মানিলন্ডারিং মামলা : হাইকোর্টে জামিন পাননি এসপিসি ওয়ার্ল্ডের শারমিন

আগের সংবাদ

জাহাঙ্গীর আজীবন বহিষ্কার : আ.লীগের সভায় সিদ্ধান্ত, মেয়র পদ হারাতে পারেন জাহাঙ্গীর > খালেদার টার্গেট আমি : প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

শতাব্দীর শিল্পসারথি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১) একটি ইতিহাসের নাম। ব্রিটিশ-ভূভারতের ইতিহাস, উপমহাদেশের ইতিহাস, আমাদের পূর্ব প্রজন্মের ইতিহাস, আমাদের সময় ও সমাজের ইতিহাস। হাসান আজিজুল হক মানেই স্বজন হারানোর ইতিহাস, পরিবার-পরিজন হারানোর ইতিহাস, বসতবাড়ি হারানোর ইতিহাস, সহায়সম্পদ হারানোর ইতিহাস, নিঃস্ব হওয়ার ইতিহাস। হাসান আজিজুল হক নামটি স্মরণে আসলেই মনে পড়ে যায় ‘আগুনপাখি’র (২০০৬) কথা। মনে পড়ে যায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত-সংঘর্ষের কথা। মনে পড়ে যায় প্রথম স্বাধীনতার (১৯৪৭) কথা। যে স্বাধীনতা অসংখ্য মানুষকে হিন্দু-মুসলমানে পরিণত করেছিল, ভিটেবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছিল। যে স্বাধীনতা মানুষকে রিফিউজি বানিয়েছিল, ধর্মের নামে মানুষকে মাতাল করে দিয়েছিল। সুবিধাবাদী-স্বার্থপর ধান্দাবাজি রাজনীতিবিদেরা যার যার মতো সেদিন ঝপাঝপ ক্ষমতার আসনে বসে পড়েছিল। আর সাধারণ মানুষ নীড়হারা পাখির মতো শূন্যে ভেসেছিল। মানুষ তো আর পাখি নয়। মামৃত্তিকাকে স্মরণ করেই তাকে পথ চলতে হয়। এই চলতে চলতেই কোথাও তাকে ঠাঁই নিতে হয়, গড়ে তুলতে হয় বসতবাড়ি। জীবন-জীবিকার জন্য, অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাবার সংগ্রহ করতে হয়। এমনকি নবীন প্রজন্মের সতিত্বও বিলিয়ে দিতে হয়। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ এমনি একটি বেদনাময় উপাখ্যান। ভাবি, মাত্র সাত / আট পৃষ্ঠার মধ্যে কীভাবে তিনি এই ইতিহাসকে ধারণ করলেন। যে ইতিহাস সব হারানোর ইতিহাস, যে ইতিহাস বিষপানের ইতিহাস, যে ইতিহাস হুহু করে কান্নার ইতিহাস, যে ইতিহাস পানিতে ভেসে যাওয়ার ইতিহাস, যে ইতিহাসের শুরু আছে শেষ নেই, যে ইতিহাস বংশ পরম্পরায় তাদেরকে বহন করে যেতে হবে, সেই ইতিহাস হাসান আজিজুল হক ধারণ করতে চেয়েছেন। চেয়েছেন মানুষের ভেতরের জীবনযন্ত্রণাকে ভাষারূপ দিতে। তিনি নিজেও ঐ ইতিহাসেরই অংশ ছিলেন। এই জীবন ও জনপদের প্রতিনিধি হিসেবে সহস্র মানুষের বুকফাটা কান্না ধারণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কেবল এই একটি গল্পটি নয়, হাসান আজিজুল হকের গল্পের পুরোভাগ জুড়ে থাকে মানবিক চিন্তাচেতনা। ‘শকুন’ শিরোনামের প্রথম গল্প থেকেই ঐ মানবিক ভাবনা দৃশ্যমান হয়েছিল। গল্পটি সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৮-১৯৭৫) সম্পাদিত সমকাল (১৯৫৭) সাহিত্য-পাতায় প্রকাশ (১৯৬০) হয়েছিল। ঐ গল্পটি দিয়েই তিনি সুধী সাহিত্য-সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বোদ্ধা সাহিত্য-সমাজ একজন শক্তিমান কথাকারের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। সেই