গুলশানের ইউনিমার্ট ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে

আগের সংবাদ

ধাক্কা কাটিয়ে চাঙ্গা অর্থনীতি

পরের সংবাদ

কাচবিষয়ক আঁচ

প্রকাশিত: নভেম্বর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সপ্ত দশকের এই জীবনে তপ্ত কাচ কারখানার ভেতরে গিয়ে দেখার সুযোগ হয়েছিল একবার। টিকাটুলি-হাটখোলার কাছে হরদেও গøাস ফ্যাক্টরি। অনেকে হয়তো জানেন, আমিও জানতাম, তবে ভুলে গেছি। ‘হরদেও’ নামটি কার, ওই গøাস ফ্যাক্টরির উদ্যোক্তা কে ইত্যাদি ইতিহাস অজানা আমার কাছে। কিন্তু একটি দৃশ্য মনে আছে। সেটি মজুরের। এক ধরনের লাঠি দিয়ে আগুনের গোলা ঘুরাতে ঘুরাতে কেমন করে হারিকেনের চিমনি তৈরি হচ্ছে ওই মজুরদের টপটপ ঝরা ঘামে, সে কথা ভাবলে টপটপ অশ্রæ ঝরে আজো। সেই হরদেও গøাস আগের জায়গায় আর নেই। কোথাও আছে কি? দেশভাগের ভঙ্গুরতায় তা কি হারিয়ে গেল, কিছুই জানি না।
১৯৬৫ সালের দিকে জহির রায়হান নামের একজন উদীয়মান বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক ‘কাচের দেয়াল’ নামের একটি সিনেমা বানিয়ে মাত করে দিলেন। না, আমজনতার হিট ছবি নয়। আম নয় খাস জনতার। সেই সিনেমাটি সে বছর সে সময়কার সমগ্র পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ ছবি, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ইত্যাদি মিলিয়ে একেবারে দুহাতে ভরপুর পদকে পদক এক উচ্চমান আসনে উন্নীত করে দিল জহির রায়হানকে। পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে তখন হরদেও গøাসের অগণিত গনগনে আগুনের গোলা। ৬ দফার চিমনি। ১১ দফার চিমনি। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার চিমনি। এদিকে কাচের দেয়াল ভেঙে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ। স্টপ জেনোসাইড নামের এক ডকুমেন্টারি নির্মাণে পৃথিবী মাত করে দিলেন জহির। ১৯৬৯-৭০-এ তিনিই ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের মুখবন্ধ চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন।
বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশে জহির রায়হান এসে তার জীবনের বিশালতম আঘাতের মুখোমুখি হলেন। প্রাণের চেয়ে প্রিয় বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রাণ বধ করেছে আলবদর নামের হিংস্র বর্বর। অগ্রজকে খুঁজতে অধীর অস্থির হয়ে গেলেন জহির, মিরপুরে শহীদুল্লাহ কায়সারকে পাওয়া যাবে জেনে জীবনে শেষ বারের মতো মিরপুরে গেলেন, তারপর থেকে নিখোঁজ আজো।
কাচের দেয়াল সিনেমাটিতে ‘ভাগিনেয়ী’ সুমিতাকে নিয়ে একটি অসাধারণ গান গেয়েছিলেন মামা ‘আনিস’ তথা খান আতাউর রহমান। কী দারুণ কণ্ঠ। কী চমৎকার কণ্ঠ। ‘তোমরা তারে দেখেছো, গল্প করে জেনেছো, শুধু তার নামটি জানো না’। ‘জীবন থেকে নেয়া’তেও স্বৈরশাহী নিপীড়িতের চরিত্রে খান আতাউর রহমানের অভিনয় অনবদ্য। জহির-খান আতা জুটির প্রতিভার ঝলকে বাংলা চলচ্চিত্র ঝলকিত। কেন যেন মুক্তিযুদ্ধের বছরেই জহির-খান আতার বন্ধুতা কাচের দেয়ালের ভঙ্গুরতায় পর্যবসিত হলো। অনেকে ভাইয়ের জন্য উন্মাদ জহিরকে ফাঁদে ফেলে হত্যার চক্রান্তটি ওই ভঙ্গুরতার সঙ্গে যুক্ত করে থাকেন। তদুপরি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতিসত্তার মূল নায়কের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দিন সদ্য রেডিও বাংলাদেশে পর্যবসিত বাংলাদেশ বেতারের অঙ্গনে শিকারি হার্মাদ বাহিনীর সঙ্গে উল্লসিত খান আতা আর আপেল মাহমুদকে দেখে চোখ কপালে তুলেছিল। ‘একটি মুখের হাসির জন্য’ লড়েছিল আপেল কণ্ঠ। কী দারুণ কাচের ভাঙাচোরা দেয়ালে সে হাসি টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
