নরসিংদীতে আটক নবনির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান

আগের সংবাদ

‘তোরে আমি কি জন্য একা যাইতে দিলাম’

পরের সংবাদ

আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দরপতন সমন্বয় হবে না এখন?

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২৪, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ববাজারে জ¦ালানি তেলের দরপতন ঘটেছে। ব্যারেলপ্রতি জ¦ালানি তেলের দর ৮০ ডলারের নিচে নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন তার মিত্রদের কাছে অনুরোধ করেছিল তাদের সংরক্ষিত তেল বাজারে ছেড়ে দিতে। সবাইকে চমকে দিয়ে চীন কাজটি করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র-চীন অনেক দিন ধরে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত। করোনা সংক্রমণ ও ট্রাম্পের পরাজয়ে বাণিজ্যযুদ্ধ কিছুটা কমলেও নিঃশেষ হয়নি। সেখানে চীন এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ রাখবে তা ভাবা যায়নি। চীনের এমন অভাবনীয় সিদ্ধান্ত কমিয়ে দিয়েছে তেলের দাম।
বিশ্ববাজার দৃষ্টে বাংলাদেশে ডিজেল-কেরোসিন, গাড়ি ভাড়া, নিত্য পণ্যের বাড়তি দাম কমবে এখন? খোলাসা কোনো জবাব নেই। জবাবের যেন কর্তৃপক্ষও নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর বাড়ায় পরিবহন ভাড়াসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে সময় লাগেনি। এখন তেলের দর কমার পরও ভাড়াসহ বাড়তি দর কিন্তু কমার লক্ষণ নেই। মাতবোলও নেই। সেন্সর না হলেও এ সংক্রান্ত সংবাদে একটা খরার ভাব। এর মাঝেই রাজধানীতে শিক্ষার্থীদের বাস ভাড়া হাফ করার দাবি সংক্রান্ত খবরে একটি সাইড আইটেম যোগ হয়েছে।
হাফ ভাড়া দিতে চাওয়ায় এক কলেজ ছাত্রীকে ধর্ষণ করেনি, ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। এর প্রতিবাদে এবং সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবিতে রাজধানীতে শিক্ষার্থীরা শো-ডাউন করেছে। সামা?জিক যোগাযোগমাধ্যমে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রী অভিযোগ করেছেন, হাফ ভাড়া দেয়ায় বাসের চালক ও হেলপার প্রকাশ্যে ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে। ওই ছাত্রী কলেজে আসতে শনির আখড়া থেকে ঠিকানা পরিবহনের বাসে উঠেন। সেখান থেকে কলেজের ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু তার কাছ থেকে ১৫ টাকা ভাড়া রাখা হলে তিনি নিজেকে স্টুডেন্ট বলে ১০ টাকা ফেরত চাইলে হেলপার ধর্ষণের হুমকিসহ নিম্ন ভাষায় কথা বলে। এরই মধ্যে ড্রাইভার-হেলপারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের কি বিচার হবে?- তা এখনো প্রশ্নের চক্করে।
