মানিলন্ডারিং মামলা : হাইকোর্টে জামিন পাননি এসপিসি ওয়ার্ল্ডের শারমিন

আগের সংবাদ

জাহাঙ্গীর আজীবন বহিষ্কার : আ.লীগের সভায় সিদ্ধান্ত, মেয়র পদ হারাতে পারেন জাহাঙ্গীর > খালেদার টার্গেট আমি : প্রধানমন্ত্রী

পরের সংবাদ

কাছ থেকে দেখা প্রিয় মানুষ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

হাসান আজিজুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। পাশাপাশি লিখে গেছেন অসাধারণ সব লেখা। তিনি একাধারে গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন। বাংলাসাহিত্যে অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন।

ব্যক্তি হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক আমার অতি প্রিয়জন, প্রিয় মানুষ। ৩৮ বছর একসঙ্গে থেকেছি। অকৃপণভাবে অঢেল দিয়েছেন। স্যারকে নিয়ে কত যে ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হককে অনেকের মতো আমিও স্যার সম্বোধন করি। আমাদের প্রিয় হাসান স্যার। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার পড়াতেন।
স্যার কথা বলতেন খুব সুন্দর। যখন বক্তৃতা দিতেন বিস্ময়ে অবাক হয়ে শুনেছি। এক একবার মনে হয়েছে এরপর স্যার কী বলবেন! আবার সেই একইকথা তো ঘুরিয়ে বলতে হবে। হতভম্ব হয়ে গেলাম, স্যার একইকথা বললেন না। যেখানে থেমে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে নতুন কথার জন্ম দিলেন। তার মতো বলতে আর কাউকে দেখিনি। কী আনুষ্ঠানিক মঞ্চে, সভা-সমিতিতে, কী ঘরোয়া আড্ডায়। তার তুলনা তিনি নিজেই।
আমাদের যৌক্তিক সব আন্দোলনে হাসান স্যারকে সঙ্গে পেয়েছি। রাজশাহী আর্ট কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করে ফ্যাকাল্টি অব ফাইন আর্টস করার দাবি অনেকদিনের। তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাংস্কৃতিক (প্রমোদ) সম্পাদক। সিদ্ধান্ত হলো দাবি তুলে ধরতে হবে তীব্রভাবে। সেসময়ে মিডিয়ার এমন তোড়জোড় নেই। কোনো দাবির কথা ছড়িয়ে দেয়া খুব একটা সহজ ছিল না।
রাকসু ভবনে আর্ট একজিবিশনের আয়োজন করা হলো। পাশে এমন কাউকে দরকার যিনি সঙ্গে থাকলে দাবির কথা গুরুত্ব পাবে অধিক।
হাসান স্যারের কাছে গেলাম। উপমহাদেশের অন্যতম কথাশিল্পী শ্রদ্ধেয় হাসান আজিজুল হক। তিনি রাজি হলেন। উদ্বোধন করলেন একজিবিশন। স্যার দাবির পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলেন।
রাজশাহী আর্ট কলেজ এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত চারুকলা অনুষদ। দাবির প্রেক্ষিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে শুরুতে চারুকলা বিভাগ নামকরণ করে। পরবর্তীতে এটি অনুষদের মর্যাদা লাভ করেছে।
হাসান আজিজুল হক দ্রোহে আর ন্যায় দাবি আদায়ে সবসময় পাশে থেকেছেন।
চরম সংকটময় মুহূর্তে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন স্বৈরশাসক লে. জে, হুসাইন মো. এরশাদ ক্ষমতায়। হীরক রাজার মতো তার বিশ্বাস ‘এরা যত জানে তত কম মানে’। সে ঘনঘন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। আমরা হল ছাড়ি না। এরশাদের নির্দেশে সেনাবাহিনী এসে অবস্থান নেয় বিশ্ববিদ্যালয় গেটে। তাদের চোখমুখে রাগ। হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অস্ত্র তাক করে ফিল্মি অ্যাকশনে পজিশন নিয়েছে।
আমরা ছাত্রছাত্রীরা দলধরে এগিয়ে গেলাম। শিক্ষকরা আমাদের সামনে। তারা আমাদের সামনে প্রাচীর বানিয়ে রেখেছেন। সেনাবাহিনীর ছোকড়া অফিসার এসে জেনারেলের ভাব নিয়ে গম্ভীরগলায় বলল, ‘আপনারা সরে যান।’
দৃঢ়কণ্ঠে হাসান স্যার বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষকের, আপনাদের না। সূর্য খাড়া মাথার ওপর ওঠার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ ত্যাগ করবেন। উত্তেজিত ছাত্রছাত্রীদের আমরা শান্ত রেখেছি।’
এই ঘটনা হাসান স্যারের ব্যক্তিগত দৃঢ়তা আর ছাত্রছাত্রীদের প্রতি দায়িত্ববোধের পরিচয় বহন করে।

