‘শিশু বক্তা’ রফিকুল মাদানীর বিরুদ্ধে চার্জশিট

আগের সংবাদ

চমক থাকছে টাইগার স্কোয়াডে ; মিরপুরে পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানের অনুশীলন

পরের সংবাদ

নষ্টের গোড়া ১৫৫ (৪) ধারা : অধিকার কর্মীদের মতে, নারীকে ‘চরিত্রহীন’ বানানোর মূলে ১৫৫ (৪) ধারা, এই ধারা পরিবর্তন করা জরুরি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১৫, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

এস এম মিজান : দেশজুড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মুখে গত বছর ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান নিশ্চিত করা গেলেও এখনো সুরক্ষিত নয় ধর্ষণের শিকার নারী। লড়াইয়ের শুরুতেই হেরে যেতে হয় নারীকে, যখন আইনি কাঠামোতেই ভিকটিমকে ‘চরিত্রহীন’ কিংবা ‘যৌন সম্পর্কে সক্রিয়’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয় আদালতে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। কোনোমতে নারীর ‘চরিত্র ভালো না’ প্রমাণ করা গেলেই জিতে যাচ্ছে ধর্ষক। সাক্ষ্য আইনের এ ধারা বাতিলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায় থেকে দাবি উঠলে উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। যদিও পরবর্তী সময়ে তা আর এগোয়নি। এরই মধ্যে ‘রেইন্ট্রি ধর্ষণ’ মামলার রায়ে বিচারকের পর্যবেক্ষণ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এই প্রেক্ষাপটে গতকাল হাইকোর্টে সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়ের হয়েছে।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষে গত বৃহস্পতিবার সব আসামির খালাসের রায় দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার। পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, অভিযোগকারী তরুণী ‘স্বেচ্ছায়’ রেইনট্রি হোটেলে গিয়ে আসামির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, সেখানে ‘ধর্ষণ ঘটেনি’। তদন্ত কর্মকর্তা ‘প্রভাবিত হয়ে’ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরীক্ষা না হলে পুলিশকে ধর্ষণের মামলা না নেয়ার ‘নির্দেশনা’ দিয়ে পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, ৭২ ঘণ্টা পর মেডিকেল টেস্ট করা হলে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় না। তাতে মামলা প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এমন পর্যবেক্ষণ নিয়ে তীব্র

