এএসপি আনিসুল হত্যা মামলার আসামির মৃত্যু

আগের সংবাদ

ভাড়া বাড়ানো কতটা যৌক্তিক

পরের সংবাদ

হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়েছে

প্রকাশিত: নভেম্বর ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ
আপডেট: নভেম্বর ৭, ২০২১ , ১২:০০ পূর্বাহ্ণ

পশ্চিমবঙ্গে একটি দুর্গাপূজার প্রচার করা হয় বেশি বেশি করে। সেখানকার মিডিয়া বারবার ছুটে যায় সেই মণ্ডপে খবর সংগ্রহের আশায়। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার খিদিরপুর বড়ামহল্লার দুর্গাপূজা। উদ্যোক্তা ফাইভ স্টার ক্লাব। এ পূজার পুরোহিত হচ্ছেন শাহিদ আলী। নিখুঁতভাবে সব আচার-আচরণ মেনে পৌরহিত্য করেন তিনি। শুধু তিনিই নন, ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত পুরো বড়ামহল্লাই মেনে চলে সব আচার-আচরণ। ষষ্ঠীতে সন্তানের কল্যাণে ব্রতপালন, অষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলি, ভোগ খাওয়াসহ পূজার সব আচার-আয়োজন এবং আনন্দের উপকরণ সবই বিন্যস্ত থাকে ঘরে ঘরে। যে অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় উদযাপন শাহিদ আলীর পৌরহিত্যে, তা তার উত্তরাধিকার থেকে পাওয়া। শাহিদ আলীর বাবা একই পূজার পুরোহিতের সহকারী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই পূজার মণ্ডপে ঘোরাফেরা, পূজার কাজ শেখা শাহিদের জীবনের অংশ ছিল। তাতে তার ধর্মীয় পরিচয় বিস্ময়করভাবে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো। তাদের প্রতিমার কাজটি পান স্বর্ণ চিত্রকর। আসল নাম রূপবান বেগম। এমন আরো কিছু চিত্রকর আছেন সেখানে। যেমন কার্তিক চিত্রকরের আসল নাম শেখ কাদের, অমর চিত্রকরের নাম শেখ ওমর। সবাই তারা দুর্গাপূজার কারিগর।
খিদিরপুরের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় ১৭৫৬ সালের কলকাতার দুর্গাপূজার ইতিহাস। কলকাতা দখল করেছিলেন সিরাজউদ্দৌলা, নাম রেখেছিলেন আলিনগর। তারপর যুদ্ধ হয়েছিল রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে। বাংলার শেষ নবাবকে চক্রান্ত করে হারিয়ে দেয়ার ইতিহাসের এক আপাত ধারণার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবার্ট ক্লাইভের নাম। সবেমাত্র ক্লাইভ পরাজিত করেছেন সিরাজউদ্দৌলাকে, বিতারিত করেছেন কলকাতা থেকে। কিন্তু ক্লাইভের মন উচাটন। কোনো প্রার্থনাগৃহে গিয়ে সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করতে চান তিনি। তৎকালীন কলকাতার ফোর্ড উইলিয়াম অঞ্চলের যে একটি মাত্র গির্জা, তা যুদ্ধকালীন সময়ে ভাঙা পড়েছিল সিরাজউদ্দৌলার সেনাদের হাতে। এ সময় ক্লাইভের এক বাঙালি সহকারী তার বাড়ির দুর্গাপূজায় যাওয়ার জন্য ক্লাইভকে আমন্ত্রণ জানান। ক্লাইভ তা রক্ষাও করেন। তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, তখন শুধু ক্লাইভই নন, ভারতবর্ষের মুসলিম নবাবরাও উপস্থিত থাকতেন এবং দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ করতেন।
