মানিলন্ডারিং মামলা : হাইকোর্টে জামিন পাননি এসপিসি ওয়ার্ল্ডের শারমিন

আগের সংবাদ

জাহাঙ্গীর আজীবন বহিষ্কার : আ.লীগের সভায় সিদ্ধান্ত, মেয়র পদ হারাতে পারেন জাহাঙ্গীর > খালেদার টার্গেট আমি : প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

নিম্নবর্গ মানুষের কথাকার

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

বাংলা ছোটগল্পের রাজপুত্র হিসেবে খ্যাত হাসান আজিজুল হক [২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১] বিষয়বৈচিত্র্য ও চরিত্রচিত্রণে নিম্নবর্গের মানুষদের বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন। উপস্থাপন করেছেন তাদের বাস্তবতায় এবং জীবন সংগ্রামের বহুবিধ স্মারকে ধারণ করে। তার গল্পে নিম্নবর্গের কৃত্রিম জীবনের বদলে মৌলিক জীবনই পেয়েছে প্রাধান্য; কারণ এ জীবনের সঙ্গে তার পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। তার শৈশব, কৈশোর- এককথায় জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে এই নিম্নবর্গের মানুষের সঙ্গে।
বাংলা ছোটগল্পের আরম্ভ উনিশ শতক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্য দিয়ে। তিনি বাংলা গল্পের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সাহিত্যে নির্মাণ করেছিলেন উচ্চবর্গের মানুষদের। অবশ্য এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই তার কিছু গল্পে সমাজের নিচুতলার মানুষ বা নিম্নবর্গের জীবন আখ্যান বিবৃত। যাইহোক, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উচ্চবর্গীয় আবহ থেকে ছোটগল্পকে বের করে শোনান নিম্নবর্গ নারীর কথা; তাদের যন্ত্রণা, দুঃখ, সমাজ ও ধর্মের চাপে দমিত রাখা মনের আবেগ, ভালোবাসা, নিজের মনের কথা। জগদীশ গুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রমুখ পুরোপুরিভাবে সাহিত্যে নিয়ে আসেন নিম্নবর্গের মানুষদের। তাদের এই প্রচেষ্টার পূর্ণরূপ প্রকাশিত বিভূতিভূষণ-মানিক-তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে। সেই ধারায় সমরেশ বসু, সুবোধ ঘোষ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ও গল্পে চিত্রিত করেন নিম্নবর্গের মানুষ।
দেশ বিভাগের ফলে ঢাকাকে ঘিরে রচিত হতে থাকে সাহিত্য, সেই সাহিত্যে রয়ে যায় নিম্নবর্গের মানুষদের নির্মাণ প্রক্রিয়া। শামসুদ্দীন আবুল কালাম, আবু ইসহাক, সরদার জয়েনউদদীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্সহ অনেকেই নিম্নবর্গের মানুষদের গল্পে প্রতিষ্ঠা করেন। হাসান আজিজুল হক পূর্বোক্ত ধারার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তার গল্পের বিস্তর পরিসরে নির্মাণ করেন উচ্চবর্গ কর্তৃক নিম্নবর্গের মানুষের শোষণ, অন্যায় নিপীড়ন, দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষদের- মুখে প্রতিবাদের ভাষাদানসহ। অর্থনৈতিক বিবেচনায় সমাজের অবহেলিত, দরিদ্র, পতিত মানুষদের সংকট, রাজনৈতিক বাস্তবতা, সামাজিক আন্তঃক্রিয়া চিত্রায়ণে হাসান আজিজুল হক পারঙ্গমতার পরিচয় দিয়েছেন। তার গল্পে উঠে এসেছে নিম্নবর্গের জীবনের পূর্ণরূপ- কৃষি পেশাকে অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ, অন্যায় বাধা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলে প্রতিবাদে ফেটে পড়ার মধ্য দিয়ে। নিম্নবর্গের মানুষ কেবল নীরবে সবই সহ্য করবে এমন নয়, তার প্রতিবাদী মনোভাবও রয়েছে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবেই নানা আচরণকে অবলম্বন করে।
