‘শিশু বক্তা’ রফিকুল মাদানীর বিরুদ্ধে চার্জশিট

আগের সংবাদ

চমক থাকছে টাইগার স্কোয়াডে ; মিরপুরে পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানের অনুশীলন

পরের সংবাদ

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন-২০২১

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৫, ২০২১ , ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

প্রতি বছরের মতো ২০২১-এর ‘বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন’ শুরু হয়েছে ৩১ অক্টোবর থেকে। ১২ নভেম্বর শেষ হয়েছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ড রাজ্যে। এ রাজ্যের বৃহত্তম জনঅধ্যুষিত শহর গøাসগোর ‘স্কটিশ ইভেন্ট ক্যাম্পাস’ ঘিরে গত কয়েক দিন ধরে সারাক্ষণই উপচে পড়েছে সহস্র সহস্র অংশগ্রহণকারীর ভিড়। ১০০টির বেশি দেশের সাংবাদিক, লবিস্ট, এনজিও কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, পরিবেশবিদ, রাজনীতিক, রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাদের প্রতিনিধিরা এতে যোগ দিয়েছেন। জলবায়ু সংরক্ষণের বিভিন্ন নীতিমালা নিয়ে, অর্থ অনুদানের বিষয় নিয়ে ধাপে ধাপে চলেছে আলোচনা আর শপথ গ্রহণের নতুন প্রতিশ্রæতি পর্ব। অন্যান্য বারের চেয়ে স্কটল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এবারের COP26 সম্মেলন (26th Session of the conference of the parties) বিভিন্ন দিক থেকে অনেক বেশি প্রত্যাশিত এবং গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পূর্ব প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ২৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনার কাজ সম্মিলিতভাবে কতটা এগিয়ে নেয়া গেছে, তার হিসাব-নিকাশ এই সম্মেলনের পরই বোঝা যাবে।
তাছাড়া ভবিষ্যতে ২০১৫-এর প্যারিস এগ্রিমেন্ট বাস্তবায়নের সম্ভাবনাই বা কতটা থাকছে, তার সিংহভাগ পরীক্ষাটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে এই ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন থেকেই। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা প্যারিস চুক্তি নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কয়েক বছর পর্যন্ত তা সফলতা পায়নি। এবারে তার সাফল্যের সম্ভাবনা কতটা থাকছে, সেটাও বোঝা যাবে সম্মেলনের ফলাফলে। জাপানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন ‘কিয়োটো প্রোটোকল’ বহু বছর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১২ সালেই পরিসমাপ্তি ঘটে গেছে তার। ১৯৯৭-এর কিয়োটো প্রোটোকল এবং ২০১৫-এর প্যারিস এগ্রিমেন্টের মধ্যে পার্থক্য হলো, কিয়োটো চুক্তিতে কেবল কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে আনার কথাই উল্লেখিত ছিল। এবং তার বাধ্যবাধকতা চাপানো হয়েছিল শুধু শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোর ওপরে। প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ধনী, দরিদ্র, উন্নত, উন্নয়নশীল সব রকম রাষ্ট্রকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। জলবায়ু দূষণের অন্যান্য কারণগুলোও যুক্ত হয়েছিল এতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ অনুদানের পরিমাণও ছিল ব্যাপক।
জলবায়ু পরিবর্তন একুশ শতকের পৃথিবীতে সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কেননা এটা এমন কোনো সুনির্দিষ্ট জাতীয় সমস্যা নয়, যাকে রাষ্ট্রীয় সীমান্তের মধ্যে আটকে রাখা যাবে। এর ফলে শুধু যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে পৃথিবী বিপর্যস্ত হবে তাই নয়। নতুন নতুন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আর নতুন রোগের প্রাদুর্ভাবে একদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বেড়ে যাবে, তেমনি খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া হুমকির মুখে পড়ায় খাদ্য সংকটের অসহনীয় পরিণতিতে দুর্ভিক্ষ নেমে আসবে কোটি কোটি মানুষের জীবনে। অসময়ে হঠাৎ বন্যা, সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোর তলিয়ে যাওয়া, ভয়াবহ হারিকেন, দীর্ঘ অনাবৃষ্টি, দিগন্তজোড়া মরুকরণ এখন নিত্যকার জলবায়ু পরিবর্তনের সংবাদ। কয়েক বছর আগে থেকে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মর্মবিদারী দাবানলও নজর কেড়েছে বিশ্বের। এর জন্য বৈশ্বিক উষ্ণতাকেই দায়ী করা হচ্ছে মূলত। ২০২১ সালে রাষ্ট্রসংঘের মুখেও তাই কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হলো- It is a code red for humanity! The earth is in a danger zone!
পৃথিবী বিপজ্জনক রাজ্যে পা দিয়েছে অনেক আগেই। সময়ে বর্ষা আসে না। বৃষ্টি ঝরে না নিয়মিত। স্নিগ্ধ হেমন্ত, জীবনদায়ী বসন্ত দীর্ঘকাল হলো ফেরারি। ঋতুরাজ্যের বেশিরভাগ সময়টাই দখল করে নিয়েছে দাবদাহ গ্রীষ্ম। ছন্দ পতনের কারণে প্রকৃতির প্রতিটি পদক্ষেপই বড় এলোমেলো। পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ জগতের কেউই তাই ভালো নেই। শুধু সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ এমন পরিস্থিতিকেও বহুকাল ধরে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে চায়নি। বরং উপভোগের সীমানা বাড়াতে বাড়াতে যুগ-যুগান্তর ধরে প্রকৃতিকে আরো বেশি ধ্বংস করায় মত্ত থেকেছে তারা। পরিবেশবিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনের সিংহভাগ দায়ভার তাই মানুষের কাঁধেই চাপিয়েছেন- ‘Scientific evidence shows that climate change is occurring, is caused by largely by human activities, and poses significant risks for a broad range of human and natural systems,’ (https://www.nap.edu).