রামায়ণে এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে, ফলমূল-শাকসবজিসহ শস্যদেবী রূপে দেবী দুর্গা পূজিত হন। দুর্গাপূজার অর্চনা সেই প্রেরণারই জীবন্ত প্রতিমা। সুকুমার সেন তার ‘পূজার পাচালী’ নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশ বা পাশের দেশের রাজ্যগুলো চিরকালই ধ্যান্যোপজীবী। আজ থেকে ১ হাজার কিংবা দেড় হাজার বছর আগে, এদেশে ফসলের দেবী যিনি ছিলেন, তিনিই আসলে দুর্গাদেবী।’ এই দুর্গার একটি গল্প শুনেছিলাম কোনো এক দিদিমণির কাছে। অসুর বধ করে দুর্গাদেবী কৈলাসের দিকে পা বাড়াচ্ছেন, কানে এলো বাচ্চার কান্না। ফিরে দেখেন, মহিষাসুরের ছোট ছেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলছে- ‘তুমি দুষ্টু দেবী। আমার বাবাকে মেরে ফেললে, এখন আমার কী হবে?’ দেবী বললেন- ‘দেখো, তোমার বাবা তো অনেক অপরাধ করেছিলেন, তাই এমনটা তার লিখনে ছিল। কিন্তু তুমি তো ভালো ছেলে, তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি আমার কাছে থাকবে, আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্কুলে যাবে; তারপর বড় হলে পূজার সময় কার্তিকের পাশে তরবারি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।’ গল্পটি লিখেছিল দুরারোগ্য ব্যাধিগ্রস্ত ১১ বছরের একটি মেয়ে। সে তার দ্বাদশ জন্মদিন দেখে যেতে পারেনি। আবছা ভবিষ্যৎ নিয়ে যত ভয়-দ্বিধা, আশ্রয়ের অস্ফুট আকাক্সক্ষা- সবটাই সে কল্পনায় দেবীর কোলে সঁপে দিয়েছে, আশা-ভরসার কাল্পনিক সংস্থান করে নিয়েছে। এটা ভক্তি নয়, সরল আস্থা- মায়ের প্রতি শিশুর সহজাত আস্থার মতো।
পূজামণ্ডপ ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় আমরা ক্ষুব্ধ, ব্যথিত, লজ্জিত। শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যথার্থই বলেছেন- ‘যারা উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে, তারা আদৌ কোনো ধর্মীয় কাজ করছে না। ধার্মিক হিন্দু কখনোই তার মন্দিরে কুরআন শরিফ নিয়ে যাবেন না। ধর্মভীরু কোনো মুসলমানও এ কাজ করতে পারবেন না। এসব ন্যক্কারজনক কাজ যারা করেছেন, তারা কেউই ধার্মিক নন- সবাই দুর্বৃত্ত।’ সময় বড় যন্ত্রণাময়। উৎসবের আসরে ছিল ভাইরাসের আতঙ্ক। তার ওপর আবার মানবঘাতী জঙ্গিগোষ্ঠীর মরণকামড় অসাম্প্রদায়িক মানুষকে পীড়িত করেছে। একশ্রেণির মৌলবাদী দুষ্কৃতকারী দেশের সংখ্যালঘু মানুষের ধর্মাচরণের ওপর কুৎসিতভাবে আক্রমণ করেছে। ধর্মান্ধ শক্তি আজ ধর্মনিরপেক্ষ অনুভূতির ওপর আঘাত হেনেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের পূজার আনন্দে কালি ছিটিয়ে দিয়েছে একশ্রেণির বিভেদকামী অমানুষ। কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপ থেকেই গণ্ডগোলের সূত্রপাত। ঝড়ের গতিতে একটি বিতর্কিত ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে শুরু হয় বিক্ষোভ, হাঙ্গামা। তৌহিদি জনতার ব্যানারে শুরু হয় মিছিল। ১০টি জেলার অন্তত ২২টি মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর হয়। সব অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের কণ্ঠ যেন ফুটে উঠেছে বিশিষ্ট ক্রিকেটার এবং এমপি মোর্তজার কণ্ঠে- ‘হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়েছে।’ একজন কুরআন রাখবে কুমিল্লায়, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ফেসবুকে লাইভ করবে অন্যজন। আর তৌহিদি জনতার আগুনে বান্দরবানের লামায় হিন্দু দোকান পুড়বে, ফেনীতে হিন্দু মন্দির ভাঙচুর হবে; হাজীগঞ্জ, বাঁশখালী, চকোরিয়া, গাজীপুরে মন্দির পোড়ানো হবে, চৌমুহনীতে মন্দিরে আক্রমণ করা হবে। রংপুরে বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হবে নিরীহ হিন্দু মানুষ। মাদারীপুরের কালকিনিতে হিন্দুদের দোকান ভেঙে দেয়া হবে। কাশিমবাজারের মন্দিরে হামলা করা হবে। বেগমগঞ্জে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাবে কয়েক হাজার ধর্মান্ধ হিংস্র মানুষ। মন্দিরে চলছিল তখন পূজার