ক্র্যাবের ২ সদস্যকে হুমকি দেয়া পুলিশ সদস্য প্রত্যাহার

আগের সংবাদ

গাপটিল-বাটলার শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই

পরের সংবাদ

গণপরিবহন কখন জনস্বার্থ দেখে না?

প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৯, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

গত বৃহস্পতিবার ৪ নভেম্বর বিপিসি ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গেই বেসরকারি গণপরিবহন সংস্থাগুলো একে একে ঘোষণা ছাড়াই চলাচল বন্ধ করে দেয়। বাস, লঞ্চ ও ট্রাক গুরুত্বপূর্ণ এই তিন সংস্থার বেসরকারি পরিবহন কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়া চলাচল বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণায় বিপাকে পড়ে সব ধরনের মানুষ, যারা এসব পরিবহনের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য। এটি কোনো ধর্মঘট হিসেবেও বেসরকারি মালিকরা স্বীকার করেনি আবার জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে সে কথাও তারা অস্বীকার করেনি। জনগণ কথাটি এদেশে অতি জনপ্রিয় এবং অতি ব্যবহৃত কথা, যার বাস্তবমূল্য কানাকড়িও নেই। এই জনগণ শব্দটির প্রতি দরদ কার নেই? সবাই জনদরদির পরাকাষ্ঠা হিসেবে নিজেকে শতভাগ আন্তরিক বলে দাবি করে থাকে। সেটি রাজনীতিবিদরাই শুধু করেন এমনটি নয়। অন্যরাও কম যায় না। বাস, ট্রাক ও লঞ্চ মালিক এবং কর্মচারী সমিতিগুলোও প্রথমে নিজেদের জনগণের অংশ দাবি করে পরেই ‘নিজেদের অস্তিত্বও বিপন্ন হওয়ার পর্যায়ে নেমে যাওয়ার কারণে বাধ্য হয়েই’ যার যার পরিবহন রাস্তায় না নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে দাবি করে থাকে। তারা এটিকে ধর্মঘট বলতে চায় না। ধর্মঘট কতগুলো নিয়ম অনুসরণ করেই ডাকা হয়ে থাকে।
মূলত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মালিক কর্মচারীদের দাবি নিয়ে আলোচনা যখন সফল হয় না তখন কেবল কোনো সংগঠন বা সমিতি জনগণকে গণমাধ্যমের মাধ্যমে তাদের যৌক্তিক অবস্থান জানিয়ে তারপরই ধর্মঘট আহ্বানের কথা বলে থাকে। জনগণ তখন পূর্ব থেকে অবহিত থাকে এবং ধর্মঘটের দায় কতটা তার ওপর এরও একটি প্রহণযোগ্য ধারণা পেয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকেই যারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে তারা এখন আর এসব নিয়ম ও আইনের তোয়াক্কা করে না। সেটিকে তারা ধর্মঘট হিসেবে স্বীকার না করেই পালন করার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করে থাকে। এতে জনসাধারণ দুর্ভোগে পড়েছে কি পড়েনি, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কি হয়নি, এমনকি রাষ্ট্রও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কি হয়নি সেটিও ভাবা হয় না, দেখাও হয় না। অনেক সময় জোরজবরদস্তি করেই অনেক সংগঠনের নানা ধরনের আকস্মিক ধর্মঘট পালিত হতে দেখা যায়। এর মাধ্যমে যে বিষয়টি প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে, কোনো সংগঠন বা সমিতি যতবেশি বিস্তৃত হয়, জনগণ ও রাষ্ট্র যতবেশি তাদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়, ততবেশি তারা তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়নে আইনবহির্ভূত উপায় কার্যকর করার চেষ্টা করে থাকে।