জলবায়ু যে ভীষণভাবে বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে ভয়ংকরভাবে, সেটা বোঝার জন্য এখন আর বৈজ্ঞানিক প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো সুস্থবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ খালি চোখেও মোটা দাগে সেটা দেখতে পায়। এমন পরিস্থিতির জন্য কতটা দায়ী মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ। শতাব্দীকালের এই ভুল সংশোধনের জন্য অতি দ্রুত সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না নিলে জীবের পক্ষে পৃথিবীতে টিকে থাকা অসম্ভব। কারণ এ কথা এখন সবারই জানা- No earth, no life! If you destroy the earth, you destroy the chance of life. পৃথিবীর পরিবেশ বাসযোগ্য রাখার জন্য IPCC (intergovernmental panel on climate change)-এর বিজ্ঞানীরা ১২ বছর আগেই বলেছিলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে, অর্থাৎ একুশ শতকেই ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমিয়ে আনতে হবে। এবং প্রি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল যুগের লেভেল থেকে কোনোভাবেই ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাকে বাড়তে দেয়া যাবে না।
২০২১-এর সর্বশেষ IPCC (intergovernmental panel on climate change)-এর রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, প্যারিস চুক্তি অনুসারে তাপমাত্রা কমিয়ে আনার যে প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছিল, তা ছয় বছর পরও অফিসিয়ালি লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। যদিও ১২ বছর আগেই জানানো হয়েছিল কোন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে প্রত্যেক দেশের পক্ষে দ্রুত কার্বন ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস কমিয়ে আনা সম্ভব। নির্দিষ্ট নীতিমালাও নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০১৫-এর প্যারিস এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী সবাই সহমতও হয়েছিল, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কাজের অগ্রগতির তথ্যগুলো আপডেট করবে সবাই। এই ব্যাপারে ‘COP-26’-এর আয়োজকদের তাই গভীর প্রত্যাশা ছিল। থাকলেও আদপে অনেক দেশই কোনো আপডেট করেনি। কারণটা করোনা মহামারির দোহাই। COP-26 সম্মেলনের প্রেসিডেন্ট এবং ইউ কে-এর পার্লামেন্ট মেম্বার অলোক শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন- উন্নয়নশীল দেশগুলো এবার থেকে আর কোনো নতুন কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করতে পারবে না। এবং উন্নত রাষ্ট্রগুলোকেও ২০৩০ সাল নাগাদ সব ধরনের কয়লা ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।
২০১৫-এর প্যারিস চুক্তির মতো এবারের সম্মেলনেও বড় বড় স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। কিন্তু যেসব প্রতিশ্রæতিতে শতাব্দীকালের ভুল সংশোধনের কথা বলা হচ্ছে, সব রাষ্ট্রই এবং রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণ যথাযথভাবে তা প্রতিপালন করবে তো? বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীন এতে অংশগ্রহণ করেনি। রাশিয়া যোগ দেয়নি সম্মেলনে। টার্কি কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন টালবাহানায় ব্যস্ত। রোমে মিটিং সেরে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ৩১ অক্টোবর হঠাৎই ইউটার্ন নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কয়লা এখন পর্যন্ত বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশে জ্বালানি উৎপাদনের মূল সম্পদ। ওদিকে ওপেন বর্ডার পলিসিতে সুপার পাওয়ার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেনের কাঁধে লাখ লাখ অবৈধ ইমিগ্র্যান্টের সবরকম দায়িত্বভার। তার নিজের সৃষ্ট শতেক রকম সমস্যা। সমালোচকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার মতো তিনিও মিষ্টি কথায় যতটা দড়, ততটাই অসমর্থ প্রতিশ্রæতি রক্ষায়। বিরাট অর্থনীতির চাপে, বিশাল জনসংখ্যার কারণে, ফসলি জমি তৈরির কাজে, বাসস্থান নির্মাণের প্রয়োজনে আরো বেশি বেশি বনাঞ্চল ধ্বংস করা হচ্ছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। সেখানে ৪০ বছরে তিন গুণ হয়েছে জনসংখ্যা। প্রয়োজনে এমনকি বহুক্ষেত্রে অপ্রয়োজনেও গোটা বিশ্বে উৎপাদন বেড়েছে শিল্পদ্রব্যের। ভবিষ্যতে উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও আরো বেশি ইন্ডাস্ট্রি তৈরি হবে। নগরসভ্যতা সম্প্রসারিত হবে ক্রমান্বয়েই। তাতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা যাবে তো? নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটিয়ে?
এতসব সত্ত্বেও এবারের সম্মেলনে ৪০০ বিত্তশালী উড়ে গেছেন নিজেদের প্রাইভেট জেটে। জলবায়ু সংরক্ষণের কী চমৎকার দৃষ্টান্ত! IPCC (intergovernmental panel on climate change)-এর বিজ্ঞানীরা আবারো হুঁশিয়ার করেছেন- সময় যত পেরিয়ে যাচ্ছে ততই বেশি দ্রুততার সঙ্গে, এগ্রেসিভভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তাও বাড়ছে! বাড়লেও ক্ষতি নেই। প্রত্যাশাবাদীরা বলছেন- খধঃব রং নবঃঃবৎ ঃযধহ হবাবৎ! যদিও এর উল্টোটাও শোনা যাচ্ছে কারো কারো মুখে- সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান!
দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়