প্রস্তুতি। প্রায় দুশ মানুষ একযোগে হামলা চালায় সেখানে। আগুন জ্বলেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী, রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, ঢাকা, মাদারীপুর, কাশিমবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, চাঁদপুর, কক্সবাজার, বেগমগঞ্জে। প্রশ্ন তো আসবেই- এটাই কি আমাদের রাষ্ট্রের চেহারা? এমনটাই কি আমাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি? এমনটাই কি আমাদের রাষ্ট্র, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তি?
খুব সঙ্গত কারণেই কানাডার একটি উদাহরণ তুলে ধরছি। টরোন্টোর কাছে লন্ডন শহর। ২০ বছরের শ্বেতাঙ্গ এক যুবক একটি মুসলিম পরিবারের বাবা-মা, পুত্র ও কন্যাসন্তানকে ইচ্ছে করে ট্রাকের চাপায় পিষে মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল। কারণ ওই পরিবারটি মুসলমান- নামাজ পড়ে, মাথায় টুপি পরে, দাঁড়ি রাখে। সহ্য হয় না তাতে ওই শ্বেতাঙ্গ যুবকটির। এমন ভয়াবহ মৃত্যুর পর স্থানীয় মুসলিম সংঘ লন্ডনের মসজিদ প্রাঙ্গণে আয়োজন করেছিল মনুষ্যত্বের জয়গানের এক সভা। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, অন্টারিওর মুখ্যমন্ত্রী, মেয়রসহ সব রাজনীতিবিদ। প্রত্যেকের জন্য প্রদত্ত ছিল মাত্র দুমিনিটের বক্তৃতার সুযোগ। তাতে সবাই মিলে সোচ্চার কণ্ঠে প্রকাশ করলেন- ‘মৃত ওই লোকটি আমার ভাই, মহিলাটি আমার বোন এবং মৃত মেয়েটি আমার কন্যা। যে তাদের হত্যা করেছে সে আমার-আপনার সবার শত্রæ। যারা তার দলে, তারা মানবতার শত্রæ।’ কানাডার মতো করে আমরা কি তেমন একটি কঠিন বার্তা দিতে পেরেছি দুর্বৃত্তদের জন্য?
ধর্ম অবমাননা কাকে বলব? মন্দির কিছু মানুষের উপাসনার স্থান; মসজিদও কিছু মানুষের উপাসনার স্থান। মুসলমানও মানুষ, হিন্দুও মানুষ। সেই হিন্দুদের মন্দির যারা পুড়িয়ে দিচ্ছে, তারা কি ধর্মের অবমাননা করছে না? হিন্দু-খ্রিস্টানসহ সব স্বীকৃত ধর্মের উপাসনালয় পৃথিবীতে সবসময়ই ছিল। কিন্তু তা পালনে কখনো তো কেউ বাধার সম্মুখীন হয়নি! কেউ তো বাধা দিতে আসেনি! তবে কি সেদিন ধর্ম অবমাননার বিষয়টি অনুপস্থিত ছিল? আজ যারা হিংস্রতার পথ বেছে নিল, তারা কি তবে তাদের নিজ ধর্মের প্রতি সুবিচার করল? সংখ্যালঘুদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার অস্বীকার করার সাধ্য কি আছে আজকের এ বহুমাত্রিক বিশ্বসমাজে? কেননা এখানে কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও সংখ্যালঘু হয়েই জীবন কাটাচ্ছে। এক দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়, অন্য দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কে মারছে কাকে? কে ঘৃণা করছে কাকে? মিথ্যা অজুহাত দাঁড় করিয়ে অথবা ঠুনকো ঘটনার পথ ধরে যারা মানবতার ক্ষতি করছে, ধর্মপথের বিচারে তাদের কি কোনো অপরাধই হচ্ছে না? তারা কি মানুষ মারার অপরাধে অপরাধী হবে না? তারা কি তাদের দুর্বৃত্তায়নজনিত অপরাধের জন্য কোনো শাস্তি পাবে না? সমন্বয় আর সহাবস্থানের কথা এখনো কি জোর দিয়ে বলার সুযোগ আছে? ধর্মনিরপেক্ষতা কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। মানুষ আর মানবতা পশুশক্তির পায়ের নিচে মুখ থুবরে পড়ছে। আমাদের হৃদয় ভেঙে চুরমার হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের সংবিধান অভিসম্পাত দিচ্ছে তাদের, যারা ধর্মনিরপেক্ষতার মূলমন্ত্রে কুঠারের আঘাত হেনেছে।
মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়