দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ : চট্টগ্রামে বিএনপির বিক্ষোভ

আগের সংবাদ

ঢিমেতালের ফাঁদে সোনালি ব্যাগ : সিলিং মেশিনে আটকে আছে উৎপাদন, বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ

পরের সংবাদ

কবিতা ভাবনা ও সময়ের প্রতিভাস

প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১২, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

কবি বেলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নভেম্বর ফেনীতে, আর মৃত্যু ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকায়। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও তিনি প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও সম্পাদক হিসেবেও ছিলেন বিশিষ্ট। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ধারাবাহিকভাবে কবিতাসহ বিভিন্ন লেখা নিরলসভাবে লিখেছেন। কলমকে হাত থেকে নামিয়ে রাখেননি- দূরবর্তী কোথাও। যদিও তার ইমেজে বোহেমিয়ান ও আড্ডাবাজের প্রবল ছাপ রয়েছে; কিন্তু সেই ছাপ ছাপিয়ে তার সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পরিধি কম বিস্তৃত নয়, বরং উল্লেখযোগ্যভাবে সংহত ও উজ্জ্বল; তার বিভিন্নমুখী লেখার স্পর্ধা- সেই প্রতিভাসে দেদীপ্যমান।
কবিতা লিখতেন বলেই তার সঙ্গে আমাদের অনেকের পরিচয়। আমরা যারা কবিতা লেখার কারণে বিভিন্ন সময়ে তার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি, তাদের তো জানি তিনি আপন করে নেয়ার জন্য উন্মুখ থাকতেন- আন্তরিকতায় ও ভালোবাসায়; বিশেষ করে তার বয়সের তুলনায় আমরা যারা দূরবর্তী ছিলাম বা ছিলাম কম বয়সী, তারা তো তার স্নেহে ও আগ্রহে কবিতা লেখা ও প্রকাশে বহুবিধ সহযোগিতা পেয়েছি, তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে না বললে অশোভন হয়ে দাঁড়ায়। আর অন্যদিকে কবিতা বিষয়ক সাংগঠনিক ভূমিকায় তার কাছাকাছি থেকে- তার সান্নিধ্য আমরা যারা পেয়েছি- বেশ সময়ও ব্যয় করেছি, এই এক জীবনে- তা তো আর এক দিগন্তপ্রসারী উজ্জ্বলতা নিয়ে আছে। কবি বেলাল চৌধুরী, লেখক বেলাল চৌধুরী, সম্পাদক বেলাল চৌধুরী, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি বেলাল চৌধুরী ও সর্বোপরি মানুষ বেলাল চৌধুরীর কথা আমরা বিভিন্নভাবেই বিভিন্ন দিক থেকেই বিভিন্নভাবে আজো শ্রদ্ধার সঙ্গে উপলব্ধি করি।
কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনা, শিশুসাহিত্য মিলিয়ে বেলাল চৌধুরীর গ্রন্থ সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। ‘বল্লাল সেন’, ‘ময়ূর বাহন’, ‘সব্ক্তুুগীন’ ছদ্মনামেও তিনি লিখেছেন। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থির জীবন ও নিসর্গ’, ‘জলবিষুবের পূর্ণিমা’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘বত্রিশ নম্বর’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে’, ‘বিদায়ী চুমুক’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’, ‘ডুমুরপাতার আবরণ’, ‘চেতনার রঙ চন্দ্রশিলা’ এবং ‘লাকসাম দাদা ও অন্যান্য গল্প’। ‘কাগজে কলমে’, ‘মিশ্রচিত্রপট’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘নবরাগে নব আনন্দে’, ‘সুন্দরবন, সোঁদরবন ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মুহূর্তভাষ্য’ ইত্যাদি তার অন্যান্য গদ্যগ্রন্থ। শিশু-কিশোরদের জন্য বেলাল চৌধুরী লিখেছেন- ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’, ‘সপ্তরতেœর কাণ্ড-কারখানা’, ‘সবুজ ভাষার ছড়া’। নিজের লেখার পাশাপাশি হোর্হে লুই বোর্হেস, পাবলো নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্তাবিও পাজের মতো কবিদের লেখা তর্জমা করেছেন বেলাল চৌধুরী; সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু স্মারকগ্রন্থ। তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্প’, ‘বিশ্বনাগরিক গ্যেটে’, ‘পাবলো নেরুদা- শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘শামসুর রাহমান সংবর্ধনাগ্রন্থ’, ‘পদাবলী কবিতা সংকলন’ ও ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’।
