ক্র্যাবের ২ সদস্যকে হুমকি দেয়া পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার

আগের সংবাদ

গাপটিল-বাটলার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই

পরের সংবাদ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : বিপন্ন স্বদেশ

প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রীতি বাংলাদেশের জীবনের অঙ্গ বলেই জানতাম। এতদিন সেটাই বিশ্বাস করে এসেছি। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখা মানুষ। বালক বেলার সে সময়কাল আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এখন এ কথা বলতেই পারি পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক হলেও মানুষ ছিল অসাম্প্রদায়িক। তারা তখন বাঙালি হওয়ার সংগ্রামে ব্যস্ত। তখন পাড়ায় পাড়ায়-মহল্লায় একটা সেøাগান চোখে পড়ত, একটি বাংলা বর্ণ একজন বাঙালির জীবন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের এমন ধারাবাহিকতা আজ বিলুপ্ত। স্বাধীন দেশে আমরা বড় হয়েছিলাম নানা কষ্ট আর বেদনা নিয়ে। আমাদের আমলে না ছিল এত শান-শওকত, না এত সব সম্ভার। আমরা মোবাইল, ইন্টারনেট, ডিজিটাল যুগ দেখিনি। আমাদের সাধারণ খুব সাদামাটা জীবনে মানুষে মানুষে ছিল মায়া-মমতার অভিন্ন বন্ধন। আমাদের টাকা-পয়সার ঘাটতি ছিল বটে, ছিল না এত উচ্চাশা। এত খাই খাই ভাব ছিল না সমাজে।
অথচ আমাদের জীবন কেটেছে সেনা শাসনে। জিয়াউর রহমান অতঃপর এরশাদের মতো একনায়ক ছিল দেশ শাসনে। এরশাদ দেশ চালাতেন তার ব্যক্তিগত মর্জিমাফিক। তাই যখন তার যেটা দরকার সেটাই করতেন। আমাদের জীবনে উপদ্রব আর বন্ধ বাতায়নের জনক এরশাদকে হটাতে কত আন্দোলন আর কত ত্যাগ। আশা একটাই এদেশে গণতন্ত্র আসবে। যতটাই আসুক খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনার আমলে আমরা মোটামুটি একটা মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়ালাম এসে। কিছু বছর থেকে আমরা উন্নয়নের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি। শুনতে পাই এ নিয়ে অজস্র গল্প। সে গল্প আর ধারাবিবরণীতে বিশ্বাস করতে করতে মনে করেছি সত্যি দূর হয়ে গেছে যাবতীয় জঞ্জাল। এদেশে আর যাই হোক মৌলবাদের থাবা আর আমাদের কলঙ্কিত করতে পারবে না।
সে বিশ্বাস এবার নষ্ট হয়ে গেছে শারদীয় পূজা ঘিরে শয়তানের তাণ্ডবে। গত বছর করোনার জন্য ভালো করে পূজা করতে পারেনি হিন্দু জনগোষ্ঠী। এবারো সংশয় ছিল। করোনা যায়নি এখনো। ফলে লকডাউনের ভয়, বিধিনিষেধের কড়াকড়ি থাকতেই পারত। কিন্তু এবার তা ছিল না। আর সেটাকেই ভাগ্য বলে মেনে নিয়ে জাঁকজমকের সঙ্গে পূজা উদযাপনে মন দিয়েছিল হিন্দুরা। কিন্তু তিন দিনের মাথায় কুমিল্লার এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। ধরে নিয়েছিলাম এ আর এমন কি। এমন তো হয়ই। সরকার প্রশাসন আর জনগণ মিলে প্রতিহত করবে। এক-দুই ঘণ্টার ভেতর থেমে যাবে এদের তাণ্ডবলীলা। কিন্তু থামেনি। পরদিন আরো ব্যাপকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এরা। চৌমোহনী কুমিল্লাসহ দেশের বহু এলাকার পরিবেশ হয়ে উঠেছিল নারকীয়। আশ্রম, মন্দির, মঠের ব্যাপক ধ্বংসলীলা, নারীদের অত্যাচার, ধর্ষণ, লুটপাট কিছুই বাদ যায়নি।
