জাল সার্টিফিকেট তৈরি চক্রের ৫ সদস্য রিমান্ডে

আগের সংবাদ

স্মার্টকার্ড নিয়ে আনস্মার্টকাণ্ড!

পরের সংবাদ

সরজমিন দুবলার চর : দস্যুমুক্ত হলেও ঋণের জাল থেকে মিলছে না মুক্তি

প্রকাশিত: নভেম্বর ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ১০, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আজিজুর রহমান জিদনী, দুবলার চর (সুন্দরবন) থেকে ফিরে : দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে এখন বইছে শান্তির সুবাতাস। চাঁদা বা মুক্তিপণের জন্য অপহরণ-হত্যার ঘটনাও এখন অতীত। জেলেদের কষ্টার্জিত উপার্জনে আর ভাগ বসায় না ডাকাতরা। তবে দস্যুদের কবল মুক্তি মিললেও ঋণের জাল থেকে মুক্তি মিলছে না বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনের শুঁটকি পল্লী হিসেবে খ্যাত দুবলার চরের জেলেদের। ঋণের বোঝায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেন না তারা। আর এ সুযোগে সেখানে জেঁকে বসেছে নানা অপশক্তি। এসবের পাশাপাশি রয়েছে চিকিৎসা ও সুপেয় পানির ঘাটতিসহ নানা অসুবিধা। যে এলাকা হতে পারত সমৃদ্ধ অর্থনীতির প্রতীক, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে সে এলাকাই যেন ধুঁকছে এখন। সরজমিন দুবলার চর ঘুরে এবং মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র মিলেছে।
প্রায় ৮১ বর্গমাইলের দুবলার চরের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকলে দেখা যায় মাছ ধরে আনাসহ তা শুকানোর বিরাট কর্মযজ্ঞ। এখানে চিংড়ি, রূপচাঁদা, ছুরিসহ সামুদ্রিক নানা প্রজাতির মাছ শুকানোর কাজে ব্যস্ত হাজার হাজার মানুষ। কার্তিক মাস থেকে শুরু করে পরবর্তী ৫ মাস এখানে ব্যস্ত সময় পার করেন জেলেরা। বাকি সময় এখানে থাকার অনুমতি নেই।
হাঁটতে হাঁটতেই এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় একাধারে জেলে ও মহাজন দাউদ মোড়লের। তিনি জানান, বোট লাইসেন্স সার্টিফিকেট, ডিএফসি বা ডেইলি ফুয়েল (জ্বালানি কাঠ) কনজাম্পশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে মৎস্য ব্যবসায়ীরা সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি পান। দুবলার চরে যারা পাঁচ মাসের জন্য আসেন, তাদের বন বিভাগকে নির্দিষ্ট রাজস্ব দিয়ে জায়গা বন্দোবস্ত নিতে হয়। চরের ভেতরে ছোট ছোট অস্থায়ী ঘর তৈরি করে থাকেন মৎস্যজীবীরা। চাল-ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসেন তারা। সোলার প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎই তাদের একমাত্র ভরসা।
তিনি আরো জানান, চলতি বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে দুবলার চরে কাজ শুরু করেছেন তারা। প্রতিটি জেলে দলেই তার মতো একজন মহাজন থাকে। যার নেতৃত্বে চলে মাছ আহরণ থেকে শুঁটকি বানানোর কর্মকাণ্ড। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে, ব্যবসার জন্য প্রতি মৌসুমেই চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এখানে আসতে হয়। জালে মাছ ধরা না পড়লে চাপ বাড়তে থাকে। মৌসুম খারাপ গেলেই সব শেষ।