তারা ধর্ষণ করেনি। ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে মাত্র। এমনিতেই ধর্ষণ এখন অনেকটা ঝুঁকিমুক্ত অপরাধ। তার ওপর ধর্ষণ নিয়ে বিচারক বেগম কামরুন্নাহারের একটি রায় ও কিছু নির্দেশনা টক অব দ্য কান্ট্রিতে রূপ নিয়েছে। ছি-ছি করছে মানুষ। এর জেরে কামরুন্নাহারের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়ে তিনি ভিন্নমানের ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। বিশেষ করে তার ৭২ ঘণ্টার পর ধর্ষণ মামলা না নেয়ার নির্দেশনাটির পর্যালোচনা-সমালোচনা কতদিন যে চলবে, কারো পক্ষে বলা কঠিন। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী। স্পিকারও নারী। বিচারক কামরুন্নাহারও নারী। রাষ্ট্র এবং রাজনীতির এমন নারীময়তায় ধর্ষণ নিয়ে কিছু লেখা বা বলাও অরুচিকর। এরপরও ঘুরে-ফিরে ক’দিন পরপরই ধর্ষণ গরম ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে। তার ওপর ডিজেল-কেরোসিনের ইস্যুর মধ্যেও ঢুকে পড়েছে ধর্ষণ চেষ্টা ইস্যু। যার জেরে মূল ইস্যু ঢাকা পড়তে আর কিছু লাগে না। শিক্ষার্থীরা ছিল হাফ ভাড়ার আন্দোলনে। ঘটনার পরম্পরায় তা চলে গেছে সতীর্থকে ধর্ষণের হুমকির বিচারের দাবিতে।
এর আগে তেলের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে পরিবহন ধর্মঘট-জনদুর্ভোগসহ কী যাতনাই না গেছে। কত কথাই না শোনানো হয়েছে। ভারতে পাচার হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে, বিপিসির লোকসানের হিসাব দিয়েছে বলে দেশে তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে- এমন কত কথামালা! সরকার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের মূল্য লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ৩ নভেম্বর বুধবার রাতে। পরদিন বৃহস্পতিবার ধর্মঘট বাস মালিক-শ্রমিকদের। ৫ নভেম্বর শুক্রবার থেকে ধর্মঘট কার্যকর। লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থী পরীক্ষাকেন্দ্রে কীভাবে পৌঁছবেন, তা দেখার জন্য একটি দেশে প্রশাসন বা সরকার আছে, তা বোঝা গেল না। আরো হৃদয়বিদারক বিষয় হিসেবে সংবাদটি সামনে এলো যে, শুক্র-শনিবার ছুটি থাকায় বাস মালিকদের সঙ্গে ধর্মঘট নিয়ে আলোচনা রবিবারের আগে হবে না। অর্থাৎ কমপক্ষে শুক্র-শনি দুদিন ধর্মঘট চলবে। শুক্র-শনিবার ছুটি, রাতও তো ছুটিরই অংশ। এর বিপরীতে কথার চাতুরি। মালিক-শ্রমিকরা কোনো ধর্মঘট ডাকেনি, বাস-ট্রাক, লঞ্চ এমনিতেই বন্ধ আছে জানিয়ে দিলেন পরিবহন সেক্টরের প্রতাপশালী নেতা শাজাহান খান। সরকারের দিক থেকে বাণীর মতো বলা হতে থাকে তেলের দাম বাড়েনি, সমন্বয় হয়েছে। বাসের শ্রমিকরাও বলতে থাকে ভাড়া বাড়েনি, সমন্বয় হয়েছে। কাঁচা মরিচ ধনে পাতা থেকে বাজারের নিত্যপণ্য বিক্রেতারাও কি কম জানে। বাড়তি দামকে তারাও ‘সমন্বয়’ নামে দাবি করতে থাকে।
দুই হলিডের পর ৭ নভেম্বর সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার মালিকদের চাওয়া অনুযায়ী ভাড়া বাড়িয়ে দিল সরকার। কিছুক্ষণের মধ্যে ম্যাজিকের মতো জারি হয়ে গেল সরকারি প্রজ্ঞাপন। সব সমস্যার সমাধান! ২৩ শতাংশ তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে ৪০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে দিল সরকার। আর আদায় হতে থাকে ৫০-৬০ শতাংশ বেশি। অথচ ঢাকার প্রায় ৯৫ শতাংশ গণপরিবহনের জ্বালানি গ্যাস, ডিজেল নয়। দূরপাল্লার ট্রাকেরও একটা অংশ চলে গ্যাসে। কেবল আন্তর্জাতিক বাজার নয়, কোনো কিছুর দাম বাড়ানো বা জনগণের পকেট কাটতে স্থানীয় বাজার, রোদ, বৃষ্টি, ঈদ, পূজাসহ এন্তার অজুহাত এ দেশে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বাড়া-কমা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এ বছরের অক্টোবর মাসে এক ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৮৩.