পৃথিবীতে মানবজাতির যাপিত জীবনে ‘কাচের ঘরে ঢিল মারবেন না’ নামক একটি প্রবচন বাক্য গড়ে উঠেছে। বিশেষত রাজনীতির অঙ্গনে কথাটি ব্যবহৃত হয়। ‘কাচের স্বর্গ’ কথাটিও প্রচলিত। উপন্যাসের শিরোনামও হয়েছে তা।
আমাদের সিনেমায় ভিলেনকে পরাস্ত করার জন্য দুর্দান্ত সাহসী নায়করা কতবার যে কাচের দেয়াল ভেঙে মহাবিপন্ন নায়িকা, মা, ভাবিকে উদ্ধার করে দিচ্ছে, তা প্রতিদিন টেলিভিশন পর্দায় দেখা মেলে।
বিশদ প্রাথমিক বিবরণ দিলাম। এবার আজকের মোদ্দাকথায় আসি। সম্প্রতি এক দারুণ মহাডিজিটাল প্রকল্প মাথা খারাপ করে দিয়েছে। আমাদের মিরপুরে শহীদ হয়েছে অগণিত বাঙালি। মিরপুরে আছে বিপুল বধ্যভূমি। মিরপুরে আছে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। আমাদের মিরপুরের শেরে বাংলা ক্রিকেট ভেনু এখন পৃথিবীতে চেনা। আমাদের মিরপুরে আছে মানবজাতির বিনোদনের একটি বড়সড় চিড়িয়াখানা। সেই চিড়িয়াখানার নবপ্রকল্পের গল্পই আজকের মূল ‘কাহানী’।
দুঃখ, বেঁচে থাকব না, থাকলেও চলার শক্তি থাকবে না। কিন্তু শুনেই যে সুখ পেলাম তা বলার মতো নয়। পৃথিবীর বর্তমান লেটেস্ট প্রকল্পের এক প্রস্তাবনা এসেছে বাংলাদেশে। ইতালির এক কোম্পানি সম্ভবত সিঙ্গাপুরের এক কোম্পানির সঙ্গে মিতালি করে এক আশ্চর্য শিঙ্গায় ফুঁ দিয়েছে। আমাদের সরকারি সংশ্লিষ্ট বিভাগ আনন্দে ধেই ধেই। মিরপুর চিড়িয়াখানায় আর মানুষ এবং প্রাণীর মাঝে লোহার গারদের দেয়াল থাকবে না। বরং থাকবে এমন এক অত্যাশ্চর্য মিহি ডিজিটাল কাচের দেয়াল। মানুষ আর বাঘের দৃশ্যত কোনো ভেদ থাকবে না। বন্যপ্রাণীরা তাদের পরিবেশে খাবে, দাবে, ঘুরবে, লাফাবে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাকৃতিক কার্যাবলি সম্পাদন করবে। বিঘিœত হবে না নিরাপত্তা।
এমন অসাধারণ অপরূপ চিড়িয়াখানা হতে বছর ১৫ লেগে যেতে পারে। দেখতে পারি আর না পারি, পৃথিবীর সেরা একটা কিছু তো হবেই।
এমন চমকের সঙ্গে আরেকটা চমক খবরেও প্রকৃত অর্থেই চমকিত হলাম। এক শক্তিমানব, দুর্নীতি দানব হাজার এক কোটি টাকা বিদেশে পাচারের দায়ে অভিযুক্ত। আমাদের তদন্ত-ধকধক-চকচক দুদক এই অর্থ পাচারের আচার-টকটক মামলা নিয়ে ব্যস্ত। মামলা চলার সময় জানা গেল ওই আমজাদ লুট-হারামজাদ (হারাম থেকে জাত) হঠাৎ হাওয়া। এখন কি ওই ডিজিটাল কাচের দেয়াল তৈরি হয়ে গেল যে টাকা উধাও ও মানব উধাওয়ের যুগপথ কাণ্ড চলে। টাকারে তুই কোথায় গেলি! আমজাদরে তুই কই গেলি!
এরকম মহাডিজিটাল মানব আর টংক উধাও কাণ্ড এদেশে অনেককাল ধরেই চলছে। এখন টাকা বেশি, উধাওও বেশি। এনালগ বেশি ছিল। এখন মহাডিজিটাল বেশি। মানবও উধাও বেশি। তবে উধাও হয়ে যায় কোথায়?
বেগমপাড়া, সেকেন্ড হোম। জেনেভা, জুরিখ, মালয়েশিয়া, দুবাই, সিঙ্গাপুর আরো কত প্রান্তর। আমাদের দুই নম্বরী টংক দিয়ে আমরা ‘এক নম্বরী দুর্নীতিবাজ’ আর আমাদের দুই নম্বরী টাকা লুকিয়ে রেখে নিরাপত্তা দিয়ে ওই সব দেশ ‘এক নম্বর’ সৎ আমাদের সুলতানা কামালের আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সূচক’ নামক এক সূচগ্র পন্থায় এই সব সনদ তৈরি করেন। আমরা ছ্যাঁ ছ্যাঁ দেশের লোক। ওরা ওহ্ ওহ্!
অতএব হিসাব করুন। কাচ বিষয়ক কাণ্ডগুলো আঁচ করুন। মানবাধিকারের বিভঙ্গ দেখুন।

হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়