এটি করতে পারার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্র ও সমাজ যখন মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দেশকে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তখন মুক্তবাজার অর্থনীতির আইন, নিয়মকানুন, বিধিবিধান ইত্যাদিতে আগে প্রণয়ন ও কার্যকর করার ব্যবস্থা না করে যদি তাকেই যা খুশি তা করার সুযোগ দিয়ে থাকে তারপর তার লেজ আর টেনে ধরার শক্তি রাষ্ট্রের সক্ষমতায় থাকে না। অনেক সময় আমরা বলতে শুনি, রাষ্ট্র অসীম ক্ষমতাধর, যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এটি সবসময় সর্বক্ষেত্রে সত্য এমনটি যেমন নয়, আবার একেবারে পুরোপুরি অসত্য তাও নয়। এখানে মাঝামাঝি একটি অবস্থা রয়েছে সেটি আমাদের বুঝতে হবে। রাষ্ট্র যদি হয় কোনো রাজতান্ত্রিক অথবা একক কর্তৃত্ববাদী তাহলে সেটি এক ধরনের কার্যকারিতার প্রমাণ রাখে। আবার রাষ্ট্রটি যদি হয় আমাদের মতো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা, সাংস্কৃতিকভাবে কেবলই অগ্রসর হওয়ার পথে পা বাড়ানোর, তাহলে সেখানে রাষ্ট্র ও সরকারকে সবকিছু পূর্বাপর ভেবেচিন্তে, আইন বিধিবিধান, পরিকল্পনা ইত্যাদিকে রাষ্ট্রীয় সংস্থার হাতে রেখে নিয়মনীতিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির মতো একটি আধুনিক, আর্থ-সামাজিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হওয়ার পথে বড় ধরনের কোনো সংকটে পড়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু তা না করে যখন আগেভাগে বেসরকারিভাবে সবকিছুকে করতে দেয়া হয় তখন সেটি প্রয়োজনীয় বিধিবিধানকেই তোয়াক্কা না করে সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তার শুরু করে দেয়। রাষ্ট্র তখন যত জনস্বার্থমুখী আইনই প্রণয়ন করার চেষ্টা করুক না কেন এসব বেসরকারি সংস্থার টিকিটিও ধরার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারে না। কেন না অর্থনৈতিকভাবে কোনো সংগঠন যত বেশি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে, তত বেশি সেটি সরকারকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়, সরকারও ওইসব সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তাদের হাত থেকে রক্ষা না করার কোনো অবস্থানে যেতে সাহস পায় না। আবার সরকার নিজে থেকেও ওইসব সংগঠনকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেও থাকে। এটি নামে মুক্তবাজার অর্থনীতির রাষ্ট্র হলেও বাস্তবে কিন্তু লুটপাট, দুর্নীতি, নৈরাজ্য ইত্যাদির ওপর ভর করেই পরিচালিত হয়। সে কারণেই মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে উন্মুক্ত ক্ষমতা ব্যবহারের আধিক্য ঘটে। দুনিয়ার উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোতে এমনটি খুব একটা ঘটে না। কারণ ওইসব রাষ্ট্রে মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়মকানুন ও বিধিবিধান বেশ কড়াকড়িভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিপালিত হতে দেখা যায়। তবে বহুজাতিক সংস্থা, করপোরেট সংস্থার কর্তৃত্ব সেসব রাষ্ট্রেও নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কিন্তু বেশকিছু আইনি বিধিবিধানকে অনুসরণ করেই ওইসব কর্তৃত্বশীল প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখে। সেক্ষেত্রে কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থাই চূড়ান্তভাবে জনস্বার্থকে কার্যকর করার নীতি অনুসরণ করছে এমনটি বাস্তবে খুঁজে পাওয়া কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কিন্তু তারপরও বলতে হবে।
আধুনিক উন্নত রাষ্ট্রগুলো মুক্তবাজার অর্থনীতিকে একেবারে আইন, বিধিবিধানবহির্ভূতভাবে চলার সুযোগ দেয় না, যেখানে রাশ টেনে ধরা প্রয়োজন সেটি তারা করতে পারে। কারণ আগে থেকেই তারা মুক্তবাজার অর্থনীতির আইন, বিধিবিধান কার্যকর করার মাধ্যমে বেসরকারি ছোট, বড় ও মাঝারি সব খাত ও উদ্যোগকে পরিচালিত হওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে। আমাদের এখানে আগে উদ্যোগের অনুমতি এবং বিধিবিধানের চেষ্টার পরিণতি সর্বক্ষেত্রে আমরা কয়েক দশক ধরে দেখে আসছি। এখন এর সুফল ও কুফল জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এর থেকে মুক্ত হওয়া আদৌও সম্ভব হবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও সমিতির প্রভাব রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহন, শিক্ষাসহ সর্বক্ষেত্রে কতটা অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলে যাচ্ছে সেটি খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে। এর পরিণতি যে একসময় ভয়ানক নৈরাজ্য রাষ্ট্র ও সমাজে ডেকে আনবে না যা নিয়ন্ত্রণ করতে রাষ্ট্র ও সরকার কোনোভাবেই সফল হবে না- এটিও আশঙ্কার বাইরে নয়।