থিয়েটারে হাসান আজিজুল হক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক থিয়েটার শুরু হয় ‘থিয়েটার ওয়ার্কশপ’ নামের সংগঠনের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে হাসান আজিজুল হক সেখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন মঞ্চের দাপুটে অভিনেতা। হয়তো অনেকের তার এই অসাধারণ প্রতিভার কথা জানা নেই। হাসান স্যার মঞ্চে মনোজ মিত্রের লেখা ‘গল্প হেকিম সাহেব’ নাটকে হেকিম চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন দাপটের সঙ্গে। অভিনয় করেছেন ‘চাক ভাঙা মধু’, ‘কেনারাম বেচারাম’, ‘টিনের তলোয়ার’ ‘জমিদার দর্পণ’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র মতো উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রযোজনায়। এটা গত শতকের সত্তর-আশি-নব্বই দশকের কথা। এছাড়া বিদেশি নাটক থেকে স্যারের নিজের রূপান্তরিত ‘চন্দর কোথায়’ নাটকে তিনি দুর্দান্ত অভিনয় করেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে যত অশুভ শক্তির উত্থান ঘটেছে হাসান আজিজুল হক তাদের বিরুদ্ধে রাজপথে সক্রিয় থেকেছেন, আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

কথাসাহিত্যে হাসান আজিজুল হক
বাংলা ছোটগল্পের রাজপুত্র হিসেবে পরিচিত হাসান আজিজুল হক। তার লেখায় উঠে এসেছে বঞ্চিত মাটিঘেঁষা মানুষের কথা। হাসান আজিজুল হকের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’র প্রথম গল্প ‘শকুন’। মানুষের বিজয়কে, তৃণমূল পর্যায়ের ভাবনাবলয়কে হাসান আজিজুল হক ‘শকুন’ গল্পে নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
প্রায় অর্ধশতক ধরে তিনি লিখে গেছেন। তার লেখা ছোটগল্প ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ ব্যাপকভাবে পাঠক সমাদৃত হয়েছে। ‘আগুনপাখি’ নামে স্যারের লেখা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে। উপন্যাসটি প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের স্বীকৃতি পায়। এ উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়।
হাসান আজিজুল হকের লেখালেখির উদ্দেশ্য মানুষের সমগ্র জীবনকে স্পর্শ করা। নির্মোহভাবে মূল্যায়ন করা। যতটুকু সম্ভব সবকিছুর ওপরে মানুষকে স্থান দেয়া। সুন্দরভাবে বাঁচার আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তোলা তার লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য। তিনি মনে করেন, ভালো লেখা জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে। সাহিত্য মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠন করে। জীবনকে, পৃথিবীকে দেখার বা বিচার করার একান্ত নিজস্ব দৃষ্টি তৈরি করে দিতে পারে। সর্বোপরি, জীবনের পক্ষে মানুষকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রেরণা জোগাতে পারে। বিকৃত, নষ্ট, পচনশীল, ভোগ-উন্মত্ত সমাজের মানুষ যেখানে জান্তবভাবে বাঁচার উন্মাদনায় নেশাগ্রস্ত, সেই সমাজে হাসান স্যারের মতো একমাত্র লেখকই থাকেন নিষ্ঠাবান, স্বার্থহীন, আপসহীন, পরিবর্তনের পক্ষে দাঁড়ানো কঠিন ব্যক্তিত্ব।
হাসান স্যার নিজের গল্পে বারবার তুলে এনেছেন বঞ্চিত মানুষের প্রতি শোষণ, অন্যায় আর নিপীড়ন। দারিদ্র্যের জাঁতাকলে পিষ্ট মানুষদের প্রতিদানের ভাষা। তার লেখায় উঠে এসেছে অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মানুষের জীবনের ছবি। তিনি দেখিয়েছেন সব অন্যায় বাধা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেলে প্রতিবাদে কীভাবে ফেটে পড়েছে মানুষ। তারা যে সব শুধু সহ্যই করে তা নয়, তাদের নানা আচরণের মধ্য দিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রতিবাদী মনোভাবের।
২৮ বছরের ব্যক্তিজীবন এবং লেখায় হাসান আজিজুল হক ছিলেন শোষণ, বিভাজন, বৈষম্যের কঠোর সমালোচক এবং সংস্কৃতি ও প্রগতির দ্ব্যর্থহীন প্রবক্তা। স্যার যা লিখেছেন তা স্যারকে অমর করে গেছে। এমন গভীর ভাবনা, জীবনস্পর্শী নিতল কাহিনী আমাদের কাছে আগে বা পরে আসেনি। স্যার লেখালেখির নতুন ধারার সূচনা করেছেন। বাংলাসাহিত্য স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়