মানিলন্ডারিং মামলা : হাইকোর্টে জামিন পাননি এসপিসি ওয়ার্ল্ডের শারমিন

আগের সংবাদ

জাহাঙ্গীর আজীবন বহিষ্কার : আ.লীগের সভায় সিদ্ধান্ত, মেয়র পদ হারাতে পারেন জাহাঙ্গীর > খালেদার টার্গেট আমি : প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

হাসান আজিজুল হক’র আখ্যানভূমি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হাসান আজিজুল হকের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের যবগ্রামে। দেশভাগের পর ১৯৬৪ সালে তিনি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে চলে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর আবাল্যলালিত শৈশব-কৈশোর ও যৌবন শুরুর স্মৃতিকে। সেই স্মৃতিতে থাকে সেখানকার মানুষ, সময় ও সময়ের স্রোত। যেমন পশ্চিমবঙ্গের বহু সাহিত্যিকের জীবনে ঘটেছে যাঁরা দেশভাগের কারণে বয়ঃসন্ধিক্ষণে কিংবা যৌবনের শুরুতে অখণ্ডবঙ্গের স্মৃতি মাথায় নিয়ে এপারে চলে এসেছিলেন, বা বলাইবাহুল্য চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এ বঙ্গে তাঁদের নিরন্তর লড়াই ইতিহাসের পরিহাস হলেও তা নিদারুণ সত্য। জানি না, এ-বঙ্গ ছেড়ে ও-বঙ্গে গিয়ে হাসান আজিজুল হককে কীভাবে সেই সত্যের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কিন্তু হয়েছেন তো নিশ্চয়ই। আর হয়েছেন বলেই হাসান সেদিন ধরতে পেরেছিলেন, দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সদ্য গঠিত ওই দেশটিও আবার ভাঙনের মুখে। কেননা ভাষা-ধর্ম ও মনুষ্যত্বের ওপর চাপানো বোঝা, দেশভাগের পরপরই জন্ম নেয়া পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। জন্ম নিচ্ছে ক্ষোভ, বিক্ষোভ ও অসন্তোষ। আর এ অসন্তোষ ঘনিয়ে উঠছে, দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে অঙ্কুরিত হয়ে ওঠা শক্তিশালী নতুন যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও অক্ষরবদ্ধ রচনায়। হাসান যে তাঁদেরই সমগোত্রীয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
হাসানের লেখালিখির শুরু কুড়ি-একুশ বছর বয়সে, এবং তখনও তিনি এ বঙ্গের বাসিন্দা। আর মোটামুটি কুড়ি থেকে বত্রিশ বছর বয়সের মধ্যেই তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলি তিনি লিখে ফেলেছেন। এইসব গল্পের মধ্যে ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘শকুন’, ‘তৃষ্ণা’, ‘গুনিন’, ‘উটপাখি’, ‘আমৃত্যু আজীবন’, ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘খাঁচা’ ইত্যাদি অনেক গল্পের কথাই বলা যায়। এবং গোড়া থেকেই এসব গল্পে তিনি একটি নিজস্ব আখ্যানরীতি ও অনুরূপ ভাষা তুলে আনতে পেরেছিলেন যা তাঁর আখ্যানসূত্রকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। ফলে ওই তখন থেকেই বাংলা গল্পের ধারাবাহিকতায় তাঁর আখ্যান একটি নিজস্ব জগতের সন্ধান এনে দিয়েছে।
আমাদের যখন লেখালেখির শুরু, সেই সত্তরের দশকেই হাসান আজিজুল হকের কথা প্রথম শুনি প্রয়াত কথাকার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। তিনিই আমাকে হাসানের গল্প প্রথম পড়তে দিয়েছিলেন। কলকাতার প্রকাশক ‘ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল’-এর সুনীল চক্রবর্তী তখন হাসান আজিজুল হকের ‘নির্বাচিত গল্প’ ছাপছেন। শ্যামলদা তার ভূমিকা লিখছেন। ছোট্ট একটি ভূমিকা এবং তা বলতে গিয়ে শ্যামলদা তাঁর অভিজ্ঞতাকে যেভাবে ব্যক্ত করেছিলেন তার অংশবিশেষ তুলে ধরাটা বোধ হয় এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
