যে কারণে টিকায় ব্যয়ের হিসাব দিতে নারাজ মন্ত্রী

আগের সংবাদ

কঠিন বার্তা দিল আওয়ামী লীগ : বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপস নয় > শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ অপরিহার্য নয় > শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের জন্য অশনি সংকেত

পরের সংবাদ

এ জি স্টকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশিত: নভেম্বর ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ২০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

একদিনও অসুস্থ হননি, ধর্মঘটের দিনও অনুপস্থিত থাকেননি ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক এ্যানি জেরাল্ডিন স্টক। তাকে নিয়ে তার ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীরা কমই লিখেছেন। চল্লিশের দশকের শেষ দিককার ছাত্র জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী তাকে স্মরণ করেছেন- ‘দেশ বিভাগের অল্প কিছুদিন পূর্বে এসে যোগ দিয়েছেন এ জি স্টক, মধ্য চল্লিশ বয়সি, মধ্যম উচ্চতার ও হালকা গড়নের মহিলা, মুখে এক মাতৃসুলভ হাসি, পোশাকে একটু বেখেয়ালি ভাব- সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা জিপসী জিপসী ভাব। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ডক্টর এম এন রায় এর জায়গায় এসেছেন।’
১৯৫২ সালে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যখন ইংরেজি অনার্সের ছাত্র হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলেন তখন বিভাগের প্রধান এ জি স্টক; তিনি ১৯৪৭-এ যোগ দিয়েছেন, ‘তবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের আগেই চলে গেছেন, তার চিঠিপত্র গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা খুলে পড়তে শুরু করেছে এটা টের পেয়ে, তার সহানুভূতি ছিল সরকারবিরোধী ছাত্রদের প্রতি।’ তিনি ঢাকা ছেড়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেও বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে, ভাইবার পরীক্ষক হিসেবে আরো একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন।
প্রফেসর চৌধুরী লিখেছেন, তিনি আবারো শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের আমন্ত্রণে এবং নিজের আগ্রহে। চুয়াত্তরের শেষে চলে গেছেন। ‘সাতচল্লিশ থেকে একান্ন পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে বসবাসের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা নিয়ে অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক ও হৃদয়গ্রাহী একটি বই লিখেছেন প্রফেসর স্টক। তিনি যে বইটির কথা বলেছেন তা এ জি স্টকের মেমোয়ার্স অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি ১৯৪৭-১৯৫১, ঢাকার বেঙ্গল লাইট বুকস ২০১৭ সালে ১৯৭৩-এ প্রকাশিত বইটির পুনর্মুদ্রণ করেছে, অধ্যাপক কায়সার হক বইটির সঙ্গে একটি ভূমিকা সংযোজন করেছেন; প্রকাশনা সম্পাদক খাদেমুল ইসলামও বইটি কেন গুরুত্বপূর্ণ ও পুনর্মুদ্রিত হওয়ার দাবিদার তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিস্মৃত হওয়ার আগে মোবাশ্বেরা বেগমের অনুবাদে ঢাকা ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি ১৯৪৭-১৯৫১’ ২০০১ সালে সুবর্ণ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯২১ থেকে এ পর্যন্ত শত বছরে যেসব বিদেশি শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেবা দিয়েছেন তাদের মধ্যে একমাত্র এ জি স্টকই বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পূর্ববাংলা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই রচনা করেছেন।
ভূমিকাতেই উল্লেখ করেছেন তার দুই প্রিয় ছাত্রের কথা- একাত্তরে জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতাকে তার ছাত্রদের সামনে হত্যা করা হয়েছে, প্রাণবন্ত মুনীর চৌধুরী পরিত্যক্ত ইটভাটায় লাশের সংখ্যা একটি বৃদ্ধি করেছেন। দ্বিতীয় বার স্বাধীনতার পর যখন এলেন দেখলেন ছাত্ররা তেমন বদলায়নি।