অনুভবেরই জীবন্ত প্রমাণ আজকের এই হাসান আজিজুল হক। মূলত একটি সংবেদনশীল হৃদয় নিয়েই সাহিত্যে এসেছিলেন তিনি। দাঁড়িয়েছিলেন প্রান্তজনের পাশে। এদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনার স্বরূপ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন দুঃখী মানুষের দুঃখকষ্টকে ভাষারূপ দিতে। মানুষের লাঞ্ছনা তিনি সইতে পারতেন না। পারতেন না শ্রেণিবৈষম্য ও ভেদভেদাভেদ মেনে নিতে। একুশ বছর বয়সে লিখিত ‘শকুন’ শিরোনামের গল্পটি একটি প্রতীকী গল্প। মূলত উচ্চবর্ণ ও বিত্তের মানুষের শাসকচরিত্রের স্বরূপটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। গল্পজুড়ে শকুনের কথা বললেও দু’একটি ছোট্ট বাক্যেই স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন শকুনটা আদতে পাখি প্রজাপতির কোনো প্রাণী নয়। এটি দেখলেই সুদখোর মহাজনের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে যায় তার শোষক চেহারার কথা। সবটুকু ঘৃণা ঐ শোষকের প্রতি-‘শালা সুদখোর অঘোর বোষ্টম।’
হাসান আজিজুল হক ব্রিটিশ-ভূভারতের বর্ধমান থেকে হাসান এসেছিলেন পূর্ব বাংলার এই জীবন ও জনপদে। কেবল হাসান একা নয়, আবদুল মান্নান সৈয়দ, শওকত আলী, আনিসুজ্জামান, আনোয়ার পাশাসহ আরো অনেকে। ভালোবেসে নয়, অনেকটা বাধ্য হয়েই এসেছিলেন। বিধাতা-প্রদত্ত জীবনটা প্রাণে বেঁচে গেলেও তৎকালীন পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশ) খুব একটা স্বস্তিতে ছিলেন না তিনি। এখানেও ছিল পাকিস্তানি শাসনশোষণ, সামরিক জান্তার অক্টোপাস। মহান মুক্তিযুদ্ধে (১৯৭১) পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা তার প্রথম যৌবনের আরেক বেদনাময় অভিজ্ঞতা। ‘ভূষণের একদিন’ গল্পে এমনই একটি গণহত্যার ভাষিকরূপ দিতে চেয়েছেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই গ্রামীণ একটি হাটের সমুদয় মানুষকে কীভাবে পাকিস্তানি বাহিনী মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল, তারই একটি অনুপুঙ্খ চিত্ররূপ তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। কীভাবে একটি ঝাঁকি দিয়েই ভূষণের দেহটা নিথর হয়ে যায়। কীভাবে মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্তে পুত্র হারাধনকে ডেকেছিলেন। এই সব বেদনাময় জীবনকথা তুলে আনতে চেয়েছিলেন তিনি। কীভাবে গুলিবিদ্ধ শিশুর মাথা ভেঙে রক্ত ও ঘিলু ছড়িয়ে পড়েছিল মমতাময়ী মায়ের হাতে, কীভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ব্লাউজ এক টানে ছিঁড়ে ফেলেছিল ঐ কিশোরী মাতা, কীভাবে গুলিতে চৌচির হয়ে গিয়েছিল তার দুধেভরা স্তন। এই সব বেদনাময় জীবনকথা তুলে আনতে চেয়েছিলেন হাসান আজিজুল হক। কেবল এই একটি নারী চরিত্র নয়, হাসানের সিংহভাগ নারী চরিত্র প্রতিবাদী। যুগ যুগ ধরে, কালকাল ধরে নারীর বঞ্চনা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। হয়তোবা এই ভাবনা থেকে তিনি লিখেছিলেন ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ (২০১৩)। তবে সাবিত্রী প্রতিবাদী ছিল না। প্রতিবাদ করবার মতো পরিবেশ সে সময়ে ছিল না। সর্বংসহা বসুন্ধরার মতো সমুদয় অনাচার-অবিচার নীরবে-নিভৃতে সয়ে গেছে সাবিত্রী। হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখব, কি গল্প, কি উপন্যাসে সর্বত্রই তিনি সমসাময়িক সময়কে ধারণ করতে চেয়েছেন, চেয়েছেন জনমানবের দুঃখকষ্টকে তুলে ধরতে। শেষতক হাসান একজন মানবিক লেখক ছিলেন এবং এই মানবিক সংবেদনশীলতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন। কথাসাহিত্যের বাইরেও ‘কথাসাহিত্যের কথকথা’, ‘অপ্রকাশের ভার’, ‘অতলের আঁধি’, অথবা সক্রেটিস প্রসঙ্গে দরকারি কিছু প্রবন্ধনিবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। এসব প্রবন্ধনিবন্ধ পঠনপাঠনে সুস্বাদু হলেও কিছুটা অগভীর বলেই মনে হয়। হাসান আজিজুল হকের মৌল পরিচয় মূলত কথাসাহিত্যিক হিসেবে। কথাকার হিসেবেই তাকে আমরা জানি। এখানেই তিনি মানুষের কথাই বলতে চেয়েছেন। দলিত-মথিত মানুষের কথা, নিচে চাপা পড়া মানুষের কথা। হাসান আজিজুল হক মানেই ভাঙাগড়ার ইতিহাস। না ভাঙলে তিনি গড়তেন কীভাবে। দেশটি যদি না ভাঙতো, বাংলা যদি বিভক্ত না হতো, তাহলে কি হাসান আজিজুল হককে এভাবে পাওয়া যেতো? তিনি পশ্চিম থেকে পূর্ববাংলায় আসতেন? ‘আগুনপাখি’র মতো বেদনাময় উপাখ্যান কি লিখতেন? আমরা কি পেতাম আজকের হাসান আজিজুল হককে? তাহলে এই সব ঘটনাই কি হাসান আজিজুল হককে মানবিক করে তুলেছিল?
যেভাবে, যেদিক থেকেই দেখি না কেন, হাসান আজিজুল হক ছিলেন মানবতার মানুষ। নিম্নবর্গীয় মানুষের প্রতি তার অসীম মায়া। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে নিম্নবর্গ একেবারে নতুন নয়। সেই ‘চর্যাপদ’ থেকে আরম্ভ করে প্রাচীন ও মধ্যযুগ পেরিয়ে আধুনিককালে এসে আজঅবধি বহু শিল্পীসাহিত্যিক বিষয়টির প্রতি মমতাময়ী দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন। এই কাতারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় হয়ে এযুগের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অথবা আহমদ ছফা পর্যন্ত অনেক শিল্পীসাহিত্যিকের নামোল্লেখ করা যায়। তবে এত এত অযুতনিযুত লেখকের ভিড়ের মধ্যেও হাসান আজিজুল হককে সহজেই চেনা যায়। তিনিও নিজের জীবন ও জগতের দিকে তাকিয়েছিলেন, তাকিয়েছিলেন সময় ও সমাজের দিকে, মানুষ ও মানবতার দিকে। বিষয়বস্তু অনেকটা অভিন্ন হলেও নান্দনিক উপস্থাপনাগুণে তিনি উতরে যান। তিনি হয়ে যান সবার থেকে আলাদা, স্বতন্ত্র শিল্পভুবনের বাসিন্দা। কথাকার হিসেবে তার অমরতার আসনটি সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। শতাব্দীর শিল্পসারথি এই শিল্পমানুষের বিদায়ে শোকাহত শিল্পভুবন। জীবনের নিয়মেই তিনি চলে গেলেন জীবনের পথে। রেখে গেলেন অজস্র পদচিহ্ন। ঐ পথ ও পদচিহ্নই আমাদের পথ, মানুষ ও মানবতার পথ, মুক্তির পথ। এপথেই আমরা বারবার ফিরে পাব হাসান আজিজুল হককে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়