দেশভাগ নিয়ে, ছিন্নমূল মানুষ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন এবং এখনো লিখছেন। কিন্তু এ বিষয়ে হাসানের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্বচ্ছ ও ভিন্ন রকম। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যারা ওপারে গিয়েছেন ও যারা ওপার থেকে এপারে এসেছেন, তাদের কথা হাসান তাঁর আখ্যানভাগে গভীরভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ বঙ্গ ছেড়ে হাসান যখন চলে গেলেন তার কিছুকাল পরেই পূর্ব পাকিস্তান ভাঙে। শুরু হয় গণবিক্ষোভের দশক। যার শুরুতেই থাকে ভাষার অগ্রাধিকার। বাংলা ভাষা। এবং যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভাঙনের সূচনা হয়েছিল সমাপ্তি ঘটে তা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ও ‘বাংলাদেশ’ নামে নতুন একটি রাষ্ট্রের উত্থানের মাধ্যমে। আর তারপরও যে সমস্যার সমাধান ঘটেছে বা বাঙালি জাতীয় জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তা নয়, বরং সমস্যা আরো নানাবিধ আকার ধারণ করেছে। এবং সেসব সমস্যাও সোচ্চার হয়ে উঠেছে হাসানের গল্পে।
আসলে হাসান আজিজুল হকের গল্পে আছে তিনটি পর্ব। এই পর্বগুলোকে বলা যায় প্রাক মুক্তিযুদ্ধ অর্থাৎ যখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামের বাসিন্দা। দ্বিতীয় পর্বটি তাঁর মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, যে সময়ে হাসান চলে গেছেন ও বঙ্গে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে এবং যেখান থেকে শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধপর্ব। আর শেষ পর্বটি তাঁর বর্তমান পর্ব বা উত্তরকাল পর্ব যে পর্বে এখন তিনি নতুন করে আবার তাঁর আখ্যানশৈলীর ঘুঁটি সাজাচ্ছেন।
‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’ হাসান আজিজুল হক-এর প্রথম গল্পগ্রন্থ। ১৯৬৪-তে বেরিয়েছিল। আর তারপরেই হাসান চলে যান বর্ধমান ছেড়ে পাকাপাকিভাবে। ফলে এই গ্রন্থের গল্পগুলো থেকে ‘জীবন ঘষে আগুন’ পর্যন্ত গল্পগুলোতে এসেছে রাঢ়বঙ্গের অনুষঙ্গ। অর্থাৎ ‘শকুন’ থেকে ‘জীবন ঘষে আগুন’ পর্যন্ত এই একুশ বাইশটি গল্পে। এরপর ‘নামহীন গোত্রহীন’ থেকেই তাঁর যাত্রা শুরু নতুন এক ভূমির খোঁজে। এ গল্প থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন সীমান্তপারের গল্পকার। যদিও সীমানা দিয়ে পরিমাপের বিষয়টি এখানে ধরা হচ্ছে না, কেননা এ উপমহাদেশের বাংলা ভাষাভাষী পাঠকেরই তিনি কথাকার তবুও উল্লেখ করা এ জন্য যে ওই সময় থেকেই তাঁর গল্পে এসেছে সীমান্তপারের নতুন এক ভূখণ্ড উত্থানের পদধ্বনি। সময় উঠে আসছিল নতুন এক বার্তা নিয়ে। যেমন ওই নামগল্পটি। ‘নামহীন গোত্রহীন’। বিষয়ে ও আবহে হাসান আজিজুল হক যে তাঁর আখ্যান বুনোটে পৃথক তা তিনি স্পষ্ট করে দেন তাঁর প্রথম দিকের গল্প থেকেই। তাঁর অভিজ্ঞতাকে তিনি আশ্রয় করেছিলেন মানুষের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পর্ক বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। ফলে লব্ধ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন তিনি তাঁর দর্শনের সঙ্গে সমান্তরাল করে।
দ্বিতীয় পর্বে হাসান আজিজুল হক-এর গল্পে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। ‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘রফি’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, ‘কেউ আসেনি’ ইত্যাদি আরও নানান গল্প। এসব গল্পে দেখি পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচার, নির্যাতন ও ধ্বংসলীলায় বিধ্বস্ত জীবন ও জনপদের চিত্র। এবং তার খুঁটিনাটি। ‘ভূষণের একদিন’ মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার ঠিক পরেরকার এক সময়। দিনমজুর ভূষণ বেড়া বাঁধার কাজ নিয়েছিল মলিক বাড়িতে। বন্দুক হাতে তিন যুবক কাজে লাগা ভূষণের কাছে এসে দাঁড়ায়। তাদের কাছেই ভূষণ জানতে পারে, পাকিস্তান আর থাকছে না। তাদের সঙ্গে বাঙালিদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। যথারীতি ভূষণ খুবই অবাক। কারণ যুদ্ধের কোনো সংবাদ সে জানে না। দিনমজুর সে। মজুরি পেয়ে বাড়ি গিয়ে দুটো ভাতডাল খেয়ে বেঁচে থাকতেই সে অভ্যস্ত। সারাক্ষণই জীবিকার সন্ধানে সে ঘুরছে। বিকেলে হাটে গিয়ে দেখে গাঁয়ের ছোটো খালপথে লঞ্চে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা নামছে। এবং সৈন্যরা অতর্কিতে হাটে আসা মানুষদের ওপরে গুলি ছুড়তে থাকে। তাদের বীভৎস হত্যাকাণ্ড লক্ষ করতে করতে এক সময় ভূষণের ছেলে হরিদাস ও ভূষণ নিহত হয়। গণহত্যার এমন বীভৎস চিত্র এখানে হাসান তুলে ধরেছেন তাঁর নির্মোহ দৃষ্টিতে।
