ভ্রমণ ভিসায় ৫০০ জনকে দুবাই পাচার, গ্রেপ্তার ৮

আগের সংবাদ

কপ-২৬ : জলবায়ু বিপর্যয় রোধ > গরিব দেশগুলোকে ২৯ কোটি পাউন্ড দেবে ব্রিটেন

পরের সংবাদ

অপু এলো ঢাকা

প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

আজ অপু এসেছে পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। বিভূতি ভূষণ, সত্যজিৎ, সৌমিত্র এখন এমন প্রান্তরে উড়ে উড়ে দূরে দূরে কোথায় আছেন জানি না। শর্মিলী ঠাকুর মাত্র ১৩ বছর বয়সে চলচ্চিত্রের তরুণ অপুর বধূ হয়ে চলচ্চিত্র ভুবনে পদচিহ্ন রেখে আজো প্রাসঙ্গিক আছেন। তিনি বেঁচে আছেন। বালক অপু ৬ নভেম্বর দুপুর ১২টার দিকে ঢাকায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছেছেন। নিয়ে এসেছেন তার জননী সর্বজয়া, যার বর্তমান নাম নাজমা। শর্মিলীকে যদি ডিজিটাল প্রযুক্তিতেও খবরটা জানানো যেত। জীবনের কত রং, জীবনের কত বেরং। সর্বশেষ উক্ত অপুর বয়স চার বছর প্লাস।
এবার কিঞ্চিৎ নিজের কথা বলি। যদি আমাকে বলা হয়, মর্ত্য জীবনে তুমি শুধু একটি উপন্যাস পড়ার জন্য অনুমতি পেয়েছ, কোনটি পড়বে। আমি তৎক্ষণাৎ তিনের ভিতর এক ‘পথের পাঁচালী’ ত্রয়ীজোট উপন্যাসটির নাম বলব। গ্রামে ছিলাম দশ বছর। বিভূতি ভূষণ যা নিজের অভিজ্ঞতায় লিখেছেন, তার অনেক কিছুই আমার গ্রামবেলাতেও ছিল। গ্রামস্মৃতি আমার তেমন মনে নেই। বিদ্যালয় না পেরুতেই বিপ্লবের স্বপ্ন আমাকে উথাল-পাথাল করে দিয়েছে। সংগঠনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি রচনা এবং পত্রিকা অফিসে পাঠাবার দায়িত্ব গল্প-উপন্যাস পড়ার চেয়ে অনেক প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান জ্ঞান করেছি।
আসলে আমি বকলম না হলেও মূর্খতার ব্যাপারি, পত্রিকার শিরোনাম পড়া সাধারণ জ্ঞানের চটুলতায় জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। এর মাঝেও যে বিভূতি আর সত্যজিতের যৌথ আলো আমাকে অন্ধকারেও উজ্জীবিত রেখেছে, সে পরম দুর্লভ সৌভাগ্য। আজ আমি একালের, আজকের অপুর কথা বলে ওই মহান শিল্পীদ্বয়ের স্নেহাশিস ভিক্ষার্থী।
বিভূতি দেখেননি খাজুরিয়া গ্রামটি, আমাদের ময়মনসিংহ নামটি তো নিশ্চয়ই জানতেন। ময়মনসিংহ এখন অনেক অরণ্যাংশ কেটে বড় শহর হয়েছে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এখন ছয়টি জেলায় বিভক্ত। ময়মনসিংহ জেলাধীন ফুলবাড়িয়া উপজেলার খাজুরিয়া গ্রামটি টিলায় টিলায় ঢেউ খেলানো। আরেক পাশে মুক্তাগাছা উপজেলা। বলা যায় দুই উপজেলায় সমতল ও অরণ্যপ্রান্তরের ছোট আত্মীয় হিসেবে ওই টিলাময় ছিটমহল। খাজুরিয়া গ্রামে পুকুর নেই।
সর্বজয়া মানে নাজমার জন্মবাড়ি কাছেই। অল্পবয়সেই তার অভিভাবকদের সবিশেষ আগ্রহে তার বিয়ে হলো এমন একজনের সঙ্গে যিনি ১৪ বছর ধরে তার প্রথম বউকে ছেড়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয় বউ নাজমা পৃথিবীকে দুটি সন্তান উপহার দিলেন। বড় মেয়ে তাইয়েবা মানে উপন্যাসের সেই দুর্গা। আর ছোট ছেলে তামিম মানে আমাদের বাংলাবন্দিত চরিত্র অপু। এরই মাঝে হঠাৎ নাজমার সতিনকে নিয়ে পুনরায় ঘর শুরু করল নতুন বাড়িতে। সতিনের দুই সন্তানকে নাজমার শাশুড়ি মূলত লালন-পালন করত। ওরা বাপ-মার সঙ্গে পুনরায় মিলিত হতে নতুন বাড়িতে চলে গেল। তার শাশুড়িই তাইয়েবা, তামিম তথা অপু-দুর্গাকে লালন-পালন করতে থাকেন। নাজমা খরচের কিছু অর্থ জোগান দিত। দাদিই এখন অপু-দুর্গার মাতৃসম।