‘উচ্চবর্গের নির্মাণের খোলসটা কোনো ঐতিহাসিক নয়, প্রকৃত অর্থে খসিয়ে দিতে পারেন একজন স্বার্থলেশহীন দায়বদ্ধ সাহিত্যস্রষ্টা। হাজার হাজার ইতিহাসের দলিল যা পারে না, একটি সাহিত্য সৃষ্টি কিন্তু নিম্নবর্গের নির্মাণের ক্ষেত্রে তা সহজ-সম্ভব করে তুলতে পারে।’ হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য ঠিক তাই করেছে। তার ছোটগল্পে নিম্নবর্গের পাওয়া না পাওয়া, দারিদ্র্য, শোষণ, প্রতিবাদ বেশ জোরালো। তিনি নিম্নবর্গের সমাজ হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন কৃষি সমাজকে; কেননা এ সমাজের মানুষদের তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন খুব কাছ থেকে, তিনিও ছিলেন একজন কৃষক পরিবারের সন্তান; এ পরিবারেই তার বেড়ে ওঠা। তিনি নিম্নবর্গের মানুষদের পছন্দ করতেন।
হাসান আজিজুল হকের শৈশব, কৈশোর এবং জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে সমাজের অবহেলিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত নিম্নবর্গ কৃষকদের সংস্পর্শে। তার মানস প্রবণতায় এই নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি মমতা, সহানুভূতি এবং টান থাকায় গল্পের মূল প্রেক্ষাপট নিয়ন্ত্রণ করেছে এই মানুষরাই। ‘‘‘উচ্চবর্গ’ এবং ‘নিম্নবর্গ’ ধারণাটির সংজ্ঞার্থ নির্ণয় করা হয়েছে সামাজিক সম্পর্কের সেই সমতলে যেখানে ক্ষমতাই মূল কথা। যেখানে প্রভুত্ব বা অধীনতার এক বিশিষ্ট কাঠামোর মধ্যে সামাজিক সম্পর্কটি বাঁধা থাকে। উচ্চবর্গ এবং নিম্নবর্গ বিশ্লেষণের লক্ষ্য হলো সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামাজিক ক্ষমতার বিন্যাস ও পুনরাবর্তনের প্রক্রিয়াগুলোকে তাদের মৌলিক উপাদানে বিভক্ত করে দেখা। প্রভুত্ব বা অধীনতা সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন-সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে।” নিম্নবর্গ সমাজের নিম্নস্তরে বাস করার সঙ্গে সঙ্গে এমন এক পেশাকে অবলম্বন করে জীবনধারণ করে, যা সমাজে কোনো উচ্চমর্যাদা পায় না। তাদের অর্থনৈতিক হিসেবে একেবারে ভিন্ন-আলাদা সমাজের ধনাঢ্য উচ্চবর্গীয়দের থেকে। কোনোরকমে জীবনকে বাঁচানোই মূল উপজীব্য হয়ে উঠে। তাদের পেশা ভাবনাও খুব দুর্বল হয়ে থাকে। গভীর জলে পড়ে গেলে মানুষ যেমন সামনে যা পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে আবার জীবনের স্বাদ পেতে চায়, তেমনি কোনো একটি পেশাকে অবলম্বন করেই তারা জীবনকে অতিবাহিত করার চেষ্টা করে। এককথায় সমাজের নিম্নস্তরে যেমন তাদের বাস তেমনি পেশাও হয়ে থাকে একেবারে অমর্যাদাকর- যার উপর ভর করেই তাদের পরিবার-সমাজ চালিত হয়।
হাসান আজিজুল হকের গল্পে সমাজ হিসেবে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে ‘কৃষক সমাজ’; যে সমাজের মানুষ ক্ষুধা-দারিদ্র্য, শোষণ-বঞ্চনায় ক্ষতবিক্ষত। রণজিৎ গুহের মতানুসারে ‘কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত গ্রামের খেতমজুর, গরিব চাষি ও প্রায়-গরিব মাঝারি চাষি,…ধনী কৃষকরাও নিম্নবর্গের মধ্যে গণ্য।’ কৃষকরা নিম্নবর্গ বলে তাদের জীবনযাপন, চিন্তা-ভাবনা, ধর্ম, রাজনৈতিক দিক গুরুত্বপূর্ণ নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের কাছে। হাসানও তার চারপাশে এই মানুষদেরই দেখেছেন, ‘ভিটেটুকু বাদ দিলে এক টুকরো জমিও নেই যাদের। দিনরাত খেটে যে ফসল পায়, তা দিয়ে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, শিক্ষা মেটানো সম্ভব হয় না।’ এমন মানবেতর জীবনযাপনকারী মানুষদের তিনি গল্পের প্রাণকেন্দ্রে রেখেছেন। কৃষক সমাজ ছাড়াও দেহজীবী তথা পতিতা সমাজ, নাপিত, পকেটমার, চোর, স্কুল শিক্ষক, বাগদী প্রভৃতি সমাজের নিম্নবর্গের মানুষরাও গল্পে ওঠে এসেছে।

দুই.
হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পে সমাজ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিম্নবর্গের যে অবস্থার কথা পাওয়া যায় : ক. উচ্চবর্গ কর্তৃক নিম্নবর্গের শোষণ ও নির্যাতন। খ. ক্ষুধা, দারিদ্র্যের হাহাকার এবং গ. নিম্নবর্গ উচ্চবর্গ কর্তৃক ক্ষমতাচর্চার শিকার।
হাসান আজিজুল হকের গল্পে নিম্নবর্গের মানুষ শোষিত, নির্যাতিত হয় জোতদার, মহাজন, টাকাওয়ালা মালিক কর্তৃক। শোষণের কবলে পড়ে নিজের উৎপাদিত ফসল মালিকের ঘরে তুলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাছে বিক্রি করতে হয় নিজের জমিটুকুও; উচ্চবর্গ, নিম্নবর্গের জায়গা সংকটে সামান্য সহায়তা করে দীর্ঘস্থায়ী শোষণ প্রক্রিয়া বহাল রাখে।
হাসান আজিজুল হক জীবনের প্রথম ১৬ বছর অস্থির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভেতর কাটিয়েছেন। দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক প্রবল মন্দা, নৈতিক অবক্ষয়, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি, সব মিলিয়ে এক ধরনের টালমাটাল অবস্থায় হাসানের মানসগঠন হয়েছে। ‘এদেশের অধিকাংশ মানুষকে ক্ষুদ্র শোষক ও শাসকগোষ্ঠী তাদের শোষণ প্রক্রিয়ার যাঁতাকলে ফেলে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করে। হাসানের মতো সমাজ সচেতন লেখকের গল্পে এই নিপীড়িত, শোষিত দরিদ্র মানুষের ভিড় সেই কারণে লক্ষণীয়।’
উচ্চবর্গের শোষণ এবং শোষিতের জীবন প্রকাশিত হাসান আজিজুল হকের ‘সমুখে শান্তি পারাবার’, ‘মাটি-পাষাণের বৃত্তান্ত’, ‘বিলি ব্যবস্থা’, ‘পরবাসী’, ‘দিবাস্বপ্ন’, ‘একজন চরিত্রহীনের স্বপক্ষে’ প্রভৃতি গল্পে। নিম্নবর্গ বৃদ্ধ, বশির, ওয়াজদ্দি, ভামিনী, একামতউল্লা, নেক বখ্শ, নেকী- উচ্চবর্গ জোতদার, মালিক কর্তৃক শোষণ, নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পায় না; তাদের দুর্বিষহ জীবন উচ্চবর্গের পীড়নের ফলে অতিবাহিত হয়।
হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পে স্পষ্ট ক্ষুধা, দারিদ্র্যের ভয়ঙ্কর চিত্র; যা চরিত্রকে বিপর্যস্ত করে তোলে, এসবের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বেছে নেয় চৌর্যবৃত্তি। খেতে দিতে পারবে না বলে পছন্দের মানুষ বিয়ে করে অন্যকে, গড়ে উঠে না দারিদ্র্যের যাঁতাকলে পিষ্ট পরিবারের সঙ্গে উচ্চবর্গের সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক, দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি পেতে মেয়েকে লেলিয়ে দেয় বৃদ্ধ পিতা পতিতাবৃত্তিতে এবং সামান্য অর্থের জন্য চরিত্র বাধ্য হয়ে গ্রহণ করে সে পেশা, বন্ধক রাখতে হয় আবাদি জমি, চরিত্রকে থাকতে হয় না খেয়ে এবং অবশেষে মৃত্যুকে গ্রহণ করে নেয়। অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে সৃষ্ট ক্ষুধা, দারিদ্র্য প্রকটিত ‘তৃষ্ণা’, ‘মন তার শঙ্খিনী’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘বিমর্ষরাত্রিঃ প্রথম প্রহর’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘সারাদুপুর’, ‘আমৃত্যু আজীবন’, ‘মারী’, ‘শোণিত সেতু’, ‘খাঁচা, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘ফেরা’, ‘কেউ আসেনি’, ‘ভূষণের একদিন’, ‘ঘরগেরস্থি’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘মধ্যরাতের কাব্যি’, ‘সরল হিংসা’, ‘খনন’, ‘অচিন পাখি’, ‘রোদে যাবো’, ‘বাইরে’, ‘ভূতের কষ্ট’ প্রভৃতি গল্পে। ক্ষুধা, দারিদ্র্যের কবল থেকে নিম্নবর্গের মানুষের মুক্তি নেই, এ থেকে উত্তরণের সংগ্রামে নামে কিন্তু সেই সংগ্রাম ব্যর্থ হয়; শেষ পর্যন্ত এ জীবনই হয় সঙ্গী- হাসান আজিজুল হকের গল্পের চরিত্রেরও দারিদ্র্যের জীবন থেকে সামান্য মুক্তি নেই।
