নরসিংদীতে আটক নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান

আগের সংবাদ

‘তোরে আমি কি জন্য একা যাইতে দিলাম’

পরের সংবাদ

মহামারিতে ধর্ষণের ঘটনা কেন বেড়েছে?

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত ২২ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদের সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘করোনা ভাইরাস মহামারির সময় খুন-ডাকাতি কমলেও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে।’ করোনা মহামারিতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে, এ ধরনের কথাবার্তা আমরা শুনছিলাম অনেক দিক থেকে। কিছু কিছু এনজিও এ রকম কিছু তথ্য আমাদের সামনে আনার চেষ্টা করেছিল। যেহেতু এনজিওর-ও একটা নিজস্ব রাজনীতি আছে, সেহেতু এসব তথ্য আমাদের মনোযোগ খুব একটা আকর্ষণ করছিল না। কিন্তু যখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ তথ্য দেন তখন এটাকে সত্য, নির্ভরযোগ্য এবং সরকারি তথ্য হিসেবে আমরা ধরে নিতে পারি। এবং সে কারণেই নৃবিজ্ঞানের একজন পেশাজীবী হিসেবে আমার কাছে এ তথ্যটি বিশেষ আগ্রহের জায়গা দখল করেছে। কেননা এসব তথ্যের সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় নানান সম্পূরক প্রশ্নের জন্ম হয়, যেমন- মহামারির সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ক কী? মহামারিতে মানুষ যখন নিজের জীবন বাঁচানোর ঝুঁকির মধ্যে থাকে, তখন ধর্ষণের মতো মানবিক বিকৃতির ঘটনা কেন বেড়ে যায়? তাছাড়া কেবল পরিসংখ্যানই কি আসল চেহারার জানান দেয়, নাকি প্রকাশিত চেহারার পেছনে আরো অধিকতর বিকৃত কোনো সুরত লুকিয়ে আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পাশাপাশি কেন করোনা মহামারিতে ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে তার একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে আজকের কলামে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মোট ঘটনা ছিল ২১ হাজার ৭৮৯টি, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৮ হাজার ৫০২টি। সে হিসাব অনুযায়ী নারীর প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ইউএন উইমেনের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ইউএন উইমেন জানাচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি নারী হেল্পলাইনে ফোন করেছে। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, করোনা ভাইরাসের মহামারিতে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা দুনিয়ায় উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। সুতরাং নারীর প্রতি সহিংসতা এবং ধর্ষণের জন্য কেবল বাংলাদেশই একমাত্র নেতিবাচক উদাহরণ তা নয়। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে এটাও অনস্বীকার্য যে, যা কিছু পরিসংখ্যানে আসে সেটা প্রধানত মিডিয়ায় প্রকাশের হাত ধরে এবং আইন-আদালতের নথিভুক্তির হাত ধরে আসে। কিন্তু নির্যাতন এবং ধর্ষণের অসংখ্য ঘটনা লাজ-লজ্জার ভয়ে, লোক-লজ্জার ভয়ে, মান-সম্মানের ভয়ে অনেক নারী প্রকাশ করে না। ফলে যে চিত্র আমাদের সামনে উপস্থাপিত হয়, সেটা সমাজে ঘটে যাওয়া ঘটনার আসল এবং প্রকৃত চিত্র নয়। তথাপি প্রকাশিত চিত্রই সমাজে নারীর অধস্তনতা, নারী-পুরুষের লৈঙ্গিক অসমতা এবং পুরুষাধিপত্যবাদের একটা অসুস্থ চেহারা আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। কিন্তু সমাজে জারি থাকা নারী-পুরুষের এ লৈঙ্গিক অসমতার সঙ্গে করোনা মহামারি কী এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য যোগ করেছে যে, মহামারিকালে নির্যাতন এবং ধর্ষণের ঘটনা প্রায় ১৭.৭৬ শতাংশ বেড়ে গেছে, সেটা উপলব্ধি করা জরুরি।
আমার কাছে মনে হয়, তিনটি কারণ এর জন্য প্রধানত দায়ী। প্রথম, মহামারিকালে বাংলাদেশের অনেক মানুষ একটা চরমভাবে অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে গেছে। ফলে নানা ধরনের হতাশা, জীবনের অনিশ্চয়তা এবং সন্তান-সন্ততির পড়ালেখার খরচ জোগানো টানাটানি, সংসার চালানোর কষ্ট এবং নানা দায়-দেনার ভেতর অনেক মানুষ এ করোনা মহামারির সময়টা পার করেছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্তের মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তেরও একটা বড় অংশ নানান আর্থিক সংকটের ভেতর দিয়ে মহামারির সময়টা পার করেছে। এ ধরনের হতাশা থেকে পারিবারিক আবহে সংসারে নানা দ্ব›দ্ব-কলহ লেগেই ছিল। ফলে এ সময়টাতে ডমিস্টিক ভাইলেন্স বা গৃহস্থ নির্যাতনের ঘটনা পারিবারিক আবহে অহরহ ঘটেছে। অতএব মানুষের ক্রমবর্ধমান হতাশা, আর্থিক সংকট ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কারণেও