১৯৪৭-এর প্রথম দিকে টাইমস এডুকেশনাল সাপ্লিমেন্টে দুটি বিজ্ঞাপন তার চোখে পড়ে-উগান্ডার ম্যাকারের বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজির লেকচারার চাচ্ছে আর পূর্ব বাংলার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চাচ্ছে প্রফেসর। অক্সফোর্ড থেকে পাস করলেও পরবর্তী কুড়ি বছর এমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কিছু করেননি, যা দেখিয়ে প্রফেসরের পদটি দাবি করতে পারেন- কাজেই এটা ছিল দুঃসাহসী চাওয়া। ও দিকে ওগান্ডার বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ইন্টারভিউতে ঢাকার প্রয়োজনই বোধ করেনি।
এমন অবস্থায় ভারতবর্ষের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের পাঠানো নিয়োগপত্র তাকে তো বিস্মিত করার কথাই- সঙ্গে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারা উপাচার্য মাহমুদ হাসানের একটি চিঠি- শিগগির টিকেট কেটে ফেলো এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এসো।
মাহমুদ হাসান যখন অক্সফোর্ড পিএইচডি করছিলেন তিনি তখন অনার্স ক্লাসে; তখনকার রবিবাসরীয় সান্ধ্য বৈঠকগুলো তিনিই ছিলেন ভারত নিয়ে আগ্রহী একমাত্র ইউরোপীয় নারী। তিনি বক্তাদের এ প্রশ্ন সে প্রশ্ন জিগ্যেসও করতেন। সে সময় তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়েছে বলে মনে করার কারণ নেই। তবে তার ভারত নিয়ে আগ্রহ অনেকেরই জানার কথা। স্মরণ করা দরকার সময়টা এমন যে ইউরোপীয়রা বিশেষ করে ব্রিটিশরা তখন তড়িঘড়ি করে বোচকা বেঁধে বাড়ি ফিরছে- অনিশ্চিত ভারতবর্ষে আর একদিনও নয়। এমন সময় উল্টো যাত্রা করলেন তিনি, টিকেট কিনলেন, জুলাই মাসে লিভারপুল বন্দর থেকে ফ্রাঙ্কোনিয়া নামের জাহাজটিতে তিনি রওনা হলেন। বোম্বে নেমে তিন দিনের ট্রেনযাত্রায় কলকাতা; সেখান থেকে স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ। তারপর উপাচার্যের বাড়িতে ফোন এবং সেখানেই চলে আসার আমন্ত্রণ।
মিসেস হাসান তার জন্য ঠিক করে রেখেছেন ইংরেজের বাড়িতে কাজ করা এক বেয়ারা-বাবুর্চি, আর প্রফেসর হাসান বিলেত প্রত্যাবর্তনোমুখ এক ইংরেজের কাছ থেকে কিনে রেখেছেন। মিস স্টকের প্রয়োজন হতে পারে এমন সব তৈজসপত্র, কাঁটাচামচ ও অন্যান্য কাটলারিজ। ইংরেজি বিভাগের রিডার ড. গাঙ্গুলি সম্ভবত আর না ফেরার জন্যই ছুটিতে যাচ্ছেন এবং বিভাগের দায়িত্ব তাকে বুঝিয়ে দিলেন। রান্নাঘর ছাড়াও আরো তিনটি কক্ষের একটি বাড়িতে উঠলেন। পানির সরবরাহ নেই। আবদুল হক বালতি ভরে পানি আনেন। রাতে শোনেন শেয়ালের কান ফাটানো অর্কেস্ট্রা, মশারির ভেতর গেলে সঙ্গে যোগ হয় মশার গুঞ্জন। বেয়ারা-বাবুর্চি আবদুল হক তার পদমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন। হাইকোর্টের এক জজের বাড়িতে তিনিই ছিলেন একমাত্র পাচক, খানসামা ও গৃহরক্ষক; আরেক ইংরেজ ম্যানেজারের বাড়িতে ১৭ কর্মচারীর তিনিই ছিলেন প্রধান। দ্বিতীয় প্রধান অবলম্বন কালিপদ ইংরেজি বিভাগের চাপরাশি, ইংরেজি বলতে না পারলেও সমস্যা নেই, বললে পুরোটাই বুঝতে পারেন। ডিপার্টমেন্টের কাজও ভালো জানেন, চোখ কান খোলা, তার বর্ণনায় আতিশয্য বেশি, তবে অনেক খবর রাখেন।
১৯৪৭-এর ঈদুল ফিতরের ১০ দিন আগে, আগস্টে তিনি পৌঁছলেন ঢাকায়, আবদুল হক ঈদের ছুটি নিলেও জাফরান মেশানো চালের সঙ্গে মাংসের মিশেলে তৈরি বিশেষ খাবার, মিষ্টি, ফল নিয়ে ঈদ মোবারক বলতে সকন্যা চলে এলেন। পাঁচজন বাঙালি বিশিষ্ট মুসলমান এসে দেখা করে তাকে আশ্বস্ত করছেন যে তারা তাকে স্বাগত জানিয়েছেন; তাকে ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান করা মুসলমান স্বার্থের পরিপন্থি হয়নি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হতে যাচ্ছে এমন বিপ্লবী ধারার এক ছাত্রের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলেন, সে প্রতিবাদী কিন্তু মুনীরের (চৌধুরী) মতো মার্ক্সিস্ট নন, কোনো দলের সমর্থকও নন।