হাসান আজিজুল হকের গল্পে ক্ষমতাচর্চার পরিপ্রেক্ষিত হলো ক. পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর ক্ষমতাচর্চা, খ. এদেশের সাধারণ মানুষ অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাকসেনাদের ওপর চর্চা করে ক্ষমতা, গ. সংখ্যালঘুর ওপর ক্ষমতাচর্চা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এদেশের মানুষের ওপর মনস্তাত্ত্বিক পীড়নে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর চালায় দৈহিক পীড়ন। এদেশের মানুষদের নির্বিচারে হত্যার জন্য পাকসেনাদের লেলিয়ে দেয়; যারা অস্ত্রহাতে হয়ে ওঠে উচ্চবর্গ অস্ত্রহীন পূর্ববাংলার জনগণের কাছে। তাদের উচ্চবর্গীয় পীড়নের কোনো সীমা পরিসীমা থাকে না, এদেশের মানুষদের খুন করে, লুণ্ঠন লুটতরাজ থাকে তুঙ্গে। অস্ত্রহীন নিম্নবর্গ অবস্থায় এদেশের মানুষ পালাতে থাকে, দিগি¦দিক ছুটতে থাকে। পাকিস্তানিরা অস্ত্র হাতে ক্ষমতার চর্চা করে এদেশের মানুষের ওপর। কেবল পাকসেনারাই ক্ষমতার চর্চায় নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারে না, তাদের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ করে এদেশের মানুষ সংগঠিত হয়ে। তারাও তাদের কোমল হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে বিতাড়িত করে পাকসেনাদের, নিজেদের ক্ষমতাচর্চা করে।
তবে এদেশের মানুষ সংগঠিত হওয়ার আগেই পাকসেনাদের উচ্চবর্গীয় অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়। পাকসেনাদের অত্যাচারের বীভৎস রূপ প্রকাশিত ‘ভূষণের একদিন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘কৃষ্ণপক্ষের দিন’, ‘আটক’, ‘ঝড়’, ‘নিশীথ’ ‘ঘোটকী’ প্রভৃতি গল্পে।
নিম্নবর্গ সবসময়ই বসবাস করে ক্ষমতার নিচে, তাই তারা জীবনে বারবার হয় ব্যবহৃত উচ্চবর্গ কর্তৃক। হাসান আজিজুল হকের গল্পের নিম্নবর্গও উচ্চবর্গ কর্তৃক ক্ষমতাচর্চার শিকার।

তিন.
পুরুষ তার ইচ্ছেকে জিইয়ে রাখার জন্য নারীকে নির্মাণ এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য ঈশ্বরের বিধান ব্যবহার করে নিজেরা বিধিমালা তৈরি করে তাদের ওপর আধিপত্য কায়েম করে। ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা হয়ে উঠেছে নিম্নবর্গ, তারা চালিত নিয়মে অনেকটাই চলিত। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘পুরুষশাসিত সমাজে সব নারীই এক অর্থে নিম্নবর্গ।’ এ সম্পর্কে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের ভাষ্যকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যাবে : ‘শ্রেণিবিভক্ত সমাজে যেখানে নিম্নবর্গেরই কোনো ইতিহাস নেই এবং তাদের কণ্ঠস্বর শ্রæত হয় না সেখানে নারী নিম্নবর্গ হিসেবে আরো অনেক অন্ধকার ছায়ার গভীর তলদেশে অবস্থান করছে।’
তবে নারী তার নিম্নবর্গত্ব ঘোচাতে কিংবা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি হওয়া নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিজেদের নির্মাণের প্রচেষ্টা চালায়। আধুনিক যুগে মানবজীবনে বিভিন্ন বিপ্লব সাধিত হলে তাদের সামাজিক মর্যাদারও পরিবর্তন শুরু হয়। নারীর স্বাধীনতার সংগ্রাম শিল্পবিপ্লব সাধনের পর থেকে বেগবান হয়। এতে নারীবাদ আরো সমৃদ্ধতার প্রলেপ মাখে। তারা পুরুষতন্ত্রের নানা ঘৃণ্য কাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এটা করার তোমাদের কোনো অধিকার নেই, এ তোমাদের অন্যায়। নারীরা তাদের ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অধিকারের কথা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা অকপটে বলতে আরম্ভ করে, নিজেদের অন্তরদেশের লুকানো বাণী প্রকাশ করে। যা এতদিন সমাজ, ধর্মের চাপে পিষ্ট ছিল, ছিল আড়ালে ঢাকা। হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পে নারীর বর্তমান অবস্থার পরিচয় মিলবে। তারা নিজেদের নির্মাণ করেছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের দ্বারা, যেখানে পুরুষতন্ত্রের হস্তক্ষেপ খানিকটা হলেও মুক্ত। সব নারী চরিত্র দীর্ঘদিনের আরোপিত কঠিন নিয়মের যাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার অবস্থা থেকে পুরোপুরি ঘুরে না দাঁড়াতে পারলেও কিছু নারী তাদের স্বাধীন মতকে প্রকাশ করেছে, ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। অংশগ্রহণ করেছে পার্টিতে, যুদ্ধে।
হাসান আজিজুল হকের গল্পে নারীর আত্মপ্রত্যয়ী রূপ লক্ষণীয়। তিনি কামনা করেছেন নারীর স্বাধীনতা। ইতিহাস, ধর্মগ্রন্থগুলো নারীকে ‘সাবজুকেটিভ’ করে রেখেছে, সব ধর্মই তাদের ভোগ্যসামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করেছে। নারীর মুক্তি নেই, নেই স্বাধীনতা। যাকে তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেন। তাই তার গল্পে তিনি নারীকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি মনে করেন নারী আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে শোষিত হচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে তারা শোষিত হচ্ছে, সমাজে তাদের সম্মান নেই, তাদের ইজ্জত নেই, নিরাপত্তাও নেই। তাই তার গল্পে অধিকারবোধ, নিজস্ব ভালো লাগার প্রাধান্য, সমাজের নিয়মবহির্ভূত যৌন মিলন, তীক্ষè বুদ্ধির অধিকারী, সাহসী, প্রতিবাদী হিসেবে নারীরা নির্মিত। তবে এসবের পাশে গদবাঁধা ফ্রেমে আবদ্ধ নারীরও পরিচয় মেলে। হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পে নারীর দুটি অবস্থানের কথা সুস্পষ্ট : ক. নিম্নবর্গের আবরণযুক্ত নারী এবং খ. নিম্নবর্গের আবরণমুক্ত নারী। নারীকে নিম্নবর্গ অভিধায় অভিহিত করেন নিম্নবর্গের তাত্ত্বিকরা। কিন্তু তাদের সংজ্ঞায়িত কাঠামোয় থাকেনি হাসান আজিজুল হকের গল্পের নারীরা। তারা নিম্নবর্গের আবরণে আবৃত নয়, সেই খোলস থেকে বের হয়ে নিজেদের নির্মাণ করেছে সমস্ত নিয়ম-কানুনের ঊর্ধ্বে, বিচক্ষণ, অধিকার সচেতন হিসেবে; যোগদান করেছে পার্টিতে, অংশগ্রহণ করেছে মুক্তিযুদ্ধে। তবে এরই সঙ্গে কিছু নারী চরিত্রের পরিচয় মেলে যারা গদবাঁধা ফ্রেমে আবদ্ধ, তাদের কোনো স্বাতন্ত্র্যিক মাত্রা আমাদের নজর কাড়েনি।

চার.
হাসান আজিজুল হক বাংলা কথাসাহিত্যে নিম্নবর্গের জীবনচিত্র রূপায়ণে অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নগরায়ণের ফলে যখন আলোকোজ্জ্বল সারাবিশ্ব, সবাই উচ্চতর জীবনের পানে ছুটছে সেখানে হাসান আজিজুল হক অন্ধকারে পড়ে থাকা সমাজের নিষ্পেষিত, নির্যাতিত, অবহেলিত মানুষদের প্রতি দৃষ্টিকে প্রসন্ন করেছেন। বহুস্তরায়িত প্রসন্ন দৃষ্টিতে নিম্নবর্গের তাত্ত্বিকরা যাদের নিম্নবর্গ হিসেবে চিহ্নিত করছেন তাদের বস্তু অভিজ্ঞতা ও ভাবের সমগ্রতায় গল্পে নির্মাণ করেছেন। নিম্নবর্গের মানুষদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে তাদের প্রতিবাদ স্পৃহাকে বেশ শক্তিশালী গাঁথুনির মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। উচ্চবর্গের শোষণ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে অস্তিত্বসম্পন্ন, প্রতিবাদী হিসেবে দেখিয়েছেন তাদের ভেতরের মানুষটাকে- যে মানুষটি কেবল মার খায় না পাল্টা মারও দিতে জানে।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়