তিন খাতের পরিবহন সংস্থা শুক্র, শনি, রবিবার তিন দিন গোটা দেশকে কতটা জিম্মি করে ফেলেছিল সেটি সবাই দেখতে পেরেছে। মানুষের দুর্ভোগ, চলাচলের স্থবিরতা, আবার পরিবহনের নামে রাইড শেয়ারিং, ব্যক্তিগত পরিবহন, সিএনজি ইচ্ছামতো মানুষের অসহায়ত্বকে নিজেদের স্বার্থে অপব্যবহার করেছে। ১০০ টাকার ভাড়া ১,০০০-১,৫০০ টাকা হাঁকিয়ে তিন দিন রাজত্ব করেছে। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করারও কোনো উপায় কারো ছিল না। সুতরাং শুধু পরিবহন সমিতিগুলোই নয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক পরিবহনগুলোও করোনাকালে, আবার এই তিন দিনে কীভাবে সুযোগের অপব্যবহার করেছে সেটিও গভীরভাবে ভাববার বিষয়। অবশেষে বিআরটিএর সঙ্গে বাস মালিক সমিতির নেতারা আলোচনা করে ভাড়া বাড়িয়ে তাদের ‘অঘোষিত ধর্মঘট’ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। লঞ্চ, স্টিমারগুলোও একইভাবে ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে। ট্রাক মালিক সমিতি এই লেখা প্রস্তুতের সময় পর্যন্ত তাদের দাবিতে অনড় থাকার সিদ্ধান্তে রয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। এসব পরিবহন মালিক সমিতির নানা যুক্তি ও অজুহাত গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও সাধারণ মানুষ তাদের সেসব কথায় মোটেও আস্থা স্থাপন করেন বলে মনে হয় না। মালিকদের জনগণের প্রতি কোনো রকম দায়বদ্ধতা থাকলে সব পরিবহন খাত বন্ধ করে না দিয়েও সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করা যেত। সরকার তো জানেই যে এরা যা চাচ্ছে তার সমাধান না হলে তারা কী করবে, এর ফলে দেশে যে নৈরাজ্য তৈরি হবে সেটি সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে মোটেও সম্ভব হবে না। সরকারি দলের অনেক নেতাই এখন এসব পরিবহন খাতের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত, সমিতিগুলো তাদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এসব নেতা কতটা সরকারি দলকে সহযোগিতা করে নাকি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও প্রভাব বিস্তারে রয়েছে সেটিও বুঝার জন্য কাউকে বড় ধরনের বিশ্লেষক হতে হবে না। আদর্শের চর্চা তাদের কতটা মুখে শোনা যায়, আবার কতটা বাস্তবে দেখা যায় সেটিও কারো অজানা নয়। সুতরাং গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির পেছনে অজুহাত কতটা কালো হাতের কাজ হয়েছে সেটিও বুঝতে বাকি থাকল না। মধ্যখানে তিন দিন মানুষের দুর্ভোগ ও পকেট কাটার মহোৎসব ঘটানো হয়েছে। এখন ভাড়া বৃদ্ধি করে পরিবহন মালিকরা সন্তুষ্ট থাকলেই জনসাধারণের চলাচলটা কিছুটা নির্বিঘœ হতে পারে। ট্রাক মালিকরা কবে সন্তুষ্ট হবেন তার ওপর নির্ভর করবে কবে পণ্য সরবরাহ নির্বিঘœ হবে। বাজার কতটা স্থিতিশীল হবে সেটি অবশ্য নির্ভর করছে অন্য ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের ওপর। সেখানে ক্রেতা সাধারণ যে ভালো নেই, ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের ভালো রাখেননি সেটিও নতুন করে বলার অবস্থানে নেই। আমরা অপেক্ষায় আছি কবে জনস্বার্থে রাষ্ট্র, সমাজ ও সব ধরনের প্রতিষ্ঠান চলার বিধিনিষেধ অনুসরণ করবে?
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়