ছাত্র অবস্থায় বেলাল চৌধুরী জড়িয়ে পড়েন বাম ধারার রাজনীতিতে, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাগারেও যান। ষাট ও সত্তরের দশকে কয়েক বছর কলকাতায় বসবাসের সময় সাহিত্য পত্রিকা ‘কৃত্তিবাস’ সম্পাদনায়ও যুক্ত হন কবি। পরে ‘পল্লীবার্তা’, ‘সচিত্র সন্ধানী’ ও ‘ভারত বিচিত্রা’ পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত হন। আমরা জানি- কবি হিসেবে বেলাল চৌধুরী প্রথম জীবনে বোহেমিয়ান থাকলেও, পরবর্তী জীবনে বেশ শৃঙ্খলার সঙ্গে সম্পাদক ও অন্যান্য পদেও চাকরি করেছেন।
কবি বেলাল চৌধুরী কলকাতা থেকে ১৯৭৪ সালে দেশে ফিরে আসেন, যোগ দেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। পরবর্তীতে ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’ ও ‘পদাবলী’ নামের কবিতা সংগঠন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৪ সালে ‘একুশে পদক’ পান কবি বেলাল চৌধুরী; পেয়েছেন- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নীহাররঞ্জন স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা।
কবি বেলাল চৌধুরী একনিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন, এর মধ্যে জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে আমৃত্যু সম্পর্ক রেখেছিলেন, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতিও ছিলেন তিনি। আশির দশকে কবিতা-বিষয়ক চারটি সংগঠন গড়ে ওঠে। সংগঠনগুলো হলো- ‘পদাবলী’, ‘কবিকণ্ঠ’, ‘বাংলাদেশ কবিতা কেন্দ্র’ ও ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ’। ১৯৮০ সালের ১৮ ডিসেম্বর ‘পদাবলী’ আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনটি দর্শনীর বিনিময়ে প্রথম কবিতা পাঠের আয়োজন করে, তা সে সময়ে অভিনবত্বে বেশ কৌতূহলোদ্দীপক ছিল। কবি বেলাল চৌধুরী ‘পদাবলী’র সঙ্গেও নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কবি আবুজাফর ওবায়দুল্লাহর নেতৃত্বে- শামসুর রাহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, মাহমুদুল হক, রফিক আজাদ, রবিউল হুসাইন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ প্রগতিশীল কবিরা এই সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
কবি ও কবিতা সম্পর্কে কবি বেলাল চৌধুরীর অভিমত, যা আমাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ, তা উল্লেখ করি–
‘কবিতা বাঙালির মাতৃভাষা। কবিতা বাংলা সাহিত্যের জননী। বাঙালির কাব্যচর্চার শুরু কমবেশি হাজার বছর যাবত। আর সে জায়গায় গদ্যের বয়স বড়জোর দুশো আড়াইশ বছর। ব্যাকরণ, গণিত, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতিষশাস্ত্র থেকে শুরু করে সমসাময়িক যুদ্ধবিগ্রহ, রাষ্ট্রবিপ্লব, ব্যবসা-শিল্প, বাণিজ্য, ধর্মকর্ম যা পদ্যে বিবৃত করেছেন বাঙালি পদ্যকারেরা, কবিরা।
কবিতা আজকাল আর তেমন জনপ্রিয় মাধ্যম না হলেও মানবজীবনের জন্য কিন্তু অবশ্য প্রয়োজনীয়। কবিতা একটি জাতির ভাষার স্মৃতি। কবিতা না থাকলে মানুষ ভালো করে কথাই বলতে পারত না। কবিকে অবশ্যই সমাজের সমালোচক হতে হবে। আমরা একা হয়ে জন্মাই কিন্তু আমাদের প্রধান কর্তব্য একে অন্যের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া। একাত্মতার এই আকুতি অন্যদেরও জানাতে হবে। ভাষা জনগণের সম্পদ আর এই কবি এই সম্পদের অভিভাবক।’
(ভূমিকা, দুই বাংলার কবিতায় বঙ্গবন্ধু, ২০১৬)
এক ধরনের রোমান্টিকতার আবহ তার কবিতায় থাকলেও তার কবিতার মূল দ্যোতনা হিসেবে স্বদেশচেতনা থেকে শুরু করে অন্তর স্পর্শে সাধারণ মানুষের আর্ত-হাহাকার ও জীবন উন্মুখ হতে আমরা দেখি। আর সে কারণে ‘স্বদেশ’ নামক কবিতায় তিনি বলেন-
‘আমি আছি ব্যস্ত হয়ে তোমার রৌদ্রছায়ায়
এই তো তোমার ঘাসের গন্ধে তোমার পাশাপাশি
তোমার ছায়ার মতো তোমার শরীরজুড়ে
তোমার নদীর কুলকুল স্রোতে’।