কিংবা হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোস্তরা মিলে নয়মাসে সারা দেশে যে অসংখ্য কনসেনট্রেশান ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল এবং সেখানে যে কত নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নারকীয় নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে তাই বলা হয়েছে ‘রফি’ গল্পে। সৎ, পরিশ্রমী নেতা রফি কৃষকদের মাঝে কাজ করে। এই সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। পরে ধরা পড়ে ওই কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে কীভাবে তাকে হত্যা করা হয় তারই এক চিত্র এই গল্পতে। ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’ গল্পে হাসান লিখেছেন পাঁচ মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের কথা। অবরুদ্ধ এক গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা রহমান, জামিল, মতিয়ুর, শহীদ ও এরকম নামে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা একটি বিল অতিক্রম করছিল। এমন সময় তাদের চোখে পড়ে হানাদারদের আক্রমণে গাঁয়ের নিরীহ মানুষদের আর্তনাদ। তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। অথবা ‘কেউ আসেনি’ গল্পটির কথাই ধরা যাক। এখানে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা ও বঞ্চনার দিকটাই তুলে ধরা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা গফুর যুদ্ধ শেষে ভ্যানে করে হাসপাতালে এসেছে। কিন্তু হাসপাতালকর্মীরা মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনকে ঝামেলা বলেই মনে করছে। তা গফুর হাসপাতালে গিয়েই জানতে পারে তার সহযোদ্ধা আসফ আলির ক্ষতওয়ালা পা-টা কেটে বাদ দিতে হবে। আসফের শেষ খবরটা নিয়ে আসফের মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য গফুর অপেক্ষা করতে থাকে। এদিকে আসফের পা কাটার পর তার জ্ঞান ফিরে এলে সে তার কাটা পা-টা চায়। গ্রামে গিয়ে সে তার মাকে দেখাবে। কিন্তু এক সময় আসফ মারা যায়। গফুর গাঁয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুত হয়। এ গল্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি যে ঘৃণা ও অবজ্ঞার কথাই বলা হয়েছে।
হাসান আজিজুল হক-এর গল্প পড়তে গিয়ে পাঠক একটা জিনিস অবশ্যই আবিষ্কার করে বসবেন- সেটি তাঁর ভাষা। কেননা কী প্রাক-মুক্তিযুদ্ধ, কী মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তাঁর উত্তরকালের যে কোনো গল্পেই হাসান তাঁর এই ভাষায় তাঁর নিজস্ব জগতটি তৈরি করেছেন। এ ভাষা তাঁর গোড়াতেই তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন। ফলে রাঢ় অঞ্চল যখন তাঁর গল্পে এসেছে সেখানে যে মানবজীবনচর্চার ধারায় তিনি এক একটি গল্পের ভুবন নির্মাণ করেছেন তা এই ভাষায়ই। আবার এ বঙ্গ থেকে ফিরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পর্ব বা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অধ্যায়েও ওই ভাষা তাঁর নিজস্ব ভুবন গড়ায় সাহায্য করেছে। এ ভাষাই থেকে গেছে প্রতিটি গল্পেই নতুন শৈলীতে। এ ভাষা অনুকরণ করা যায় না। এটা অর্জন করতে হয়, যা হাসান আজিজুল হক অর্জন করতে পেরেছিলেন জীবনের শুরুতেই। ভাষা নিয়ে তাঁর দীর্ঘ লেখাও আছে। সেখানে তিনি চিন্তার ভাষা ও মানুষের মুখের ভাষার মধ্যে একটা তফাত খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু আখ্যান রচনা করতে গিয়ে আমি অনেক জায়গায়ই লক্ষ করেছি এই দুই ভাষাকে যেন তিনি কখনো কখনো কী অদ্ভুত রসায়নে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তখন আর তা মনে হয় না এ ভাষা কেবলই হাসান আজিজুল হকের আখ্যানের ভাষা। মনে হয় তাঁর চরিত্ররাই এ ভাষা নিজেরা তৈরি করে তা আখ্যানকারকে উপহার দিয়েছেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়