তিনি কবি জসীমউদ্দীনের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং বুঝতে পারলেন, আধুনিক শিক্ষা তাকে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ছাত্ররা অধিক সংখ্যায় তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তাদের আলোচনার তিনটি সাধারণ ভাগ রাজনৈতিক, আত্মিক এবং জীবিকা। তার ছাত্র শামসুল হুদা তাকে নিয়ে ইসলামিক জাতীয়তাবোধ কবিতা অনুবাদের পরিকল্পনা করছেন। তার কিছু কাজ খান সারওয়ার মুরশিদের নিউ অ্যালুজ এ প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি পরীক্ষার খাতা দেখা নিয়ে কয়েকটি বিড়ম্বনার কথা বলেছেন : এম এ ক্লাসের এক সেট খাতা নিয়ে পরীক্ষকের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রদূত হয়ে চীন চলে গেলেন, খাতার আর হদিস মিলল না; অনেক পরে তার পুরনো ড্রয়ার থেকেই খাতাগুলো উদ্ধার হয়। খাতা তখনো দেখা হয়নি, রাষ্ট্রদূত হতে পেরে সম্ভবত ভুলেই গিয়েছিলেন। আর একজন শিক্ষক পার্কে গাছের নিচে বসে আয়েশ করে পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন- একটি গরু এসে পুরো খাতা খেয়ে ফেলল। তিনি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে গিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনো ছাপাখানা না থাকায় পরীক্ষার প্রশ্ন ছাপা ঝুঁকিবহুল হয়ে পড়ল। ঢাকার কোনো ছাপাখানায় কাজটা দিলে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার এবং তা নিয়ে বাণিজ্য করার সম্ভাবনা থাকবে। চল্লিশের দশকের শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই ছিলেন একমাত্র বিভাগীয় প্রধান, যিনি টাইপ করতে এবং একই সঙ্গে সাইক্লোস্টলের জন্য স্টেনসিল কাটতে পারতেন। সুতরাং ভ্যাকেশন তার ইউরোপীয় সহকর্মী যখন সস্ত্রীক দার্জিলিং যাচ্ছেন তিনি ঘামে ভিজে চুবচুব হয়ে প্রশ্ন টাইপ করছেন, স্টেনসিল কাটছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্ষণশীল পাণ্ডিত্যের ফসল- উচ্চ মাধ্যমিকের প্রশ্নপত্র দেখলে মনে হতো পরীক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া সশস্ত্র সৈন্যের ব্রিগেড। এই প্রশ্নে শতকরা ৪০ পেয়ে পাস করতে সক্ষম অল্প ক’জন, আবার পর্যাপ্তসখ্যক পাস না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক কোর্স ছাত্র না পেয়ে অচল হয়ে যাবে- সুতরাং পাসের কাছাকাছি যারা এসেছে গ্রেস দিয়ে তাদের পরীক্ষার দেয়ালটা টপকে দিতে হতো।
পরীক্ষায় নকল তখনো ছিল। নকল ধরা ছিল ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। কলেজ ফাইনাল পরীক্ষায় পরিদর্শকরা বেশির ভাগই স্থানীয় পরিদর্শক। তারা কখনো রাতের আঁধারে কখনো প্রকাশ্যেই আক্রান্ত হতেন। এমনকি ছুরিকাহত হওয়ার কথাও এ জি স্টকের জানা।
তিনি শিক্ষাঙ্গনে দাঙ্গার ক্ষতিটা তুলে ধরলেন। দেশান্তরের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আঘাতটাই ছিল অনেক বড়। ইংরেজি বিভাগে ৯ জন শিক্ষকের একজন মাত্র মুসলমান, বাকিদের চারজনই ক্রিশমাসের মধ্যে স্থায়ীভাবে সীমান্ত পাড়ি দিলেন অন্য একজন পরের বছরের শুরুতে। ১৯৪৮ সালে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষকদের একটি ধর্মীয় মিশ্রণ লক্ষণীয়। ভারতে যেতে ইচ্ছুক নন এমন চারজন হিন্দু, তিনজন মুসলমান, একজন ভারতীয় ক্যাথলিক এবং ইউরোপীয় এ জি স্টক। নারী শিক্ষার্থীদের হোস্টেল তত্ত্বাবধায়ক ইংরেজির প্রভাষক (চারুপমা বসু) কিছু দিন চুপচাপ থাকলেও এক সময় চলে গেলেন কিংবা তাকে যেতে হলো।
তিনি যে সময় এলেন, তখন বাংলার স্নায়ুকেন্দ্র কলকাতা। তিনি লিখেছেন : ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কলকাতার রাতের জীবনের কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলত আর উচ্চাকাক্সক্ষী শিল্পী কবিরা এর চৌম্বক শক্তির জোরে ছুটে যেত যেমন যেত ইংল্যান্ডের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সবাই লন্ডনের দিকে। কেউ জানত না দেশভাগ কেমন ব্যাপার হবে। এটা যেন অনেকটা শরীরের কর্তিত একটি অংশকে তার স্বাধীনতা উপভোগ করতে বলার মতো।’
