পুলিশের স্থাপনায় হামলার ঘটনায় মামলা : আসামি অজ্ঞাত কয়েক হাজার

আগের সংবাদ

‘ওমিক্রন’ নিয়ে সতর্ক সরকার

পরের সংবাদ

‘আই অ্যাম ইনচার্জ’ এবং ব্রিটেনের গণতন্ত্র

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত দুই সপ্তাহ থেকে ব্রিটেনে পার্লামেন্ট সদস্যদের নিয়ে চলছে বড় ধরনের আলোচনা। বিশেষত সরকারদলীয় অর্থাৎ কনজারভেটিভ পার্টির এমপিদের অনেকেই আছেন, যাদের অন্য কাজ আছে। কনসালটিং, ব্যবসা, উপদেশক প্রভৃতি দিয়ে পার্লামেন্টের বেতনের বাইরেও তারা অর্থ উপার্জন করে থাকেন। কিন্তু বিষয়টি লোকচক্ষুর অন্তরালে অর্থাৎ আলোচনায় খুব একটা আসেনি।
টাইমস নিউজ পেপার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে সম্প্রতি। যেসব এমপি সেকেন্ড জব হিসেবে আয় করছেন, প্রচলিত আইন অনুযায়ী তা না দেখিয়ে নিজস্ব কোম্পানির নামে চালিয়ে দিচ্ছেন, অথবা অন্য কোনোভাবে এটা দেখাচ্ছেন অর্থাৎ বড় ধরনের কর ফাঁকি দিচ্ছেন এতে।
সাধারণত দ্বিতীয় জব থেকে আয় করা হলে তার ৪৫ শতাংশ সরকারকে কর দিতে হয়। অন্যদিকে প্রাইভেট কোম্পানি মাত্র ১৯ শতাংশ কর প্রদান করে। সেজন্য একজন এমপি যখন সেকেন্ড জব থেকে কনসালটেন্স বাবদ আয় করেন, তখন আইনত কোনো বাধায় পড়েন না। কারণ তার আইনগত ভিত্তি আছে। কিন্তু যখন আয় তার নিজের সেকেন্ড জব হিসেবে সরাসরি না দেখিয়ে নিজস্ব ফার্ম কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে দেখান তখন তাকে ৪৫ শতাংশ কর দিতে হচ্ছে না। এবং তা উদ্দেশ্যমূলকভাবেই একেকজন এমপি করছেন বলে টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে আসে। যে কোনো বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ তার ‘পার্লামেন্ট সময়’র বাইরে অর্থাৎ অতিরিক্ত সময়ে ভিন্নভাবে উপার্জন করতেই পারেন। এটা আইনবহির্ভূত নয়, কিন্তু বিশেষত পার্লামেন্টের মেম্বার হওয়ার পর রাষ্ট্রে তিনি ভিন্ন এক ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এবং তখন তিনি যে কোনো জায়গায় বিশেষ ব্যক্তি হিসেবে সমধিক পরিচিতি পান। যা তার কনসালটেন্সিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। এর মাঝে এমনকি কেউ কেউ কোনো কোনো কোম্পানির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের কিছু কাজ বাগিয়ে নিতে লবিও করেছেন, যার মাঝে ওয়েন পিটারসনের নাম উঠে এসেছে।
আর এভাবেই পার্লামেন্টের বেতনের বাইরে তারা লাখ লাখ পাউন্ড আয় করছেন এবং ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। প্রায় ৩০ জন এমপি আছেন, যারা ৪ লাখ পাউন্ডের ওপর আয় করছেন বছরে এভাবে। এদের মাঝে এমনও আছেন, যিনি মাত্র আড়াই দিনের কাজে ১৫ হাজার পাউন্ড আয় করেন। এদের প্রায় সবাই হলেন সরকারদলীয় এমপি। পার্লামেন্টের নীতি অনুযায়ী তারা ‘রেজিস্টার অব ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টারেস্টে’ নিজেকে নথিভুক্ত না করেই তা করছেন। আর সেজন্যই আয়ের ব্যাপারটা অন্যায়ের পর্যায়ে না পড়লেও এমপিরা নীতিবহির্ভূত কাজ করছেন বলেই ধরা হচ্ছে।
লেবার এমপি এবং পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির প্রাক্তন প্রধান মার্গারেট হজ সংবাদপত্রকে বলেছেন, ‘এটি সম্পূর্ণরূপে আপত্তিজনক। আমরা, সংসদ সদস্য হিসেবে আমাদের অর্থাৎ নাগরিকদের প্রত্যেককে যে ট্যাক্স দিতে হবে তা নির্ধারণ করি অথচ আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তা না মেনে ব্যক্তিগত সার্ভিস সংস্থাগুলো এভাবে ব্যবহার করে কর ফাঁকি দেয়া একটা কলঙ্কজনক দিক।’