৫৪ ডলার। সরকারের ঘোষিত নীতি দাম বাড়ানো বা কমানো নয়, সমন্বয় করা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশে দাম বাড়ানো হবে, কমলে দেশেও কমানো হবে। কিন্তু, বাস্তবটা বড় নির্মম। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে এক ব্যারেল তেলের গড় মূল্য ছিল ৪৩.২৯ ডলার। সে বছর তেলের সর্বনিম্ন মূল্য ২৬.১৯ ডলারও হয়েছিল। ২০১৭ সালে গড় মূল্য ছিল ৫০.৮০ ডলার, ২০১৮ সালে ছিল ৬৫.২৩ ডলার, ২০১৯ সালে ছিল ৫৫.৯৯ ডলার এবং ২০২০ সালে ছিল ৩৯.৬৮ ডলার। ২০২০ সালে একপর্যায়ে এক ব্যারেল তেলের দাম কমে সর্বনিম্ন ১১ ডলার হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশে দাম সমন্বয়ের নীতি অনুসরণ করলে, দেশে তেলের দাম আরো অনেক কমার কথা ছিল। ঘোষিত নীতি অনুযায়ী দাম না কমিয়ে, বলা হচ্ছে বাড়ানো হয়নি, সমন্বয় হয়েছে। এখন যে ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের দর ৮০ ডলারের নিচে নেমেছে, সমন্বয় হবে না? ভাড়া কমানো হবে না? নানান ঘটনা ও ইস্যুর মাঝে এ নিয়ে জোরালো প্রশ্নেরও কেউ নেই। ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে এক ব্যারেল তেলের দাম ৮৩.৫৪ ডলার হওয়ায় বিপিসি প্রতি লিটারে লোকসান দেখিয়েছে ১৩.০১ টাকা। ২০২০ সালে এক ব্যারেল তেলের দাম যখন ৩৯.৬৮ ডলার ও সর্বনিম্ন ১১ ডলারে নামে তখন বিপিসি প্রতি লিটারে কত টাকা লাভ করেছিল? সেই হিসাব কেউ দাবি করেছেন? অথবা জ্বালানি মন্ত্রণালয় তা প্রকাশ করেছে?
২০১৪ সাল থেকে গত ৭ বছরে বিপিসি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর বাইরে প্রতি লিটার অপরিশোধিত তেলে ২৮ শতাংশ ট্যাক্স-ভ্যাট পায় সরকার। ২৮ শতাংশ ট্যাক্স-ভ্যাট মানে লিটার প্রতি ১৯ টাকা পায় সরকার। বিপিসির লাভের বাইরে ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ প্রতি বছর সরকার পায় ৯-১০ হাজার কোটি টাকা। তেল বিক্রি করে সাত বছর ধরে লাভ করে মাত্র দুই মাস মূল্যবৃদ্ধি সহ্য করতে পারল না সরকার। সেখানে সমন্বয়ের প্রশ্ন আসছে না। তেলের দাম, পরিবহন ভাড়াসহ যাবতীয় ঘটনা ধর্ষণের হুমকিতে সমন্বয় হয়ে গেলে তো আর কথাই নেই। সরকার পাবে বাড়তি ট্যাক্স, পরিবহন মালিকরা পাবে বাড়তি ভাড়া। তা আদায় করতে গিয়ে শ্রমিকরা ঘাম ঝরায়। মোটা দাগে তারা হাসি-খুশিতেই। মাঝে ধইঞ্চার দশায় সাধারণ মানুষ। তাদের দায়িত্বই যেন সব সহ্য করা। পাচার, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ, সিন্ডিকেট করে জিনিসের দাম বাড়ানো, মেগা প্রকল্পের নামে জনগণের ওপর ব্যয়ের বোঝা চাপানোর ক্ষমতার ধারেকাছেও নেই তারা।
মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়