মানিলন্ডারিং মামলা : হাইকোর্টে জামিন পাননি এসপিসি ওয়ার্ল্ডের শারমিন

আগের সংবাদ

জাহাঙ্গীর আজীবন বহিষ্কার : আ.লীগের সভায় সিদ্ধান্ত, মেয়র পদ হারাতে পারেন জাহাঙ্গীর > খালেদার টার্গেট আমি : প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

‘লাল ঘোড়া আমি’ এখনো সজীব ও জীবন্ত

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের শিশুসাহিত্যে বড়ো গৌরবের বিষয় হলো যে, বড়ো লেখকরা ছোটদের অবহেলা করেননি। তারা মুখ ফিরিয়ে থাকেননি। ছোটদের জন্য তারা যৎসামান্য হলেও লিখেছেন। বিষয়টি খুবই আনন্দের। তাই আমরা দেখি যে, কবি জসীমউদ্দীন, শওকত ওসমান, রাবেয়া খাতুন, সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, রাহাত খান, হাসান আজিজুল হকের মতো প্রথিতযশা লেখকরা ছোটদের উপেক্ষা করেননি। তাদের প্রত্যেকের একাধিক ছোটদের বই আছে। তাদের লেখাও অতি উচ্চমানের। কিশোর তরুণদের উৎকর্ষধর্মী লেখা সেসব লেখা।
হাসান আজিজুল হক আমাদের দেশের প্রধান কথাসাহিত্যিক। মূলত বড়োদের জন্য গল্প-উপন্যাস লিখে থাকেন। তার স্মরণীয় অনেক ছোট গল্প আছে। আত্মজা ও একটি করবী গাছ কিংবা জীবন ঘষে আগুন তার স্মরণীয় সৃষ্টি। এ ছাড়াও সাহিত্য নিয়ে তিনি দার্শনিক গদ্য লিখেছেন। কথাসাহিত্যের কথকতা তার আরেকটি বিখ্যাত বই।
সেই বরণীয় লেখক হাসান আজিজুল হক কখনো ছোটদের বিস্মৃত হননি। তিনি বড়োদের লেখার পাশাপাশি সবসময় ছোটদের জন্য লিখে গেছেন। সম্ভবত মাসিক টাপুর টুপুর পত্রিকায় তিনি বেশকিছু হাসির গল্প লিখেছিলেন ষাটের দশকে। সেসব গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘ফুটবল থেকে সাবধান’ গল্পগ্রন্থ। স্বাধীনতা উত্তরকালে ‘শিশু’ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় লেখেন ‘লাল ঘোড়া আমি’ শিরোনামে একটি কিশোর উপন্যাস।