এমনি পটভূমিতে সর্বজয়ার আগমন পাহাড়ি মেয়ে নাজমার রূপে। কাজ করে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো অবিরাম, অবিরল। আমরা মানবিক-মানবিক ভাবধারীরা ওদের গৃহকর্তা-সহযোগী, সহায়ক-সহায়িকা ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করলেও কার্যত এরা গৃহদাসী হিসেবেই গণ্য হয়ে থাকে। শ্রেণি-রূপান্তর বড়ই কঠিন। অর্থ সম্পদে দুর্বলরা সবলদের শ্রেণিতে উন্নীত হওয়া এক প্রকার অসম্ভব। ১৯৮৪ সালের লিপইয়ারের ৩১ মার্চ প্রায় মধ্যরাতে অধুনালুপ্ত আদমজী জুট মিলে পরদিন স্বৈরাচারী এরশাদশাহীর বিরুদ্ধে ঘোষিত হরতালের পিকেটিং করছিলেন একজন শ্রেণি রূপান্তরিত উচ্চশিক্ষিত মেধাবী বিপ্লবী তাজুল ইসলাম। নিজের সম্পন্ন পরিবার ফেলে আদমজী শ্রমিক বস্তিতে শ্রমিকের মতো হয়ে জীবনযাপান করে, শ্রমিকের পেশা বেছে নিয়েছিলেন। আদমজী জুট মিলের সিন্ডিকেট শ্রমিক নেতৃত্ব এই রূপান্তরিত শ্রেণি বন্ধুকে মেনে নিতে পারেনি। যতটুকু জানি নিজ দলের পুরনো নেতারা প্রধান শ্রমিক দলের নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশেই পিকেটিংরত তাজুলকে মাথায় আঘাত করে হত্যা করে। উপর থেকে নিচে নয়, নিচে থেকে উপরে শ্রেণি রূপান্তর হতে পারে। যেমন আজকাল শহরে-গ্রামে গৃহকর্মীর কাজে লোক পওয়া দুষ্কর। গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের কথা স্বীকার করতে আমাদের অর্থনীতি ও রাজনীতির ভুবনের বাঘা বাঘা জ্ঞানীরা এ কথা স্বীকার করতে মুক্তবিবেক হতে পারছেন না। এই সর্বজয়া তথা নাজমাকে ঢাকায় আমাদের নিবাসে পেতে গোটা বাংলাদেশে ডিজিটালি চষে বেড়িয়েছি। ওরা আর রদ্দা শ্রম দিতে রাজি নয়।
সেই নাজমা হাতের কাজ দ্রুত শেষ করতে অসাধারণ দক্ষ। পাহাড়ি মেয়ে দুপদাপ। এ বছর জুলাইয়ের শেষে গভীর কোভিডে আমার যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ, সে সময়ে হাসপাতালে নিয়মিত খাবার, কাপড়-চোপড় সরবরাহে নাজমা মানবিক দ্রুততায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। যেদিন আমি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল ছেড়ে ঘরে আসব শুনলাম এক মর্মান্তিক সংবাদ, নাজমার সাত বছরের মেয়েটি খাজুরিয়া গ্রামে প্রবল বৃষ্টিতে টিলার খাঁজে আটকে প্রাণ হারিয়েছে। টিলাময় গ্রামে পুকুর নেই। অতএব তাইয়েবা পাকালে আটকে প্রাণ হারিয়েছে।
হাসপাতালের বেডে থাকতেই আমার মনে হলো দুর্গা-অপুর কাহিনী, অপু তার দুর্গা আপুকে কেমন করে আর পাবে! পথের পাঁচালীর মূল কাহিনী ও চলচ্চিত্রে দেখেছিলাম একদিনেই ছোট অপু কেমন স্বনির্ভর হয়ে উঠেছে। দুর্গার একটি অপরাধের চিহ্ন মুছে দিতে কেমন করে পুকুরে ফেলে দিল দুর্গার চুরি করা দ্রব্যটি সবার অজান্তে। খাজুরিয়ার অপু-দুর্গার বেলায় তেমন গল্প নাও গড়ে উঠতে পারে।
অপুকে শাশুড়ির কাছে রেখে সর্বজয়া চলে এলো তার কর্মনিবাস ঢাকায় আমাদের গৃহে দাসী হিসেবেই। কী আশ্চর্য আমরা ঘরের সবাই যখন ওর ফিরে আসার মুহূর্তটির কথা ভেবে দুরু দুরু শঙ্কিত তখন সে প্রবেশ করল হাসিমুখে। গ্রামের তাজা শাকসবজি ইত্যাদি উপহার হিসেবে সঙ্গে। এসেই দুপদাপ কাজ শুরু।
সর্বজয়ারা সবকিছু জয় করতে পারে। ভেবে নিলাম ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রতিদিন তার সন্তান ও শাশুড়ির সঙ্গে সংযোগ বজায় রাখে। গত সপ্তাহে প্রায় দেড় মাস পর সর্বজয়া নাজমা বাড়ি গেল। ফেরার সময় অপু, মানে তামিমকে নিয়ে এখন সে ঢাকায় আমাদের বাসায়। গ্রাম-শহরের নিঃসীম এবং সীমাবদ্ধ ভুবনের বিপরীতমুখী ঢেউয়ে অপু এখন সারাক্ষণ মায়ের আঙুল ধরে ধরে। মহানগর বাংলা অপুকে ঠাঁই দেবে কী?
দুর্গা নেই। সর্বজয়া অপুকে নিয়ে ধুপধাপ পাহাড়ি ছন্দে জয় করুক সব উথাল-পাথাল।

হিলাল ফয়েজী : মুক্তিযোদ্ধা ও রম্যলেখক।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়