বেলাল চৌধুরীর কবিতায় স্বদেশচেতনায়- তার মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক ‘একদিন চিরদিন জয়বাংলা’ কবিতায় আমরা পাই এমন প্রতিচ্ছবি-
‘জয়বাংলা ছিল আছে একদিন চিরদিন দুর্জয় এক সাহসের নাম
জয়বাংলা ছিল আছে একদিন চিরদিন দুর্বার এক সংগ্রামের নাম
জয়বাংলা ছিল আছে একদিন চিরদিন আট কোটি কোকিলের ঐকতান
জয়বাংলা ছিল আছে একদিন চিরদিন কল্লোলিত সমুদ্রের উত্তাল গর্জন’

কবি বেলাল চৌধুরীর লিখিত ‘বত্রিশ নম্বর’ নামের কবিতাটি, একটি দীর্ঘ গদ্য-কবিতা, কবিতাটিতে ইতিহাস চেতনার বিভিন্ন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন তিনি, বিবেকতাড়িত জিজ্ঞাসাকেও মূর্ত করেছেন-
‘বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস খুঁজতে গেলে
যেতে হবে বত্রিশ নম্বর
বাংলাদেশ ও বাঙালির গৌরবগাথা দেখতে হলে
যেতে হবে বত্রিশ নম্বর
বাঙালি ও বাংলাদেশের স্থাপত্য-ইতিহাস জানতে হলে
পাতা উল্টে দেখতে হবে বত্রিশ নম্বর
বাংলাদেশ ও বাঙালির কলঙ্কচিহ্ন দেখতেও
যেতে হবে সেই বত্রিশ নম্বর
. . .
এ বাড়িটির প্রতিটি ইটে গাঁথা রয়েছে
বাঙালি জাতির গৌরবগাথা, শৌর্যের কথা
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ও অর্জনের কথা
বিশ্ব মানচিত্রে একটি নতুন দেশের রক্তসিন্ধু অভ্যুদয়ের কথা।’

বর্তমান সমাজ ও সময়ের নিরিখে আমাদের অবস্থানকে কবি কী এক গভীর দ্যোতনায় টেনে এনেছেন-
‘বহু মানুষ এখন
বহুভাবে মরে যাচ্ছে
আর যারা এখনো জীবিত
তারাও যে নানাভাবে নিরন্তর
বেঁচে থাকছে, না থাকার মতো।’
(বেঁচে থাকার মানে, সেলাই করা ছায়া)
মৃত্যু বিষয়ে তার ভাবনা তার কবিতায় আমরা পেয়ে পাঠক হিসেবে সচকিত হই, তারই কবিতার পঙ্ক্তি : ‘ফেরারী আমি অনেক স্বপ্ন ও নষ্ট স্মৃতির জটিল করিডর পার হয়ে এখন কেবল একফালি সরু বারান্দায়’। আসলে কবিকেও জীবনের করিডর পার হয়ে যেন মৃত্যুরই এক সরু বারান্দায় অবশেষে উপস্থিত হতে হয়। কবি বেলাল চৌধুরী, আমাদের বেলাল ভাই, ‘আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গচিত্র’ নামক এই কবিতায় উল্লিখিত কথা তেমনভাবে বলেছেন।
কবি বেলাল চৌধুরী শেষ জীবনের দীর্ঘ সময়ে ঢাকার পল্টনের যে বাসায় বসবাস করেছেন, সে বাসায় আমরা অনেকে কমবেশি গিয়েছি, কেউবা এক বা দু’বার। ‘হাওয়ামহল’ নামক এই কবিতাটি পড়লে এক ধরনের আর্ত-হাহাকার পাওয়া যায়, মনে হয় সেই বাসাটি থাকবে, কিন্তু সেই বাসায় গিয়ে বেলাল ভাইকে আর পাওয়া যাবে না, তবে কবিতার মধ্য দিয়ে তাকে আমরা খুঁজে নেব। ‘হাওয়ামহল’ কবিতার অংশ-
‘ও-বাড়িটায় কেউ থাকে না শুধু হাওয়ার কুহক
জড়িয়ে আছে পাকে পাকে আইভি-লতার আলিঙ্গন
লালচে ইটে পড়ন্ত রোদ আর হাহাকার-
কেউ থাকে না ও-বাড়িটায় শুধু হাওয়ার কুহক’।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়