প্রতিদিনের নতুন নতুন দাবি- বড় বড় পদ যদি মুসলমান না পায় তাহলে পাকিস্তান কায়েম করে কী লাভ হলো- কিংবা ইসলামি রাষ্ট্রে এ কোন অবিচার বড় পদে হিন্দু কেন? তখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি হিন্দু। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবাই তাকে পছন্দ করত, কিন্তু ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বহিষ্কৃত হন। মাথার ওপর থেকে হিন্দু সরে যেতে বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু তারপর একজন তরুণ সহকর্মীর কাছে শুনলেন, পাঞ্জাবিদের চেয়ে হিন্দু শাসকরাই ভালো ছিল। যে সব হিন্দু রয়ে গেলেন দেশভাগ একটি ঘটে যাওয়া বাস্তবতা বলে মেনে নিলেন কিন্তু হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই মনে করতেন দেশের বিভাজন ও ফাটল যেমন সত্য ও মেরামতের অযোগ্য হিন্দু মুসলমান সম্পর্কও ঠিক একই রকম, এই চিত্র এ জি স্টকের।
১৯৪৮-এর ভাষা আন্দোলনের চিত্রটি এ জি স্টকের ডায়েরিতে সজীব। আন্দোলনকারীদের দাবিটাও যৌক্তিক। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের আরেকটি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাক। ১১ মার্চ মঙ্গলবার ধর্মঘট ডাকা হয়েছে। খাজা নাজিমউদ্দিনের সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, গোলযোগের আশঙ্কা। ধর্মঘট বেলা ১টায় প্রত্যাহার করা হলো। সেদিনের ২টা ২০ মিনেটে তার নির্ধারিত ক্লাসটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই জেনেও তিনি অফিসে গেলেন। কিছুক্ষণ কাজ করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে জনসভার বক্তৃতা শুনে আড়াইটায় ফিরে এলেন- একজন বলল পুলিশের আক্রমণে আহত ১৭ জন, তার খানসামা কালিপদ বলেছিল শতাধিক। কালিপদ একটু বাড়িয়েই বলে। মোবাশ্বেরা খানম অনূদিত সেদিনের ডায়েরির একাংশ উদ্ধৃত করছি :
‘তখন (আড়াইটায় বাসায় পৌঁছার পর) এলো মুরশিদ ও মুনীর, সকাল ১০টা থেকে বাইরে বাইরে ঘুরে তারা ভীষণ ক্ষুধার্ত। আমার বাসায় বিশেষ কিছু ছিল না খাবার মতো। অমলেট আর ভাঙা কিছু বিস্কুট দিয়ে ওদের আপ্যায়ন করালাম। মুনীর জানাল যে মিটিং শেষে জনতা মিছিল করে শহর ঘুরেছে। তারা আজ সকালে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের মুক্তি দাবি করেছে। সেই মিছিলে আবার আঘাত হানা হয়েছে। তারা দুজনই সেখানে ছিল। মুরশিদ বলল, এটা একেবারেই ইচ্ছাকৃত আক্রমণ, কোনোরকম উসকানি ছাড়াই। ছাত্ররা খুবই সুশৃঙ্খল ছিল এবং মোটেও আক্রমণাত্মক কোনো আচরণ তারা করেনি। পুলিশ তবুও তাদের আক্রমণ করেছে। বিখ্যাত রাজনীতিবিদ ফজলুল হকও এই মিছিলে ছিলেন। …মুরশিদ রাতে খাবার সময় ফিরে এলো। তিনজন ছাত্রের অবস্থা আশঙ্কাজনক। একজন, যে সবচাইতে সংকটাপন্ন অবস্থায়, তার পিঠে গুলি লেগেছে, অন্য দুজনের মাথায় বেয়নটের আঘাত।’
এ জি স্টক লিখেছেন, পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের ভাষা বাংলা হলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আশঙ্কা ছিল বাংলা ভাষাই হবে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়কে ‘এক করে তোলার কৃষ্টি ও সংস্কৃতির বাহক।’
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন বেশি প্রচারণা পাওয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ১৯৪৮-এর আন্দোলনটি অনেকটাই অনালোচিত থেকে গেছে। এই সময়কার ঘটনা প্রবাহের নৈর্ব্যক্তিক বিবরণের জন্য এ জি স্টকের বইটি অবশ্য পাঠ্য। এ জি স্টক দ্বিতীয় দফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে বিলেত ফিরে গেলেন এবং ১৯৭৫-এ মৃত্যুবরণ করলেন।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়