এ নিয়ে গণমাধ্যম যেমন সরগরম, ঠিক তেমনি উত্তাপ ছড়িয়েছে হাউস অব কমন্সে। গত ১৭ নভেম্বর পার্লামেন্টে প্রাইম “মিনিস্টার’স কোয়েশ্চনস” টাইমে এ নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক। বিভিন্ন এমপি এ নিয়ে যখন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছেন, তখন তিনি এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে বরং এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। এমনকি বিরোধীদলীয় নেতা স্টারমার এ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে তাকে প্রশ্ন ছুড়ে মারেন। স্পিকার স্যার লিনডসে হয়লি তখন মনে করিয়ে দেন যে, এটা প্রাইম মিনিস্টার’স কোয়েশ্চন, বিরোধী দলের নেতার নয়। তারপর আবারো স্টারমার তার দল লেবার পার্টির ব্যাপারে তিনি তার সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন এবং প্রশ্ন করেন প্রধানমন্ত্রী কী ব্যাখ্যা দেবেন কিংবা দুঃখ প্রকাশ করবেন নাকি এই স্ক্যান্ডালকে কাভার-আপ দেবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে লিডার নন, কাওয়ার্ড (ভীরু) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আবারো পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে মারেন, যা সংসদীয় নীতিমালার মধ্যে পড়ে না, এমনকি তা অনেকটা সংসদীয় আইন লঙ্ঘনের পর্যায়েই পড়ে।
স্পিকার তখন কিছুটা বিরক্ত হয়ে আবারো মনে করিয়ে দিলেন এটা প্রাইম মিনিস্টার’স কোয়েশ্চন টাইম। অনেকটা ক্রোধান্বিত হয়ে বরিস জনসনকে বলেন, ‘বসুন (সিট ডাউন)- আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, ইন দিস হাউস, আই অ্যাম ইনচার্জ’। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিসকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না যদিও, কিন্তু সংসদীয় নীতিমালার কাছে এ সংসদে তিনিই প্রধান; আর তাই কিছু সময়ের জন্য সংসদ স্তব্ধ হয়ে যায় তখন এবং প্রধানমন্ত্রী বসে পড়েন।
গণতন্ত্রের এই এক সফলতা। শুধু নীতি-প্রথা এবং আইনের সুদৃঢ় ভিত্তির কারণেই বিশ্বের একজন প্রবল প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী মুখ বন্ধ করে নেন, একজন স্পিকারের স্পষ্ট ভাষায় নিজ আসনে বসতে বাধ্য হন তিনি। কোনোরকম বক্তৃতার পরিবেশ সৃষ্টি থেকে বিরত থাকেন, বিরোধী দলের গুষ্টি উদ্ধার থেকে বিরত থাকতে হয় তাকে। সংসদ সংসদের মতোই চলতে থাকে। একজন দায়িত্বশীলের মতোই তখন থেকে প্রধানমন্ত্রী শুধু প্রশ্নের উত্তরই দিতে থাকেন।
টাইমস পত্রিকার খবরের পেছনের এই সংবাদ অর্থাৎ এমপিদের অনৈতিক চিত্র উঠে আসায় একটা ঝাঁকুনি এসেছে সংসদে। সে জন্য এমপিদের দ্বিতীয় জবের জন্য সরকার এই বিব্রতকর অবস্থা এড়াতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। বিরোধী দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকলেও সরকারদলীয় অনেক এমপিই এতে প্রধানমন্ত্রীর ‘কাভার-আপে’র পক্ষে না-ও থাকতে পারেন। এমনকি ধারণা করা হচ্ছে, কনজারভেটিভ দলীয় ওই ৩০ জনেরও বেশি এমপিকে হয়তো বা তাদের দ্বিতীয় জব করা থেকে বিরত রাখতে দল থেকে চাপ প্রয়োগ করা হতে পারে।
আইনের প্রতি দৃঢ়তা থাকাটাই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। গণতন্ত্র এভাবেই আরো সমৃদ্ধ হয়, দৃঢ় হয়। যে যত ক্ষমতাধরই থাকুন না কেন, যার যার অবস্থান সম্পর্কে খেই হারিয়ে ফেললে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীকেও স্পিকারের ধমক খেতে হয়। এবং কথা না বাড়িয়ে সংসদের নিয়ম-নীতি মেনে চলতে হয়। ব্রিটেনের রাজনীতিতে অস্বচ্ছতা যে নেই তা নয়, তবে সাধারণ নাগরিকদের চোখে পড়ে এমন স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে রাজনীতিবিদরা ধাক্কা খেলে বিতর্কে না গিয়ে কিংবা বিজয়ী হওয়ার জন্য অযথা কথা বাড়ান না। আর সেজন্যই স্পিকারের ‘ইন দিস হাউস, আই অ্যাম ইনচার্জ’ বাক্যটিতে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী যদিও সাময়িকভাবে লজ্জিত হয়েছেন, তবে ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্যই প্রতিফলিত হয়েছে এতে।
ফারুক যোশী : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়