ভ্রমণ ভিসায় ৫০০ জনকে দুবাই পাচার, গ্রেপ্তার ৮

আগের সংবাদ

কপ-২৬ : জলবায়ু বিপর্যয় রোধ > গরিব দেশগুলোকে ২৯ কোটি পাউন্ড দেবে ব্রিটেন

পরের সংবাদ

অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ-মাতৃমৃত্যু বেড়েছে

প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৮, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

সেবিকা দেবনাথ : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে নিপা দাস যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তখন তার বয়স ১৬। বর সজল দাস (২২) ব্রুনাই প্রবাসী। দেশে এসে করোনার কারণে আটকা পড়েন। দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয়। বিয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায় গর্ভবতী হন নিপা। কিন্তু তারা দুজনের কেউই এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা আসুক তা চায়নি। এদিকে গর্ভবতী হওয়ার পর থেকেই নিপার কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। চিকিৎসকের কাছে গেলে বেশ কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করে এই দম্পতিকে চিকিৎসক জানান, ১৮ বছর পূর্ণ হবার আগে মা হলে মা ও শিশু উভয়ের জন্যই তা বিপজ্জনক। এ সময় সন্তান নিলে সন্তান মায়ের শরীর থেকে সঠিক পুষ্টি পায় না, ফলে মা ও শিশু দুজনই অপুষ্টির শিকার হন।
নাজমা বেগমের বিষয়টি অবশ্য ভিন্ন। কোলের সন্তানের বয়স ১০ মাসের মাথায় আবার গর্ভবতী হয়েছেন নাজমা। প্রথম সন্তানটা সিজারের পর সেই ধাক্কাটা সামলে ওঠার আগে আবার গর্ভবতী হওয়ায় মুষড়ে পড়েছেন নাজমা। এত তাড়াতাড়ি আরেকটা সন্তান নেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এই দম্পতি। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের বক্তব্য হলো; দুই সন্তানের জন্মের মধ্যে ব্যবধান ৩ বছরের বেশি হলে শিশু মৃত্যুর ঝুঁঁকি প্রায় ৫০ ভাগ কমে যায়।
নিপা ও নাজমার মতো অনেকে অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের শিকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের মোট গর্ভধারণের এক-তৃতীয়াংশই অনিচ্ছাকৃত ও অপরিকল্পিত। বিবাহিত কিশোরী-তরুণীদের অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের হার ৫৩ শতাংশ। সময়মতো হাতের কাছে পরিবার পরিকল্পনার উপকরণ না পাওয়া এবং এসব পদ্ধতি গ্রহণে আগ্রহের অভাবেই অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের হার বাড়ছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করে মাতৃমৃত্যুও ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমানো সম্ভব।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মহামারি অবস্থার পরপরই গর্ভধারণ, সন্তান প্রসবের সংখ্যা এবং অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ ও অনিরাপদ গর্ভপাতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়েছে যা একটি সাধারণ প্রবণতা। কোভিড-১৯ সংক্রমণের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। বাল্যবিয়ে, অপরিকল্পিত গর্ভধারণ, বাড়িতে সন্তান প্রসব এবং মাতৃমৃত্যুর মতো স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্যই মিলেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জন্য মাতৃমৃত্যু হার, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে অপূর্ণ চাহিদা ও বাল্যবিয়ে শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার শূন্যের কোঠায় নামাতে হলে গর্ভধারণ ও জন্মদান নিরাপদ হতে হবে। ২০৩০ সাল নাগাদ জন্মনিয়ন্ত্রণে কাক্সিক্ষত সাফল্য, মাতৃমৃত্যু হার কমানো, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু

করোনাকালে বিশ্বে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। দেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ আর ২২ শতাংশ মেয়ের ১৫ বছরের আগে বিয়ে হয়। বাল্যবিয়েতে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। কিন্তু করোনা মহামারির মধ্যে দেশে ১৩ শতাংশ বাল্যবিয়ে বেড়েছে। যা বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
গবেষণা ও তথ্য যা বলছে : ২০২০ সালের জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ১১৪টি দেশে প্রায় ৪ কোটি ৭০ লাখ নারী আধুনিক গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। চলতি বছরে জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্য বলছে, দেশে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজারের বেশি শিশু জন্ম নিতো সেখানে ২০২১ সালের প্রথম দিনই জন্ম হয়েছে ৯ হাজারের বেশি শিশুর। হাতের কাছে পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং পর্যাপ্ত তথ্য সঠিকভাবে না পাওয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, কোভিডের নানামুখী প্রভাবে ২০২০ সালে প্রায় ২ লাখ ২৮ হাজার শিশুমৃত্যু এবং ১১ হাজার মাতৃমৃত্যু হয়েছে। করোনার চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যসেবা, প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা চরম ব্যাহত হয়েছে। ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার ৬টি জনবহুল দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কায় করোনার কারণে আশঙ্কাজকনহারে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া এবং স্কুল বন্ধ থাকায় ৪ লাখ ২০ হাজার শিশুর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় বাল্যবিয়ে হয়। যার ফলে অতিরিক্ত ৩ দশমিক ৫ লাখ শিশু গর্ভবতী হয়েছে।
অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ ও মাতৃমৃত্যু রোধে সরকারের উদ্যোগ : দেশে প্রতি ১ লাখে শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৬৫ জন মায়ের মৃত্যু হচ্ছে। এসব মৃত্যুর অন্যতম কারণ প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ। প্রতিবছর যত মাতৃমৃত্যু ঘটে, তার ৩১ শতাংশের পেছনে আছে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ। আর ২৪ শতাংশের মৃত্যু হয় খিঁচুনিতে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এর মধ্যে আছে, জরুরি প্রসূতি সেবা কার্যক্রম; ডিমান্ড সাইড ফিন্যান্সিং (ডিএসএফ) মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম, কমিউনিটি স্কিলড বার্থ এটেনডেন্ট প্রশিক্ষণ, প্রসবোত্তর রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ কর্মসূচি; মাঠপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের রক্তক্ষরণের কারণে মাতৃমৃত্যু রোধ কার্যক্রম; মাসিক নিয়মিতকরণ ও গর্ভপাত-পরবর্তী সমন্বিত সেবা; অবসটেট্রিক্যাল ফিস্টুলা রিপেয়ার কার্যক্রম। একই ধরনের কার্যক্রম পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকেও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার না করলে সাংসারিক জীবনের এক বছরের মাথায় ৮৫ শতাংশ নারী গর্ভবতী হয়ে পরে যার অধিকাংশই অনাকাক্সিক্ষত। এদিকে করোনা অতিমারির এই সময়ে পরিবার পরিকল্পনা সেবা বাধাগ্রস্ত হয়েছে বলে স্বীকার করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষ গর্ভধারণ প্রতিরোধে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ‘সুখী পরিবার’ নামক কল সেন্টার ১৬৭৬৭ নাম্বারে কল করে সরাসরি ডাক্তারের কাছ থেকে সেবা গ্রহণে প্রান্তিক নারীদের আগ্রহী করে তুলতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : প্রজনন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. হালিদা হানম আখতার ভোরের কাগজকে বলেন, সব ধরনের সমীক্ষাতেই দেখা যায়, দেশে স্বাভাবিক সময়েও অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারনের সংখ্যা বেশি। করোনাকালে তা বেড়েছে। অনাকক্সিক্ষত গর্ভধারনের কারণ হলো; তথ্যের অভাব এবং গর্ভ নিরোধের জন্য সময়মতো যে সামগ্রী দরকার তা না পাওয়া। এ ছাড়া মাসিক নিয়মিতকরণের সেবা কমে যাওয়া। বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যুর যে জরিপ তাতে দেখা গেছে, ২০১০ সালে গর্ভপাতের জন্য মাতৃমৃত্যুর হার ছিল ১ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৭ শতাংশ হয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ ছাড়াও মাসিক নিয়মিতকরণের কারণে মাতৃমৃত্যু ও মোট প্রজননহার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট) কমেছে ৩৫ শতাংশ।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক ডা. নুরুন নাহার ভোরের কাগজকে বলেন, সার্বিকভাবে ১২ শতাংশ আর কিশোর দম্পতিদের মাঝে অপূর্ণ চাহিদার হার ১৭ শতাংশ। করোনাকালে স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা দেয়ার কার্যক্রম কিছুটা বিঘিœত হয়েছে। তবে এ নিয়ে এখনো পর্যন্ত কোনো জরিপ বা গবেষণা করা হয়নি। পর্যাপ্ত তথ্য ছাড়া হঠাৎ করে কিছু বলা যাবে না। আমরা এখন যে তথ্যগুলো বলছি তা বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭ সালের। এই রিপোর্ট ২০১৭ সালে প্রকাশিত হলেও তা ২০১৪ সালের সংগৃহীত তথ্য। এরপর আর কোনো জরিপ হয়নি। আমাদের চিকিৎসক, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফডব্লিউভি), পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) সংকট রয়েছে। গত দুই বছরে এসব পদে কোনো নিয়োগ হয়নি। ফলে কার্যক্রম কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে তা বলা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, বাংলাদেশে প্রথমবার গর্ভধারণ করা অধিকাংশ মা-ই কিশোরী। প্রসবকালীন ঠিক সময়ে হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়ায় দেশে মাতৃমৃত্যুর ৫৪ শতাংশ ঘটে বাড়িতে। করোনাকালে মায়েদের সেবাকেন্দ্রে যাবার প্রতিবন্ধকতা আরো বাড়ে। পরিবার ও সন্তানের বাবার সহযোগিতা ছাড়া এই সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন। মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য আমাদের এখন এক সামাজিক যুদ্ধে নামতে হবে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক কাজী মহিউল ইসলাম মনে করেন, বর্তমান সময় বিবেচনায় পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান উন্নয়নে আ্যপভিত্তিক সেবার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। মোবাইলের ব্যবহার বাড়িয়ে ডিজিটাল সেবায় দক্ষ করতে হবে সেবা গ্রহীতা ও সেবা দানকারী উভয় পক্ষকেই। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণে পুরুষদের অংশগ্রহণ কম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পুরুষদের আমরা এই কার্যক্রমে কম সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, যদি ১০টি পদ্ধতি থাকে তাহলে সেখানে পুরুষদের জন্য আছে মাত্র দুটি। পদ্ধতি কম থাকায় তাদের অংশগ্রহণও কম।
পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি জনপ্রিয় করতে সারা বিশ্বেই সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এসএমসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তসলিম উদ্দিন খান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সরকারের পাশাপাশি পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রি বিপণন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিগুলোও ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে ৬০ লাখ দম্পতি আমাদের পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানিগুলো ৩৬ শতাংশ আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সরবরাহ করে। ৪৭ শতাংশ খাবার বড়ি, কনডমের প্রায় ৬০ শতাংশ, ৩০ শতাংশ ইনজেকটেবল পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করছে এই কোম্পানিগুলো।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়