ঋণের জালে জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে দাউদ মোড়ল বলেন, প্রত্যেক মহাজনই কমপক্ষে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে মাছসহ শুঁটকির ব্যবসায় নামেন। কারণ তার সঙ্গে যারা কাজ করেন, তাদের ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা মাসে বেতন দিতে হয়। অভিজ্ঞ ও যোগ্যদের পারিশ্রমিক আরো বেশি। থাকা-খাওয়া ও নৌকার খরচও রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, ব্যাংকসহ সরকারি ব্যবস্থাপনায় সহজ শর্তে এসবের জন্য ঋণ মেলে না। ফলে খুলনা ও সাতক্ষীরার বড় পাইকারদের কাছ থেকে দাদন এনে মাঝারি ও ছোট মৎস্যজীবীরা দুবলার চরে পাঁচ মাস ব্যবসা করেন। দাদন চক্রের কারণে নির্দিষ্ট আড়তে মাছ বিক্রি করতে হয় তাদের। আর ৩ শতাংশ বাড়তি কমিশনও দিতে হয়। যেখানে সরকার সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে, সেখানে ২০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয় তাদের। জালে ঠিকমতো মাছ ধরা না পড়লে ঋণের বোঝা বইতে হয় পরের বছর। ফলে দস্যুদের জালে ধরা না পড়লেও ঋণের জাল থেকে মুক্তি মেলে না তাদের। এ সময় সরকারের কাছে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি। শুধু দাউদ মোড়ল নয়, দুবলার চরের সব মহাজনেরই একই দাবি।
আরো কয়েকজন মহাজন ও জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাজি কামাল উদ্দিন আহম্মেদ, খান শফিউল্লাহ খোকন, মাঈনুদ্দিন টোকন, শামীম, বুলবুল, আজিবার, পিন্টু , হাকিমসহ কথিত ১৪ সাহেব নিয়ন্ত্রণ করেন এই চর। কোন জেলেরা আসবে, কোন নৌকার পারমিট মিলবে, কারা সব সুবিধাদি পাবে- তারাই তা ঠিক করেন। এভাবেই প্রায় ৩০ হাজার লোকের কর্মযজ্ঞ চলা এ দ্বীপ থেকে ৫ মাসে কয়েক কোটি আয় করেন ওই ১৪ সাহেব। এছাড়া এ চরে রয়েছে সুপেয় পানির অভাব। কয়েকটি মিঠা পানির কুয়াই তাদের ভরসা। আরো আছে চিকিৎসা সংকট।
দুবলার চরের ব্যবসায়ী বেলায়েত সরদার জানান, এখানে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। স্থানীয় দোকানে শুধু জ¦র, কাশি বা ঠান্ডার ওষুধ মেলে। কেউ অসুস্থ হলে নৌপথে যাতায়াতের জন্য নেই দ্রুতগতির যান।
দুবলার চর নিউমার্কেটের পল্লী চিকিৎসক মো. তরিকুল ইসলাম জানান, এখানে তার মতো ৪-৫ জন পল্লী চিকিৎসক রয়েছেন। যারা শুধু প্রাথমিক চিকিৎসাই দিতে পারেন। এখানে কাজ করতে এসে অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ¡াস হলে নিরাপদ স্থাপনায় থাকার মতো ব্যবস্থাও নেই। এছাড়া টেলিটক ছাড়া নেই অন্য কোনে মোবাইল কোম্পানির নেটওয়ার্ক। তবে এত প্রতিকূলতার পরও সেখানে ৩০ হাজারের মতো লোক প্রতিদিনই কাজ করছেন। গড়ে ওঠেছে দোকান, হোটেল, নৌকা সারাইয়ের দোকান ও লেদমেশিন কারখানা। নিউমার্কেটের লেদ কারখানার মালিক শেখ জাকিরুল হক বলেন, ৫ মাসে ইঞ্জিনচালিত নৌকার প্রায়ই সমস্যা হয়। অনেক সময় যন্ত্রাংশ ভেঙে যায়। তখন অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ থাকে না। এখানেই সারাই করেন তারা। জেনারেটর ও সোলার বিদ্যুতে তাদের কাজ চলে।
জেলে মন্টা বলেন, এখানেই তাদের সব প্রয়োজনীয় জিনিস মোটামুটি পাওয়া যায়। তবে সরকারি সহায়তা মিললে আরো ভালো কাটত এই ৫ মাস।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়