সরকারের আন্তরিকতা বা আদেশ কোনোটাই গায়ে মাখেনি এরা। এত দিনের সম্প্রীতি আর বন্ধন এক নিমিষে ছারখার হয়ে গেছে। এখন যতই বলা হোক বিচ্ছিন্ন বা আলাদা ঘটনা আসলে তা সত্যি নয়। এরা ঘাপটি মেরে ছিল। শুক্রবার দিনটিকে বেছে নিয়েছিল যাতে সমবেত হয়ে একসঙ্গে হামলা করতে সুবিধা হয়। একের পর এক জেলায় আক্রমণের খতিয়ান আর কৌশল দেখলেই বোঝা যায় আক্রোশ কোথায়। এ লেখা যখন লিখছি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলে দিয়েছেন এসব আক্রমণের পেছনে নাকি বিএনপি ছিল। বিএনপির ইন্ধনে ঘটেছে এসব। এ ধরনের স্টেটমেন্ট একেবারেই অজানা বা আশ্চর্যজনক কিছু না। বাস্তবতা এটাও বলে দেয় বিরোধী দলগুলোর সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে, কিন্তু একতরফা এমন দোষারোপ কি সমস্যা সমাধানে সহায়ক? না এতে সমস্যার মূলে যাওয়া সম্ভব? বিএনপি বা উগ্রবাদীরা তো আওয়ামী লীগের ভাষ্য মতে মাজা ভাঙা। হাঁটু ভাঙা। তাদের তো সাইজ করা হয়েছে এ কথা সরকারই বলে। তাহলে এই শক্তি তারা পেল কোথায়? আর একটা বাস্তবতা ভুললে চলবে না। এখন দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল আছে? বা তাদের শক্তি আছে? সবই তো সরকারি দলের হাতে। তাদের কর্মী বা সমর্থকদের ছাড়া এমন কুকাজ কি আদৌ সম্ভব হতো?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এমন কুকর্মের সঙ্গে যখন সরকার ও দেশের ভাবমূর্তি জড়িত তখন কোথায় ছিল গোয়েন্দা সংস্থা? তারা কি জানত না? না জেনেও চেপে গেছে? প্রশ্ন কোথায় ছিল আওয়ামী বাহিনী? কোনো কোনো জায়গায় থেমে থেমে কয়েক দফায় হামলা হলেও কাউকে পাওয়া যায়নি প্রতিরোধে। চট্টগ্রামের মতো বৃহত্তম শহরের প্রাণকেন্দ্রে জে এম সেন হলে হামলায় এটা পরিষ্কার ওরা তৈরি হয়ে মাঠে নেমেছিল। আপনি ভালো করে দেখলেই বুঝবেন মোটিভ কী ছিল। শুধু মূর্তি টার্গেট হলে ওরা দোকানপাটে হামলা করত না। কেন ধর্ষণের শিকার হলো নারীরা। এ লেখা লেখার সময় জানলাম ১০ বছরের ধর্ষিতা মেয়েটি বাঁচেনি। প্রাণ হারিয়ে বেঁচে গেছে মেয়েটি। কিন্তু রেখে গেছে বিশাল এক প্রশ্ন।
কী সেই প্রশ্ন? আমরা কি মুক্তিযুদ্ধ আর আমাদের প্রার্থিত বাংলাদেশে আছি? তাও আওয়ামী লীগের আমলে? এক কথায় হ্যাঁ বলার সব সম্ভাবনা শেষ করে দিয়ে গেছে এ ঘটনা। পূজা উদযাপনে বাধা দেয়া আর হিন্দু নারী বালিকা ধর্ষণ কি এক? এই মেয়েটির আত্মার অভিশাপ আমাদের ছেড়ে কথা বলবে না। মূলত যেটা ঘটেছে যা হয়েছে তার পেছনে আজ দীর্ঘদিনের অপপ্রচার আর ওয়াজের ইন্ধন। এসব ওয়াজকারী সরকার ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সবসময় মনগড়া কথা বলে। এবং তা কুৎসিত কদর্য। হিন্দুদের বিরুদ্ধে এদের বয়ান শুনলে যে কোনো সুস্থ মানুষের মেজাজ খারাপ হতে বাধ্য। গা গুলিয়ে বমি আসবে সুধীজনের। কিন্তু আমরা যে আজ জাতিগতভাবে অন্ধ আর বধির। আমাদের এক কথা এক কীর্তন এক প্রশংসা। আর তার তলায় চাপা পড়ে গেছে চেতনা। মরে ভূত হয়ে গেছে বিবেক। কলঙ্ক হয়ে আছে সংস্কৃতি। সব জায়গায় এত মোসাহেবি আর এত দালালি যে কান পাতা দায়, চোখ মেলার উপায় নেই। আজ তার ফলাফল হাতে হাতে পেয়েছে স্বদেশ।
যে যেভাবে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুক স্বীকার করুক আর না করুক বাংলাদেশে ধর্মীয় সম্প্রীতি বা সহাবস্থান আর নেই। পাকিস্তান আমলেও যা ঘটত না তাই ঘটে গেছে দেশে। ইউটিউবসহ নানা মিডিয়ায় যেসব ভিডিও তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার তারুণ্য আজ বিভ্রান্তির চরমে। চরম সংকটে আছে বাঙালি। তাদের জীবনে এতটাই সমস্যা সে কি আদৌ বাঙালি থাকবে না থাকবে না? হিন্দুদের কথা বাদই দিলাম। এসব গিনিপিগকে কে মনে রাখে? ওরা এভাবেই বাঁচবে নয় মরবে। কিন্তু দেশ ও সমাজের বিকৃতি না সারালে আমরা যে পথে এগোচ্ছি তাতে রাষ্ট্র নিজেই সংকট এড়াতে পারবে না। মোসাহেবি বুদ্ধিবৃত্তি মানুক আর না মানুক মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আজ আবার বিপন্ন। এই বিপন্নতা থেকে মুক্তি কোথায়?
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়