারণ জনগণ। এভাবে চলতে থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে প্রচেষ্টা-বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশকে নেতৃত্বের পর্যায় নিয়ে যাওয়া, তা অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আর তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প ২০৪১ উন্নত, সমৃদ্ধ ও উচ্চ আয়ের দেশে উপনীত হওয়ার যে স্বপ্ন- তা অধরাই থেকে যাবে।

মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম : পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়