দুই.
লাল ঘোড়া আমি এখনো সজীব ও জীবন্ত। প্রায় ৪০ বছর পূর্বে লেখা এই বই। বইটিতে অনবদ্য ভাষায় ঘোড়ার বয়ান দিয়ে সমাজ ও বাস্তবতাকে তুলে এনেছেন হাসান আজিজুল হক। একটা ঘোড়ার আত্মকাহিনী স্টাইলে লেখাটি তৈরি হয়েছে, কাহিনীর আখ্যানে রূপক অয়ে ঘোড়ার মাধ্যমে মানুষের জীবনের গল্পই রচিত হয়েছে। লাল ঘোড়ার বয়ানে বাস্তবতা পৃথিবীর বাইরে লেখক কিছুই বলেননি। এমন রূপক ও বাস্তব কাহিনী বাংলা ভাষায় আর কোনো লেখা আছে কিনা জানি না।
এক টানে গল্পটা বর্ণনা করা হয়েছে। পরিচ্ছদ ভাগ করা হয়নি। মাঝে মধ্যে ফাঁক দিয়ে প্যারাগ্রাফ শুরু করা হয়েছে। কোথাও আমাদের ক্লান্ত করে না লেখাটি। ঝরঝরে ভাষাভঙ্গি। তরতর করে ঘোড়ার জীবন কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। ঘোড়ার মাধ্যমে একটা সময়কালও আমাদের চোখের সামনে ফুটে ওঠে। বাংলার জনপদ, কৃষিজীবী সমাজ ব্যবস্থা, জমিদার শ্রেণি। এদের ছবি এঁকেছেন লেখক। কিন্তু পুরো ঘটনাটি ঘটে যাচ্ছে লাল ঘোড়াকে কেন্দ্র করে।
হাসান আজিজুল হক অতি শক্তিমান কথাসাহিত্যিক। তাই ছোটদের লেখাতেও তার অপরিমেয় শক্তিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য ভাষা ও গদ্যরীতি নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া দুঃসাধ্য। তিনি গদ্য ও পদ্যের বিভেদ বোঝেন। গদ্য ভাষাকে কখনো তিনি পদ্যে রূপান্তরিত করেন না। বাংলা শিশুসাহিত্য বা বিশ্ব শিশুসাহিত্যের দিকে তাকালে আমরা এক ধরনের কবিতাময় রূপক ভাষার ব্যবহার করতে দেখি। রূপকথা ভাষাভঙ্গিতে সেই লক্ষণ অতি প্রবল। রবীন্দ্রনাথ, অবনঠাকুর বা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের শিশুসাহিত্যের ভাষায় সেই কাব্যিকতা দেখতে পাই। কোথাও কোথাও মনে হয়, এটা কি পদ্যে লেখা হয়েছে নাকি এটা গদ্যে? প্রাচীন সাহিত্যে অবশ্য পুরোটাই পদ্যের লালিত্যে রচিত। অথবা পদ্য আমাদের চেতনাকে নাড়া দেয়।
নিরেট গদ্যে উন্নতমানের শিশুসাহিত্য রচনা খুবই দুরূহ কাজ। খানিকটা পদ্য মিশ্রিত না করলে শিশুদের কাছে তা সহজে গ্রহণযোগ্য হয় না।
হাসান আজিজুল হক ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। তিনি নিপুণ গদ্যশিল্পী। আধুনিক গদ্য রীতিতেই তিনি গল্প কথনের আখ্যান তুলে ধরেন। গদ্যশিল্পী হিসেবে তার তুলনা রহিত।
আমাদের শিশুসাহিত্যে হাসান আজিজুল হক অল্প কিছু লিখেছেন। কিন্তু যা লিখেছেন তা আমাদের গদ্যসাহিত্যের সম্পদ। তিনি একমাত্র লেখক যিনি গদ্যকে গদ্যেই মুক্তি দিয়েছেন কোথাও তার গদ্য শিথিল হয়নি। দুর্লভ এই ক্ষমতার কারণেই তার লেখা হয়ে ওঠে একেবারেই নিজস্ব।
ঘোড়ার আত্মকথনে তিনি গল্পটা সরলভাবে বলে গেছেন। একটা প্যারাগ্রাফ উল্লেখ করলেই সেটা স্পষ্ট হবে? অন্যসব গরু-মোষের বেলায় কত দরাদরি হচ্ছিল। আমার বেলায় এসব কিছুই হলো না। আমাকে কেনার কোনো ইচ্ছা লোকটার ছিল না। কিন্তু এখন সে মুশকিলে পড়ে গিয়েছে। আমার যে দাম লোকটা দিতে চেয়েছে তাতেই আমার মনিব রাজি। কাজেই লোকটা তার কোমর থেকে একটা লম্বা সাপের মতো কাপড়ের থলে বের করে তার ভেতর থেকে কতগুলো কাগজ বের করে। তারপর খুব যতেœর সঙ্গে জিবে আঙুল দিয়ে কাগজ গুনে গুনে মনিবের কাছে দিয়ে বলল, এই হলো ২০ টাকা। ভরপুর রুপোর চাকতিগুলো একটা একটা করে আমার মনিবের হাতে ফেলতে লাগল ঠনঠন করে। আর মুখে বলতে লাগল। এক দুই তিন। এমনি করে ১০ পর্যন্ত গুনে বলল, তাহলে এই হলে সে জিরিশা।
টাকাগুলো পেয়ে আমার মনিব এমন প্যাঁচার মতো মুখ করে সেগুলো গুনতে লাগল যে আমার হাসি পেয়ে গেল।… এমন নিরেট মেদহীন, অলঙ্কার বাহুল্য গদ্য বাংলা শিশুসাহিত্যে বিরল। সেই অর্থে ‘লাল ঘোড়া আমি’ মনে করি আমাদের ক্ল্যাসিক শিশুসাহিত্য।
গল্পের প্রেক্ষাপটও খুব আলাদা। সামন্ত যুগের ছবি পাওয়া যায়। কিন্তু কোথাও ইতিহাস বড়ো হয়ে ওঠেনি। তিনি সময়কালকে তৈরি করেছেন পটভূমি হিসেবে। কিন্তু ইতিহাস রূপায়ণ করেননি।
বইটি ছোট্ট পরিসরে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটকে ধারণ করেছেন। বাংলা শিশুসাহিত্যে একেবারেই অন্য রকম বই। বইটি বারবার পড়ি। বারবার নানা অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হই।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়