সমালোচনার মধ্যেই শনিবার বিচারকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার (বিচারক) পর্যবেক্ষণ সম্পূর্ণ বেআইনি ও অসাংবিধানিক। ইতোমধ্যে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে ওই বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, যে কোনো আদালতের রায় হচ্ছে কোনো একটি মামলায় দণ্ড বা সাজার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত। আর রায়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ওই মামলা প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারকের অভিমত, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ- যা বিচারক প্রত্যাহার বা বাতিল করতে পারেন। আবার নিম্ন আদালতের রায় অথবা পর্যবেক্ষণ উচ্চ আদালত বাতিল করতে পারে। নিম্ন আদালতের ওই বিচারকের পর্যবেক্ষণ উচ্চ আদালতের নির্দেশনাই শুধু নয়, সংবিধানের লঙ্ঘন বলে মত দেন অধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা। রায়ের পর বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীতে পদযাত্রা করেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী। অধিকারকর্মীরা সাক্ষ্য আইনের বিতর্কিত ১৫৫(৪) ধারা বাতিলের পাশাপাশি গৃহ, কর্মস্থল ও গণপরিবহনে নারীর জন্যে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান। ওই ধারায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে কথা বলার যে সুযোগ রাখা হয়েছে আইনজীবীদের জন্য, তা বাতিলের দাবি ওঠে। অর্থাৎ আসামিপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে এই যুক্তি দেখাতে পারেন যে, অভিযোগকারী সাধারণভাবে ‘দুশ্চরিত্রা’, ধর্ষণের শিকার নন। ওই ধারা সংশোধনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন অধিকারকর্মীরা। গত ৩০ জুন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন। তবে পরে তা আর এগোয়নি। এ বিষয়ে কথা বলতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মোবাইল নম্বরে গতকাল কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এর আগে গত বছরের ১১ অক্টোবর সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারার বিলোপ চেয়ে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করে বলেছেন, এই ধারা অনুযায়ী মামলার জেরার সময় ধর্ষণের শিকার নারী পুনরায় হেনস্তার শিকার হন, যা বন্ধ করতে হবে। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার বিলোপ চেয়ে তারা বলেছেন, এই ধারায় জেরা করার সময় যাতে ধর্ষণের শিকার নারীকে চরিত্র, পেশা, পোশাক ইত্যাদি নিয়ে পুলিশ, আইনজীবী ও বিচারকের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে না হয়। প্রয়োজনে এর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে। ধর্ষণের শিকার ভুক্তভোগীদের মামলা পরিচালনাকালে লিঙ্গ-সংবেদনশীল আচরণ করতে পুলিশ, আইনজীবী, বিচারক ও সমাজকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এর আগে ২০১৪ সালে ‘বাংলাদেশে ধর্ষণ মামলায় চারিত্রিক প্রমাণের ব্যবহার : সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১৫৫(৪) ধারা’ শীর্ষক এক সম্মেলনে বক্তারা এই আইনের সমালোচনা করে বলেন, এ আইন পরিবর্তন করা হয়তো কঠিন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রুল আসতে পারে। তারা মনে করছেন, ১৫৫(৪) ধারাটি ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, মানবাধিকার ও নারী অধিকারকর্মী এডভোকেট ফৌজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীর জীবনে ধর্ষণ কখনো শেষ হয় না। নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে সে পরোক্ষ ধর্ষণেরই শিকার হতে থাকে। মামলা, তদন্ত, সাক্ষ্যগ্রহণ, বিচার প্রত্যেকটি পর্যায়েই যেন পরোক্ষ ‘ধর্ষণের’ শিকার হয় নারী। এ জন্য সাক্ষ্য আইনের এ দুটি ধারা বাতিলের দাবি জানাচ্ছি। মামলায় সুবিধা নিতে ধর্ষণের শিকার নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করা হয় জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, এটা অনেক সময় করা হয় মেয়েটা স্বেচ্ছায় বা তার সম্মতিতে সম্পর্ক হয়েছে এটা প্রতিষ্ঠা করতে। যেমন রেইন্ট্রির মামলায় বিচারকের পর্যবেক্ষণ সঠিক হয়নি। এটি নারী জাতিকে অপমান করা হয়েছে। মেডিকেল রিপোর্ট তো সাক্ষ্য-প্রমাণের একটা দলিল মাত্র। কেবল মেডিকেল রিপোর্ট নয়, বিচার হতে হবে ধর্ষণের কনটেক্সটের ওপর ভিত্তি করে। এখন সময় বদলেছে। কোনটা ধর্ষণ, সেটা নিয়েও নতুন করে ভাবার আছে।
এদিকে ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা সংক্রান্ত সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারা বাতিল চেয়ে গতকাল হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), নারীপক্ষ ও ব্লাস্ট্রের পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন এ রিট দায়ের করেন। রিটে এ ধারা দুটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার পাশাপাশি আইন মন্ত্রণালয়কে বিবাদী করা হয়েছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনটি শুনানি হতে পারে। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, আমরা সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ ও ১৪৬ দুটি ধারা বাতিল চেয়ে রিট দায়ের করেছি। সাক্ষ্য আইনের ধারা- ১৫৫ (৪)- এ বলা হয়েছে, কোনো লোক যখন বলাৎকার কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে সোপর্দ হয়, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রসম্পন্ন রমণী। এছাড়া সাক্ষ্য আইনের ১৪৬ ধারা উপধারা ৩ এ বলা হয়েছে, সাক্ষীর চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন করা যেতে পারে, যাতে সে এমন তথ্য দেয় যা দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত করতে সহায়ক হবে। এ জন্যই আমরা এ দুটি ধারা বাতিল চেয়েছি।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে একটি অনুষ্ঠানে আলোচনায় আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সাধারণত দুশ্চরিত্র হলেই যে ধর্ষণ করা যাবে এ বিষয়টি আমরা অনুমোদন দিতে পারি না। এ কারণে সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারা বাতিল হয়ে যাচ্ছে। সাক্ষ্য আইন সংশোধন হচ্ছে। সাক্ষ্য আইনের পরিববর্তন আমরা করছি। ভার্চুয়াল কোর্ট করার জন্য সাক্ষ্য আইনের যে যে জায়গায় পরিবর্তন করা দরকার সেগুলো আমরা পরিবর্তন করব। প্রস্তাবটি জাতীয় সংসদে উত্থাপনের কথা বলেছিলেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণের শিকার নারীদের আইনি সহায়তা দিয়ে আসা মানবাধিকারকর্মী এবং মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, ধর্ষণের শিকার হলে ৭২ ঘণ্টা পর মামলা না নেয়ার বিষয়ে ওই বিচারক যে মন্তব্য করেছেন, তিনি এটা বলতে পারেন না। এটা একমাত্র হাইকোর্ট অথবা সংসদের সিদ্ধান্ত হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখানে (রেইন্ট্রি ধর্ষণ মামলা) তদন্ত কর্মকর্তা যে চার্জশিট দাখিল করল সেখানে মামলা প্রমাণ করার মতো সেই তথ্য-প্রমাণ আছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আদালতের পিপির। এজন্য তদন্ত কর্মকর্তা, তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আদালতের পিপি বিষয়টি দেখলেন না কেন- এ তিনজনের বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। এছাড়া সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারা বাতিলের বিষয়ে তিনি বলেন, আইন কঠোর থাকলেও সাক্ষ্য আইনের এ দুটি ধারা নারীদের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা। এজন্য এ ধারা দুটি বাতিল হওয়া জরুরি। এ দুটি ধারা বাতিল হলে নারীদের বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর হবে বলে মনে করি। পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আমরা আরো এক ধাপ এগিয়ে যাব।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়