নির্যাতনের পরিমাণ বেড়েছে, যদিও ধর্ষণের প্রবণতা বাড়ার জন্য এটাকে দায়ী করা যাবে না। দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে পুরুষের ওপর নারীর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা, বিশেষ করে মহামারিকালে কিছুটা বাড়তি নির্ভরশীলতা। কোভিড মহামারিকালে অনেক নারী চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে তৈরি পোশাক কারখানার পোশাক-শ্রমিক, বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কর্মরত গৃহস্থকর্মী এবং বিভিন্ন দিনমজুর নারী শ্রমিকের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। ফলে তাদের অনেকে ‘দেশের বাড়ি’ এবং ‘গ্রামের বাড়ি’ চলে যান। সেখানে অনেকে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে ধর্ষিত হন। আর যারা শহরে অবস্থান করছিলেন তারাও নিজেদের পুরনো সহকর্মী, আত্মীয়, বন্ধু, পরিজনের দ্বারস্থ হয়েছেন নানাভাবে সহযোগিতার প্রত্যাশায়। এ রকম অসহায়ত্বের সুযোগকে কাজে লাগিয়েছে অনেক পুরুষ, যাতে অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মার্চ ২০২০ সালের পর সংবাদপত্রের পাতায় সচেতন চোখ রাখলেই দেখা যাবে যে, প্রচুর নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন যাদের অসহায়ত্বই তাদের ধর্ষণের অন্যতম কারণ। এছাড়া যেহেতু করোনাকালে বাইরে লোকজনের যাতায়াত ও জনসমাগম তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে, সেহেতু সুযোগসন্ধানীরা এসব অলোকারণ্যের সুযোগকে ব্যবহার করে তাদের বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ ঘটাতে এতটুকু চিন্তা করেনি। বরং সুযোগের যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে, সমাজে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচারের অভাব। যেসব ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে, যেসব ঘটনার জোরালোভাবে মামলা-মোকদ্দমা হয়, মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা হয়, সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনে নিয়মিত আলাপ-আলোচনা হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি তীব্র সমালোচনার ঝড় ওঠে এবং নারী সংগঠনগুলো বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়, সেসব ধর্ষণের ঘটনারও বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে সমাজে ধর্ষণের বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। যেহেতু করোনা মহামারির সময় বিদ্যমান সুযোগে আরো সম্প্রসারিত হয়েছে, সেহেতু সমাজের বিকৃত মনোবৃত্তির লোকজন ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে নিয়মিতভাবে। পাবলিক এবং প্রাইভেট উভয় পরিসরে ধর্ষণের অসংখ্য ঘটনা ঘটে এ করোনা মহামারির কারণে। নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা প্রায় ১৮ শতাংশ বাড়ার পেছনে একটা অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সমাজে ধর্ষণের বিচারহীনতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা। আর মহামারিকালে ধর্ষণের প্রবণতা বেড়ে গেছে, কারণ সুযোগসন্ধানীরা সুযোগের ব্যবহারে কখনো পিছপা হয় না।
পরিশেষে সমাজের বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতা, পুরুষাধিপত্যবাদ এবং নারীকে অধস্তন করে উপস্থাপনের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে নারী নির্যাতনের জন্য এবং ধর্ষণের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার জন্য বহুলাংশে দায়ী হলেও চলমান করোনা ভাইরাসের মহামারিকালে সেটার প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কারণ মহামারিতে ধর্ষণের সুযোগ এবং পরিসরেরও পরিবৃদ্ধি ঘটেছে। কেননা করোনা মহামারিকালে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি অধিকতর দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ধর্ষক শ্রেণির বিকৃত মানসিকতার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। অধিকন্তু মহামারির সুযোগকে তারা তাদের বিকৃত প্রবৃত্তি ও মনোবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য কাজে লাগিয়েছে। একটি সুস্থ, সুষ্ঠু ও নারী-পুরুষের সমমর্যাদার সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করা না গেলে সমাজে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা কখনোই কমবে না। আর সেজন্যই সরকারের সঙ্গে সমাজকেও সমান সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হবে। তবেই আমরা একটি সুস্থ সমাজের প্রত্যাশা করতে পারি।
ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়